অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন-আন্তর্জাতিক by তারেক শামসুর রেহমান
মধ্যপ্রাচ্যে 'আরব বসন্ত' যেমনি সারা মধ্যপ্রাচ্যে একটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, ঠিক তেমনি নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্র্রিটবিরোধী আন্দোলন এখন সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে এক শহর থেকে অন্য শহরে। সম্প্রতি ৮২টি দেশের ৯৫১টি শহরে এই আন্দোলনের ঢেউ গিয়ে লেগেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন হচ্ছে রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের অর্থলিপ্সা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ।
নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটে অবস্থিত করপোরেট হাউসগুলো এখন দুর্নীতির এক একটি প্রতীক। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন দিকে দিকে খারাপের দিকে যাচ্ছে, তখন এই করপোরেট হাউসগুলো মুনাফার পাহাড় গড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের আক্রোশটা সেখানেই। কায়রোর তেহরির স্কয়ারের মতো বিক্ষোভকারীরা নিউইয়র্কের ম্যানহাটান এলাকায় অবস্থিত জুকোটি পার্কটি দখল করে নিয়েছিল। সেখানে তারা অবস্থান ধর্মঘট করে আসছিল দিনের পর দিন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নওরিল রুবিনি অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনকে তুলনা করেছেন একটি 'বিপ্লবের' সঙ্গে। নিউইয়র্কে ওয়ালস্ট্রিটবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজায় আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধ ও যুদ্ধের বাজেট কমাতে যে আন্দোলন চলছে তার সঙ্গে। বিক্ষোভকারীরা যুদ্ধ বন্ধের এই আন্দোলনকে নামকরণ করেছে ঙপঃড়নবৎ ২০১১.ড়ৎম সড়াবসবহঃ. বিক্ষোভকারীদের দাবি, যুদ্ধের জন্য যে বিশাল বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, তা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।
অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট কিংবা ঙপঃড়নবৎ ২০১১.ড়ৎম সড়াবসবহঃ এমনি এমনি হয়েছে, এটা মনে করা ঠিক হবে না। গত এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। সেখানে প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন গরিব। দেশটির ৪ কোটি ৬২ লাখ মানুষ এখন বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে, শতকরা হারে যা ১৫ দশমিক ১। ২০০৯ সালে এ হার ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবার আফ্রো-আমেরিকানদের এবং হিস্পানিকদের সংখ্যা বেশি। এই হার ২৭ দশমিক ৪ ও ২৬ দশমিক ৬ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের গত ৫২ বছরের ইতিহাসে এই হার সর্বোচ্চ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সংস্থান না করে, তাদের নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে যুদ্ধের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ রয়েছে, যাদের 'হেলথ ইন্সু্যুরেন্স' নেই। স্বাস্থ্যসেবার বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬ দশমিক ৩ ভাগ। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধের খরচ মেটাতে কর দেয়। ওবামা প্রশাসনের যুদ্ধের জন্য বাজেট প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধের পেছনে খরচ ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার)। অথচ এর একটা অংশ দিয়ে নতুন চাকরির সংস্থান করা যায়, স্বাস্থ্যবীমার নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের নজর এদিকে নেই। যুদ্ধ তাদের দরকার। যুদ্ধ প্রলম্বিত করে করপোরেট হাউসগুলো মুনাফা লুটছে। যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। সুতরাং আজ যে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন গড়ে উঠছে, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
যুক্তরাষ্ট্রেই গবেষণা হচ্ছে যুদ্ধের খরচ যদি কমানো যায়, তাহলে ওই অর্থ দিয়ে সামাজিক খাতে কী কী পরিবর্তন আনা সম্ভব। পেন্টাগনের হিসাব মতে, প্রতি মাসে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার, যার ৩ ভাগের ২ ভাগ খরচ হয় আফগানিস্তানে। পেন্টাগন ইরাক ও আফগানিস্তানে গত ৪০ মাসে খরচ করেছে ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা কি-না বয়োজ্যেষ্ঠদের স্বাস্থ্যবীমা খাতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে গত ১০ বছরে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু সেনাদের ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি তেল (আফগানিস্তানে) বাবদ (অক্টোবর ২০১০ থেকে মে ২০১১ পর্যন্ত) যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে তেল সরবরাহ ও জনশক্তির খরচ হিসাব করা হতো, তাহলে প্রতি গ্যালন তেলের মূল্য গিয়ে দাঁড়াত ১০০ ডলারে। প্রতি বছর আফগানিস্তানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখতে (সেনাসদস্যদের জন্য) যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ছিল ৫ লাখ ৭ হাজার ডলার (বছরে)। ২০১০ সালে এটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬৭ হাজার ডলারে। আর ২০১১ সালের হিসাব ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ডলার। এটা কংগ্রেসনাল রিপোর্ট। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ইরাকে ২০০৭ সালে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য বছরে খরচ ছিল ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার, ২০১১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২ হাজার ডলারে। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আফগানিস্তানে যুদ্ধের খরচের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ১১৩ বিলিয়ন ডলার। ইরাকের জন্য বরাদ্দ ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এখন ওবামা প্রশাসনকে যুদ্ধের জন্য যদি অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করতে না হতো, তাহলে এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ১. ৫৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন শিশুর (নিম্নআয়ের পরিবারের) স্বাস্থ্যসেবা; ২. ২৩ মিলিয়ন নিম্নআয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা; ৩. ২০২ মিলিয়ন ছাত্রের বৃত্তি; ৪. ১৪ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা ও ৫. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ১৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব। সুতরাং আজকে ওয়াশিংটনে কিংবা নিউইয়র্কে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার পেছনের কারণগুলো কী, তা সহজেই অনুমেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলেও, ওবামা যুদ্ধ বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং তিনি লিবিয়ায় নতুন একটি 'ফ্রন্ট ওপেন' করেছেন। লিবিয়ায় যে যুদ্ধের সূচনা তিনি করেছিলেন তাঁকে চিহ্নিত করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে। লিবিয়ার পর এখন সম্ভাব্য টার্গেট হচ্ছে সিরিয়া ও ইরান। সুতরাং আগামীতে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর সঙ্গত কারণেই যুদ্ধের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হলে সামাজিক খাতে আরও কাটছাঁট করতে হবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বয়োজ্যেষ্ঠ আর শিশুরা। তাদের স্বাস্থ্য সুবিধা আরও সীমিত হবে। যুদ্ধের কারণে সমাজের একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুবিধাভোগী একটি অংশ বরং এতে উপকৃতই হচ্ছে। ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে করপোরেট হাউসগুলো আরও ধনী হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ধনিকশ্রেণী, যাদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ, তারা দেশটির মোট সম্পদের ৩৩ শতাংশের মালিক। সুতরাং করপোরেট হাউসগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
আজ নিউইয়র্কের জুকোটি পার্কে শত শত তরুণ সমবেত হয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করল, তার সঙ্গে কায়রোর তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের বেশ মিল পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহার করে মিসরের তরুণ সমাজ একটি বিপ্লবের সূচনা করেছিল। পতন ঘটেছিল হোসনি মোবারকের। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও তরুণরা এই সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহার করছে। তবে পার্থক্যটা এখানেই যে, এতে করে ওবামা প্রশাসনের পতন ঘটবে না। তবে ওবামা প্রশাসন নিশ্চয়ই এটা থেকে কিছু শিখবে। ২০১২ সালে সেখানে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন কোনো প্রভাব ফেলবে না, তা বলা যাবে না। আরও একটা কথা, সারাবিশ্বই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে রোমে, লন্ডনে, অকল্যান্ডে। গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট রাষ্ট্রটিকে একটি 'ব্যর্থ রাষ্ট্রে' পরিণত করেছে। ইউরোপে এক মুদ্রা ইউরো এখন অনেকটা অকার্যকর। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। এখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সমস্যার সমাধানে কী উদ্যোগ নেন, সেটাই দেখার বিষয়।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান :শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট কিংবা ঙপঃড়নবৎ ২০১১.ড়ৎম সড়াবসবহঃ এমনি এমনি হয়েছে, এটা মনে করা ঠিক হবে না। গত এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। সেখানে প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন গরিব। দেশটির ৪ কোটি ৬২ লাখ মানুষ এখন বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে, শতকরা হারে যা ১৫ দশমিক ১। ২০০৯ সালে এ হার ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবার আফ্রো-আমেরিকানদের এবং হিস্পানিকদের সংখ্যা বেশি। এই হার ২৭ দশমিক ৪ ও ২৬ দশমিক ৬ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের গত ৫২ বছরের ইতিহাসে এই হার সর্বোচ্চ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সংস্থান না করে, তাদের নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে যুদ্ধের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ রয়েছে, যাদের 'হেলথ ইন্সু্যুরেন্স' নেই। স্বাস্থ্যসেবার বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬ দশমিক ৩ ভাগ। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধের খরচ মেটাতে কর দেয়। ওবামা প্রশাসনের যুদ্ধের জন্য বাজেট প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধের পেছনে খরচ ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার)। অথচ এর একটা অংশ দিয়ে নতুন চাকরির সংস্থান করা যায়, স্বাস্থ্যবীমার নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের নজর এদিকে নেই। যুদ্ধ তাদের দরকার। যুদ্ধ প্রলম্বিত করে করপোরেট হাউসগুলো মুনাফা লুটছে। যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। সুতরাং আজ যে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন গড়ে উঠছে, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
যুক্তরাষ্ট্রেই গবেষণা হচ্ছে যুদ্ধের খরচ যদি কমানো যায়, তাহলে ওই অর্থ দিয়ে সামাজিক খাতে কী কী পরিবর্তন আনা সম্ভব। পেন্টাগনের হিসাব মতে, প্রতি মাসে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার, যার ৩ ভাগের ২ ভাগ খরচ হয় আফগানিস্তানে। পেন্টাগন ইরাক ও আফগানিস্তানে গত ৪০ মাসে খরচ করেছে ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা কি-না বয়োজ্যেষ্ঠদের স্বাস্থ্যবীমা খাতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে গত ১০ বছরে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু সেনাদের ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি তেল (আফগানিস্তানে) বাবদ (অক্টোবর ২০১০ থেকে মে ২০১১ পর্যন্ত) যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে তেল সরবরাহ ও জনশক্তির খরচ হিসাব করা হতো, তাহলে প্রতি গ্যালন তেলের মূল্য গিয়ে দাঁড়াত ১০০ ডলারে। প্রতি বছর আফগানিস্তানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখতে (সেনাসদস্যদের জন্য) যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ছিল ৫ লাখ ৭ হাজার ডলার (বছরে)। ২০১০ সালে এটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬৭ হাজার ডলারে। আর ২০১১ সালের হিসাব ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ডলার। এটা কংগ্রেসনাল রিপোর্ট। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ইরাকে ২০০৭ সালে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য বছরে খরচ ছিল ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার, ২০১১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২ হাজার ডলারে। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আফগানিস্তানে যুদ্ধের খরচের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ১১৩ বিলিয়ন ডলার। ইরাকের জন্য বরাদ্দ ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এখন ওবামা প্রশাসনকে যুদ্ধের জন্য যদি অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করতে না হতো, তাহলে এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ১. ৫৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন শিশুর (নিম্নআয়ের পরিবারের) স্বাস্থ্যসেবা; ২. ২৩ মিলিয়ন নিম্নআয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা; ৩. ২০২ মিলিয়ন ছাত্রের বৃত্তি; ৪. ১৪ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা ও ৫. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ১৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব। সুতরাং আজকে ওয়াশিংটনে কিংবা নিউইয়র্কে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার পেছনের কারণগুলো কী, তা সহজেই অনুমেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলেও, ওবামা যুদ্ধ বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং তিনি লিবিয়ায় নতুন একটি 'ফ্রন্ট ওপেন' করেছেন। লিবিয়ায় যে যুদ্ধের সূচনা তিনি করেছিলেন তাঁকে চিহ্নিত করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে। লিবিয়ার পর এখন সম্ভাব্য টার্গেট হচ্ছে সিরিয়া ও ইরান। সুতরাং আগামীতে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর সঙ্গত কারণেই যুদ্ধের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হলে সামাজিক খাতে আরও কাটছাঁট করতে হবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বয়োজ্যেষ্ঠ আর শিশুরা। তাদের স্বাস্থ্য সুবিধা আরও সীমিত হবে। যুদ্ধের কারণে সমাজের একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুবিধাভোগী একটি অংশ বরং এতে উপকৃতই হচ্ছে। ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে করপোরেট হাউসগুলো আরও ধনী হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ধনিকশ্রেণী, যাদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ, তারা দেশটির মোট সম্পদের ৩৩ শতাংশের মালিক। সুতরাং করপোরেট হাউসগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
আজ নিউইয়র্কের জুকোটি পার্কে শত শত তরুণ সমবেত হয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করল, তার সঙ্গে কায়রোর তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের বেশ মিল পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহার করে মিসরের তরুণ সমাজ একটি বিপ্লবের সূচনা করেছিল। পতন ঘটেছিল হোসনি মোবারকের। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও তরুণরা এই সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহার করছে। তবে পার্থক্যটা এখানেই যে, এতে করে ওবামা প্রশাসনের পতন ঘটবে না। তবে ওবামা প্রশাসন নিশ্চয়ই এটা থেকে কিছু শিখবে। ২০১২ সালে সেখানে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন কোনো প্রভাব ফেলবে না, তা বলা যাবে না। আরও একটা কথা, সারাবিশ্বই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে রোমে, লন্ডনে, অকল্যান্ডে। গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট রাষ্ট্রটিকে একটি 'ব্যর্থ রাষ্ট্রে' পরিণত করেছে। ইউরোপে এক মুদ্রা ইউরো এখন অনেকটা অকার্যকর। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। এখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সমস্যার সমাধানে কী উদ্যোগ নেন, সেটাই দেখার বিষয়।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান :শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments