একাত্তরে বিশ্ব রাজনীতি ও মার্কিন ভূমিকার অন্যদিক by শাহ আহমদ রেজা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিভক্ত বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে মেরুকরণ শুরু হয়েছিল। পরিবর্তন ঘটেছিল বিভিন্ন দেশের মধ্যকার সম্পর্কে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনকারী দল আওয়ামী লীগের কোনো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছিল না। দলটির একমাত্র কৃতিত্ব ছিল ভারত সরকারের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা।
বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন ঘটেছিল আসলে ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। অন্যদিকে অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ভারতের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল। এই সমর্থন শেষ পর্যন্ত পেয়েছিল বাংলাদেশ। উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম পরাশক্তি ও সমাজতান্ত্রিক দেশ গনচীনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ। সাধারণভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও গনচীন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে।
ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দিক পরিবর্তনকারী ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা। দৃশ্যত ভারতের পক্ষে দাঁড়ালেও সোভিয়েত ইউনিয়ন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্যই তাগিদ দিয়েছে। ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্য থেকে দেশটি বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বলেছে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। মস্কোর মনোভাবে পরিবর্তন ঘটেছিল ২৫ বছর মেয়াদি ভারত-সোভিয়েত ‘মৈত্রী চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর (৯ আগস্ট, ১৯৭১)। চুক্তিটি প্রকৃতপক্ষে ছিল সামরিক চুক্তি এবং এটা স্বাক্ষরের ফলে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। বিনিময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্য জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছে। ডিসেম্বরে চূড়ান্ত যুদ্ধের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র যখন স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন নিরাপত্তা পরিষদে ভেটোর পর ভেটো প্রয়োগ করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের বিজয় প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর কারণ সৃষ্টি করেছে মার্কিন সরকারেরই গোপন দলিলপত্র। আর্কাইভস আইন অনুযায়ী দীর্ঘদিন গোপন রাখার পর ১৯৯৯ সালে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কিত গোপন দলিলপত্র প্রকাশ করতে শুরু করে। দলিলপত্রের প্রথম সংকলন হিসেবে সে বছর প্রকাশিত হয় ‘দি অ্যামেরিকান পেপারস : ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ডকুমেন্টস ১৯৬৫-১৯৭৩’ নামের প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠার এক বিরাট গ্রন্থ। এতে ১৯৭১ সালের ১০৮টিসহ মোট ২৯৯টি গোপন দলিল সংকলিত হয়েছে। দলিলগুলো পড়লে সচেতন পাঠকের মনেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত নীতি ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হবে। দলিলগুলো একটি বিষয়কে নিশ্চিত করেছে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মার্কিন সরকার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থেকেছে, সম্ভাব্য পরিণতির ব্যাপারেও প্রস্তুতি নিয়েছে। যেমন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করতে পারেন, সে কথা মার্কিন সরকার আগেই জেনে গিয়েছিল। ইসলামাবাদ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঠানো গোপন রিপোর্টে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড জানিয়েছিলেন, সেদিনই তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ফারল্যান্ড লিখেছেন, বৈঠককালে ‘প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পরিচয়ের পর প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে উদ্বিগ্ন দেখতে পাই। সংবিধান প্রশ্নে মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যে সৃষ্ট অচলাবস্থায় তাকে হতাশ মনে হয়েছে।’ মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরও লিখেছেন, ‘তিনি (ইয়াহিয়া) গোপনে জানালেন, যদি ৩ মার্চের আগে ভুট্টো-মুজিবের মধ্যে সৃষ্ট অচলাবস্থার অবসান না হয়, তাহলে তিনি এক বা দুই সপ্তাহের জন্য কিংবা প্রয়োজন দেখা দিলে আরও বেশি সময়ের জন্য ঢাকায় জাতীয় পরিষদে নিজের উপস্থিতি স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছেন।...খুব তাড়াতাড়ি অচলাবস্থার অবসান না হলে কী ঘটবে বলে তিনি ভাবছেন, সে বিষয়ে ইয়াহিয়া কিছু জানালেন না। কিন্তু নৈরাশ্যের সুরে বললেন, ‘রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলার’ শুরু হতে পারে।’
অর্থাত্, যুক্তরাষ্ট্র ঘটনাপ্রবাহের সম্ভাব্য গতিধারা, এমনকি রক্তক্ষয়ের ব্যাপারেও জানত। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পরদিন, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড লিখেছেন, ‘আমাদের ঢাকাস্থ কনস্যুলেট জেনারেলের মূল্যায়নে পাকিস্তানের অব্যাহত ঐক্যের সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি এসে গেছে।’ ৪ মার্চের চিঠিতে রাষ্ট্রদূত লিখেছেন, ‘...যত ক্ষীণভাবেই হোক, মুজিবুর রহমান এখনও পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী বলে ধারণা করা হচ্ছে।...তিনি (শেখ মুজিব) আরও বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান পৃথক পৃথকভাবে সংবিধান রচনা করবে এবং তারপর কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখার কথা বিবেচনা করা হবে।...’
বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি ও মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে ৫ মার্চের এক সংক্ষিপ্ত স্মারকে। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘বিচ্ছিন্নতা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তারা (পাকিস্তানের সেনাবাহিনী) মরিয়া হয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে, তা যতই সহিংস ও নস্ফিল হোক না কেন।...আমাদের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালিদের স্বাধীনতাকে দমন করার উদ্দেশ্যে সামরিক শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সহিংসতা ও রক্তক্ষয় ঠেকানোর জন্য আমাদের গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। আমরা শত্রুতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে ব্রিটেন ও জাপানসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একযোগে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর ইচ্ছা বিবেচনা করতে চাই।’ একই ধরনের বক্তব্য এসেছে পররাষ্ট্র দফতরের ৫ মার্চের কন্টিনজেন্সি স্টাডিতে। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ স্থাপনের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। পাকিস্তান যদি বল প্রয়োগের পথে অগ্রসর হয় তাহলে ‘প্রস্তাবিত মার্কিন ব্যবস্থা’ উপশিরোনামে বলা হয়েছে : ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে আমাদের কিছুটা বিলম্ব করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের থাকা উচিত। ভারত এক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে পারে। ভারতের সঙ্গে সমন্বয় রাখার দরকার নেই। যদিও আমরা স্বীকৃতি দেয়ার আগে ভারতকে সেটা জানাতে পারি।’
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও চিন্তাধারায়ও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। যেমন, ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন এক রিপোর্টকে মার্কিন সরকার যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিল, যার মধ্যে বাংলাদেশের সমর্থনে বলিষ্ঠ বক্তব্য ছিল। ১৩ এপ্রিলের এই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘...সংঘাত ও শত্রুতার অবসানের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিহিত রয়েছে।’ ... রাষ্ট্রদূতের সুপারিশে বলা হয়েছিল, ‘...পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিতে পারে, মার্কিন সমরাস্ত্র ও সরঞ্জাম ব্যবহারের জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে, শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের ভাগ্যের ব্যাপারে উদ্বেগ জানাতে পারে এবং আশু রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দিতে পারে।’
নয়াদিল্লিস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই রিপোর্টে ‘কয়েকটি সত্য’ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়—‘একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে; বিশ্বের এই অঞ্চলে ভারত এখন সুস্পষ্টভাবে প্রধান, প্রকৃত এবং সম্ভাবনাময় শক্তি; সীমাবদ্ধ সম্ভাবনা এবং ব্যাপক সমস্যাসহ বাংলাদেশ সম্ভবত জন্ম নিতে যাচ্ছে। এসব বাস্তবতাকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় এবং এর বাইরে নিজের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে পারে।’ মার্কিন সরকারের করণীয় হিসেবে রাষ্ট্রদূতের সুপারিশে বলা হয়, ‘...একই কারণে আমাদের উচিত ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’, ‘বাইরের শক্তি জড়িত রয়েছে’ ধরনের বিবৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকা; পূর্বপাকিস্তানে সামরিক নির্যাতনের অবৈধ নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ও অকপট অবস্থান বজায় রাখা এবং সাধারণভাবে পাকিস্তান সরকারকে নীতি পরিবর্তনে প্রভাবিত করা। স্বীকৃতির প্রশ্নে নয়াদিল্লিস্থ রাষ্ট্রদূতের রিপোর্টে বলা হয়, ‘আমি আশা করি, পশ্চিম পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ না করার স্বাভাবিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার স্বার্থে যথাসময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সুযোগ গ্রহণ করা হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র আরও অনেকভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল বলে বিভিন্ন দলিলপত্রে লক্ষ্য করা গেছে। এসবের মধ্যে ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার ও মুক্তির ব্যাপারে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি। যেমন, ২৮ সেপ্টেম্বরের টেলিগ্রামে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড ‘মুজিবের বিচার ও শাস্তি’ উপশিরোনামে লিখেছেন— ‘এই প্রসঙ্গটি একই সঙ্গে আমাদের কার্যক্রমের সুফল ও সীমাবদ্ধতার দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে এসেছে এবং এর শেষ কাহিনী এখনও লিখিত হয়নি। মে থেকে অনুষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই আমি ইয়াহিয়ার কাছে প্রশ্ন তুলেছি এবং এটা কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে একটি, যে ব্যাপারে আমরা পাকিস্তান সরকারের ওপর জনমতের চাপ ব্যবহার করেছি। ফলাফল ঠিক ততটাই হয়েছে, যতটা বাস্তবতার আলোকে সম্ভব ছিল। ...মুজিবকে একজন আইনজীবী দেয়া হয়েছে এবং আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আশ্বাস পেয়েছি যে, মুজিবকে হত্যা করা হবে না।’
ভারতের প্রতি গৃহীত তোষণমূলক নীতির দিকটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের চিঠিপত্রে একথা স্পষ্ট হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ওয়াশিংটন সফরও ছিল ইঙ্গিতপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে জানা গেছে, নয়াদিল্লিস্থ রাষ্ট্রদূতের কাছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পাঠানো টেলিগ্রামে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করার নির্দেশ দিয়ে ২২ নভেম্বরের এই টেলিগ্রামে বলা হয়, ‘আপনি উল্লেখ করবেন যে, মিসেস গান্ধী শান্তির পক্ষে ইচ্ছা ব্যক্ত করায় এবং ভারত আগে যুদ্ধ শুরু করবে না বলে আশ্বাস দেয়ায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিশেষভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাছাড়া আপনি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন, এখানে তার সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরিস্থিতিকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে আমরা নিম্নবর্ণিত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলাম : (ক) ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আমরা পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করেছি; (খ) শরণার্থী কর্মসূচিতে অব্যাহত সমর্থন হিসেবে বস্তুগত সাহায্য দেয়ার আশ্বাস দিয়েছি; এবং (ঘ) রাজনৈতিক সমঝোতা প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি পন্থা নিয়ে আমরা অলোচনা করছি।’
একথা সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যায়নি, কিন্তু একথাও লক্ষ্যণীয় যে, মার্কিন দলিলপত্র অন্যরকম কিছু তথ্যকে সামনে এনেছে। ওপরে সংক্ষেপে উল্লিখিত চিন্তা, বক্তব্য ও সুপারিশসহ দলিলপত্রগুলো পড়ার পর মনে হতে পারে যেন পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ঠিক, তেমন গভীর ও প্রশ্নাতীত ছিল না যেমনটি প্রচারিত হয়ে এসেছে। পাইপলাইন থেকে সমরাস্ত্র প্রত্যাহার, রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য ক্রমাগত চাপ, শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার তাগিদ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বরং এমন ধারণাই শক্তিশালী হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। একে তাই বলে আবার সম্পূর্ণরূপে ভারতের পক্ষাবলম্বন বলারও উপায় নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ সমঝোতা এবং যুদ্ধ এড়ানোর জন্য ভারতের ওপরও চাপ অব্যাহত রেখেছে, ভারতকে প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দিয়েছে। কিন্তু তারপরও একথাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করা থেকে সুকৌশলে বিরত থেকেছে। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে বরং ভারতকে খুশি করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত হতাশ হলেও ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক বা কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, প্রতিটি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থানকে ধরে রাখার কৌশল থেকে পদক্ষেপ নিয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ভারত বা পাকিস্তানেরও পক্ষে যায়নি। বর্তমান আলোচনার সমাপ্তি টানতে গিয়ে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বলা দরকার, প্রকাশিত গোপন দলিলপত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে রেহাই দিতে পারবে না। কারণ, এতদিন পর যত কথাই বোঝানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন যোগাড় করেছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪-১১ ভোটে পাকিস্তানকে জিতিয়েছে এবং শেষ দিনগুলোতে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে চমক ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের পরাজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
ঘটনাপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বরং প্রতারণাপূর্ণ কৌশল অবলম্বনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। কারণ, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সে সময় গনচীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গনচীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মধ্যস্থতা করায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার ‘অভিনয়’ করেছিল। ‘অভিনয়’ বলার কারণ, এই সমর্থন আন্তরিক হলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তানকে কার্যকরভাবে সাহায্য করত। অন্যদিকে দেশটি শুধু কূটনৈতিক তত্পরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। বাংলাদেশের বিরোধিতা করার জন্য এটুকুই অবশ্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু নিজের স্বার্থে সুকৌশলে পদক্ষেপ নিলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-যুদ্ধকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল।
No comments