নিত্যজাতম্-আধুনিক যুগে মৃত্যু নিয়ে জটিলতা by মহসীন হাবিব
আইন তৈরি হতে হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সমাজের প্রয়োজনে। আইন প্রণয়ন বা সংশোধনকালে সর্বসাধারণের কথা যেমন ভাবতে হয়, তেমনি ব্যতিক্রম বা সংখ্যালঘু কিছু মানুষের কথাও মাথায় রাখা সমানভাবে জরুরি। মানুষের জীবনকে আইনের গণ্ডিতে আবদ্ধ করার চেষ্টা বা জীবনের পূর্ণাঙ্গ ভাষা আইনি ব্যাখ্যার অধীন করা হয়তো কখনোই হয়ে উঠবে না।
তার পরও যতটা সম্ভব আইনের পরিধি সাবলীল ও মানববান্ধব করে প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে মানুষের সমাজ সুশৃঙ্খল করা দক্ষ ও যোগ্য আইন প্রণেতার কাজ। আইন প্রণেতাদের ব্যক্তিগত চাওয়া, বিশ্বাস, পছন্দ-অপছন্দের ঊধর্ে্ব থেকে প্রয়োজনে একজন মাত্র মানুষের অধিকার রক্ষায় আইন সংশোধনে সায় দেওয়া একজন আইন প্রণেতার কর্তব্য। সভ্য সমাজ অন্তত আইন প্রণেতার কাছে তেমনটাই দাবি করে। কিন্তু সত্যিই কাজটি কখনো কখনো কঠিনতর হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিককালে ইংল্যান্ড ও কানাডার একটু ব্যতিক্রমী দুটি ঘটনার উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে।
ব্রিটিশ নাগরিক টনি নিকলিনসনের বয়স এখন ৫৬ বছর। প্রাণবন্ত, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী টনি ছয় বছর আগে ব্যবসায়িক কাজে গ্রিসে গিয়ে ভয়ানক স্ট্রোকের সম্মুখীন হন। স্ট্রোকের ফলে তাঁর পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়। শুধু চোখ দুটি ছাড়া তাঁর শরীরের অন্য কোনো অংশে সামান্য একটু বোধও নেই। কিন্তু মস্তিষ্ক রয়েছে পুরোপুরি সক্রিয় ও স্বাভাবিক। যেন মানুষটিকে ভেতরে রেখে গোটা শরীরটাই তালাবদ্ধ হয়ে গেছে। তাঁর মুখ দিয়ে সর্বক্ষণ লালা গড়িয়ে পড়ছে। শরীরের কোথাও একটু চুলকাতে হলেও তার কোনো উপায় নেই। টনির স্ত্রী জেইন নিকলিনসন এবং ইংল্যান্ডের চিকিৎসকরা বহু কষ্টে তাঁর সেবা করে যাচ্ছেন। টনির মনের ভাব বোঝার একমাত্র উপায় হচ্ছে, তাঁর সামনে বড় বড় ইংরেজি অক্ষরের একটি বোর্ড তুলে ধরতে হয়। তিনি যে অক্ষরগুলোর দিকে তাকান, সেগুলো দিয়ে গঠিত হয় শব্দ ও বাক্য। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে অক্ষরগুলো বুঝে নিতে হয়। একটি অত্যাধুনিক কম্পিউটার রয়েছে টনির সামনে। সে কম্পিউটারের মনিটরে যে বাক্যগুলোর দিকে টনি তাকান, সেগুলো বিশেষ রং ধারণ করে। এই হলো তাঁর জীবন। এ জীবন থেকে সেরে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। এমন অবস্থায় টনি চান আত্মহত্যা করতে। মানুষের আত্মহত্যা করতে কোনো আইনের প্রয়োজন হয় না, যদিও উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে এখন আত্মহত্যাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, নিজে থেকে টনির আত্মহত্যা করার কোনো ক্ষমতাই নেই। তাই তিনি চান, তাঁর স্ত্রী অথবা চিকিৎসক তাঁকে একটি ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করুক, যাকে ইংরেজিতে বলে অ্যাসিস্টেড সুইসাইড। স্ত্রী জেইনও বাস্তবতা বোঝেন। অসম্ভব ভালোবাসার এই মানুষটির কষ্ট থেকে পরিত্রাণের এখন একটাই উপায় বলে তিনিও স্বামী টনির আত্মহত্যাকে সমর্থন করেন। তবে বাদ সেধেছে ব্রিটিশ আইন। সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ওরিগন ও মন্টানা রাজ্যে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মহত্যায় সহযোগিতাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কিন্ত ইংল্যান্ড, ওয়েলস বা আয়ারল্যান্ডের আইন অনুসারে, কাউকে আত্মহত্যায় সহায়তা করা বা প্ররোচিত করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের কারণে ১৪ বছরের জেল হতে পারে। টনি সুইজারল্যান্ডে গিয়ে মরতে পারেন_এমন আইডিয়া বা পরামর্শ এসেছিল, কারণ সেখানে কোনো ক্লিনিক তাঁকে আত্মহত্যায় সহায়তা করলে আইনগত দায় থাকবে না। কিন্তু টনি মরতে চান তাঁর দেশে, তাঁর আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে, ইংল্যান্ডের আইনের বৈধতা নিয়ে। এ আইন সহজে শিগগিরই ব্রিটেনে পরিবর্তন করা সম্ভব হবে বলে অনেকেই মনে করছেন না। কারণ একদিকে রয়েছে ব্রিটেনের রক্ষণশীল সমাজ এবং শক্তিশালী ধর্মীয় অনুভূতি, অন্যদিকে মানবতাবাদী কিছু মানুষ ও সংগঠনের যুক্তি, যাঁরা এ ধরনের আইনের বিরোধিতা করছেন। তাঁদের যুক্তি হলো, এমন আইন পাস হলে যারা আত্মহত্যা করতে চাইছে, তাদের অনেক বেশি পরিমাণে প্ররোচিত করতে পারে আত্মীয়-পরিজন। প্ররোচিত করতে পারে বোঝা বা বারডেন মনে করে অথবা সম্পদের কারণে।
এমন আরো একটি আইন সংশোধনের লড়াই চলছে কানাডার কুইবেক প্রদেশে। ৪৭ বছর বয়সী নারী জেনেট লেবল্যাংক এমিওট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস বা সংক্ষেপে এএলএস নামের স্নায়ুর জটিল রোগে ভুগছেন। শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রচণ্ড কষ্টের পাশাপাশি তাঁর দেহ অসাড় হয়ে পড়েছে। তাঁর বিষয়টিও রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। এসব ঘটনায় কোনো কোনো চিকিৎসক আত্মহত্যায় সহযোগিতার পক্ষে মত দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ রেফারেন্ডাম বা পার্লামেন্টের ভোটের আয়োজনের কথাও বলছেন। বাংলাদেশে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা কত বা আদৌ আছে কি না জানা নেই। তবে অনুমান করি, এমন রোগী তো আছে এবং তাদের পরিণতি অকল্পনীয় রকমের ভয়াবহ। এ দেশে 'বাতাস লাগছে', 'জিনে ধরছে', 'ভূতে ধরছে' ধরনের অনেক রোগীর করুণ ঘটনা আমাদের জানা আছে। যে দেশে মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে পানিতে নিয়ে চোবানো একটি থেরাপি, সেখানে এত সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন কেউ আমরা বোধ করি না। বাংলাদেশে মানুষের জীবনের দাম কারো চোখে এত বেশি না যে একজন বা দুজন মানুষের কথা বিবেচনা করে আইন সংশোধন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন কেউ করবেন! আমরা প্রায়ই দেখি, কোনো রোগীর অবস্থা সঙ্গিন হলে, স্বাভাবিক জীবনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেলে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। রোগী বা আত্মীয়-পরিজন নয়, সিদ্ধান্ত অনেক সময় চিকিৎসকরাই দিয়ে দেন এবং সবাই তা মেনে নেয়। রোগীর ব্যাপারে বাংলাদেশে যেন চিকিৎসকই আদালত।
অবশ্য এখনই আমি বাংলাদেশে আত্মহত্যায় সহযোগিতার মতো সূক্ষ্ম আইন পাস করার যুক্তি দিচ্ছি না। এ দেশে আইনের আরো অনেক মোটা দাগের সংশোধনী কাজ বাকি রয়ে গেছে, আমাদের মাথার ওপর যেগুলো বোঝা হয়ে আছে। তা ছাড়া ধর্মীয় বিধি-নিষেধের বিষয় তো রয়েছেই। কিন্তু এ ধরনের বিপদগ্রস্ত মানুষের ব্যাপারে আমাদের চেতনা জাগ্রত থাকা দরকার বলে মনে করি।
২. কেনিয়ার হামিসি জেলার ছোট্ট একটি গ্রামে বাস করতেন এমজি মিদম নামের এক লোক। হঠাৎ তিনি অসুস্থ হলেন এবং বিছানা নিলেন। একপর্যায়ে তিনি মারা গেলেন। আত্মীয়স্বজন কান্নাকাটি করে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকল। অতি ভালোবাসার কারণে কেউ কেউ তাঁকে কবরে রাখতে দিতে চায় না। তিন দিন পার হয়ে গেল শোকের মধ্য দিয়ে। এবার চার্চের পাদ্রি এলেন হাতে বাইবেল নিয়ে। মিদমকে কফিনে শুইয়ে দেওয়া হলো। সবাই ধরাধরি করে তাঁকে সমাধিতে নামাল। হঠাৎ কফিনের ভেতর থেকে কেশে উঠল কে! হাত থেকে বাইবেল ফেলে দৌড়ে পালালেন পাদ্রি, আত্মীয়স্বজন ভয়ে চারদিকে ছোটাছুটি করে পালাল। আর মিদম কফিনের ভেতর থেকে চিৎকার, চেঁচামেচি করতে থাকলেন। অবশেষে দুজন সাহসী যুবক এগিয়ে এসে কফিন খুলল। মিদম উঠে বসে প্রথমেই বললেন, 'আমাকে কিছু খেতে দাও, আমি ভয়ানক ক্ষুধার্ত।' কেনিয়া বলে কথা! গ্রামের লোকজন তাকে ভূত, জিন ইত্যাদি মনে করতে থাকল। কেউ কেউ অবশ্য তাঁকে যিশুর মতো পুনর্জন্ম লাভকারী বলে বিশ্বাস করতে থাকল। আসলে মিদম ছিলেন কোমায়। যে কোমায় আজ ছয় বছরাধিককাল ধরে রয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এবং ইসরায়েলিদের কাছে অষ্টম মহান ইসরায়েলি বলে বিবেচিত এরিয়েল শ্যারন। তাই এখন আমাদের আত্মহত্যার অধিকার নয়, আইন পাস করা দরকার, কোনো রোগীকে কোয়ালিফায়েড ডাক্তার ছাড়া কেউ মৃত ঘোষণা করতে পারবেন না। সরকারি ডাক্তারদের মধ্যে জুরিসডিকশন ভাগ করে দিতে হবে। রোগী ওই চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন থাকুক বা না থাকুক, একমাত্র মৃত ঘোষণা করবেন তিনি। এতে অবশ্য চিকিৎসক সাহেবের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে কিছু অসুবিধা হবে। হোক না, চিকিৎসা পেশা ডাক্তার সাহেব তো গ্রহণ করেছেন মানুষের সেবার ব্রত নিয়ে, তাঁরা তো প্র্যাকটিসের চেম্বার নামক দোকানে সারাক্ষণ বসে থাকার জন্য এ পেশা নেননি!
লেখক : সাংবাদিক, mohshinhabib@yahoo.com
No comments