বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-টিপাইমুখ: যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনার অনুরোধ by গওহর রিজভী
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহজুড়ে টিপাইমুখে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রশ্নে ব্যাপক বিতর্কের ঢেউ উঠেছে। বিষয়টা হালকাভাবে নিলে আমাদের চলবে না এবং জাতীয় স্বার্থকে যাতে কোনোভাবে ছাড় দিতে না হয়, তার জন্য সম্ভব সবকিছুই আমাদের করতে হবে।
আমাদের কেবল সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানিপ্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখা নিশ্চিত করলেই চলবে না, দেখতে হবে যাতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়, বর্ষায় যাতে বন্যা না বাড়ে এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বরাক নদ থেকে যাতে পানি প্রত্যাহার না হয়। এসব ক্ষেত্রে আপসের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, এগুলো আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার অপরিহার্য বিষয়।
প্রায়ই যেমন ঘটে, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের এক পাশে সরিয়ে মঞ্চ দখল করে নেয় প্রবল কণ্ঠের পল্লবগ্রাহী আলোচকবৃন্দ। এ-বিষয়ক আলোচনা ফলত অতিশয়োক্তির রূপ পেয়েছে, অন্তঃসারশূন্য গরম কথাবার্তা দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করাই এ ক্ষেত্রে প্রধান কর্ম। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই, এই বিতর্ক থেকে অনেক বাদ-বিবাদের সৃষ্টি হলেও বিষয়টি সামান্যই খোলাসা হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকের বেলায় সত্য সন্ধানের চেষ্টার পরিবর্তে লক্ষ করা যায় দলীয় রাজনীতি ও প্রচারণা।
বাংলাদেশের আরও অনেকের মতো আমিও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। দিল্লি যাওয়ার আগে টিপাইমুখ প্রকল্পের প্রভাব বিষয়ে আমি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিজ্ঞানী, নীতিপ্রণেতা এবং ভিন্ন মত ও দলের রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আমাদের সমস্যাগুলো বুঝতে সহায়তা করেছেন এবং কোন কোন বিষয়ে আমাদের ব্যাখ্যা ও নিশ্চয়তা পাওয়া দরকার, সে বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগও জানিয়েছেন। এই সফরে আমরা ভারতের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তপ্রণেতা মুখ্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনায় আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রীও। আমরা যতটা তথ্য ও সত্য জড়ো করতে পেরেছি, এখানে সেগুলো তুলে ধরতে চাই:
টিপাইমুখ ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রস্তাবিত একটি বহুমুখী প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য দুটি: প্রথমত, এটি একটি জলবিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্প, যা ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে; এবং দ্বিতীয়ত, প্রত্যাশা অনুসারে এটি ভাটিতে বন্যা-পরিস্থিতি সহনীয় করায় ভূমিকা রাখবে।
বিজ্ঞানী ও পানিবিশারদদের মতে, এটি একটি গতিশীল জলপ্রবাহ (run-of-the-river) প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ড্যামের মধ্যে অথবা জলাধারে মজুদ পানি অবিরাম ছাড়তে হবে। এর ফলে ভারী বন্যার মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রেখেও নিচের সমতলে বন্যাক্রান্ত হওয়া প্রশমনে পানি ছাড়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশে বরাক নদের দুটি শাখা সুরমা ও কুশিয়ারার পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়। কারণ, এই প্রকল্পে পানি প্রত্যাহার বা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে না। জলাধারসহ ড্যাম কার্যত শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ বাড়ায় আর বর্ষায় পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।
এটি ভাটি অঞ্চলে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে কেবল তখনই, যদি সেচ ও অন্যান্য প্রয়োজনে পানি অন্যত্র টেনে নেওয়া হয়। মণিপুরের রাজ্য সরকার এবং ভারতের ন্যাশনাল পাওয়ার করপোরেশনের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে বাঁধ (ব্যারাজ) নির্মাণ কিংবা বরাক নদ থেকে পানি প্রত্যাহারের কোনো শর্ত বা ধারা নেই। ভারতের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই নদীর পানির হিস্যা এবং পানিবণ্টন জটিল সমস্যা এবং রাজ্যে রাজ্যে বিরোধের একটা উৎস। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত সরকার তাদের আন্তরাজ্য সম্পর্কের বিষয়টি বোঝে এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের মতো আসাম ও নাগাল্যান্ড হলো নিম্ন অববাহিকার অঞ্চল এবং বাংলাদেশে ঢোকার আগে বরাক নদ এসব রাজ্য পেরিয়ে আসে। এই দুই রাজ্যের সরকার টিপাইমুখ প্রকল্পে আপত্তি তো করেইনি, বরং একে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ, তারা এ থেকে বন্যা ও খরা মোকাবিলা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের সুফল পাবে।
‘প্রমোটারস এগ্রিমেন্ট বিটুইন গভর্নমেন্ট অব মণিপুর, এনএইচপিসি লিমিটেড অ্যান্ড সাটলেজ জলবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড’-এর মধ্যে ২২ অক্টোবর, ২০১১ তারিখে সম্পাদিত চুক্তিটির লক্ষ্য হলো একটি যৌথ বিনিয়োগ (Joint venture) কোম্পানি গঠন করা। তারা আশা করছে, সরকারি অনুমোদন পাওয়ার ৮৭ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি সমাপ্ত হবে। প্রকল্পের তহবিল আসবে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের মাধ্যমে। এবং যত দূর জানতে পেরেছি, তহবিল এখনো জোগাড় হয়নি; এমনকি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কোনো আলোচনাও হয়নি।
বাংলাদেশ প্রতিবেশগতভাবে নাজুক এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার শিকার। যে অঞ্চলে বিপন্ন জনগোষ্ঠী ও প্রাণিকুল দ্রুত গতিতে প্রাকৃতিক আবাসস্থল হারানোর চাপে রয়েছে, সেখানে প্রাণবৈচিত্র্যের গুরুত্ব কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। ভারতের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এ বিষয়ে গবেষণাকর্ম পরিচালনা এবং নীতি প্রণয়নে নিরলস কাজ করছে। আমাদের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোরও উচিত দুই দেশের স্বার্থেই এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সম্পূর্ণভাবে বোঝা এবং তার সুরক্ষার জন্য যৌথভাবে কাজ করা।
বাংলাদেশে এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সজাগ। আমরা জেনেছি, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৪০ মাইল দূরে এবং এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে এর কারণে পরিবেশগত প্রভাব যেমন—বন্যা, ভূমির জলমগ্নতা, মানুষের বসতি স্থানান্তর, জীবন-জীবিকার পরিবর্তন এবং বন্য প্রাণিকুলের আবাসস্থলের ধ্বংস ইত্যাদি ঘটলে তা ঘটবে প্রধানত ভারতের ভূখণ্ডের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে দূরত্বের কারণে বাংলাদেশের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় একটি বিরাট আকারের জলাধার নির্মাণের কারণে সিলেট অঞ্চলে সম্ভাব্য ঝুঁকি বিষয়ে আমাদের নিঃসন্দেহে ভাবিয়ে তোলে। তবে এটাও মনে হয় না যে ভারতের সরকার পর্যাপ্ত অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনা ছাড়া মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও আসামে তাদের নিজেদের নাগরিকদের জীবন ও বসতিকে বিপন্ন করে ঝুঁকি নিতে চাইবে। মানচিত্রের দিকে তাকালেই পরিষ্কার হবে (বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রস্তাবিত প্রকল্পের দূরত্বের কারণে), আমাদের ঝুঁকি অনেক কম। ভারত সরকারের জন্য এটাও জরুরি যে, এমনভাবে প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন নিশ্চিত করতে হবে, যেন তা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারে।
বরাক একটি আন্তর্জাতিক নদ; এবং নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বার্থ ও উদ্বেগ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমি ও ড. মসিউর রহমান দিল্লিতে আমাদের হাইকমিশনারকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকজন ভারতীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থ, বিদ্যুৎ, গ্রাম উন্নয়ন ও পানিসম্পদমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। আমাদের আলোচনা ছিল খোলাখুলি, অকপট ও আন্তরিক। এবং আমরা আশ্বস্ত হয়েছি যে আমাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা কোনোভাবেই বিঘ্নিত হবে না। নির্দিষ্টভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আমাদের আবারও নিশ্চিত করেছেন:
শারম এল শেখ (২০০৯), দিল্লি (২০১০) এবং ঢাকায় (২০১১) দেওয়া আশ্বাস তিনি পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে টিপাইমুখে ভারত এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থের ক্ষতি হয়। আমাদের মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার চিঠির জবাবেও তিনি একই আশ্বাস দেন। [আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস সেই রাষ্ট্রের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার পাওয়ার শামিল এবং একে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়]।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্প বিষয়ে সব তথ্য আমাদের জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে পরিবেশগত প্রভাব পর্যালোচনা (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট), প্রকল্পের নকশা ও অন্যান্য; এবং বাংলাদেশ ভবিষ্যতে যেকোনো প্রতিনিধিদল কিংবা সমীক্ষাদল পাঠালে তিনি তাদেরও স্বাগত জানাবেন। [বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও বিজ্ঞানীদের উচিত এই আমন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে গভীর সমীক্ষা চালানো, যাতে আমরা নিজস্ব একটা সিদ্ধান্ত বা উপসংহারে পৌঁছাতে পারি]।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, টিপাইমুখ প্রকল্পে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ বাড়ানো হবে।
সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে বরাক নদ থেকে পানি প্রত্যাহার করা হবে না। ওই নদের ওপর ভারত সেচ বা এ ধরনের কাজে ব্যবহারের জন্য পানি প্রত্যাহারের লক্ষ্যে কোনো বাঁধ (ব্যারাজ) নির্মাণ করবে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্পের সমতাভিত্তিক অংশীদার (ইক্যুইটি পার্টনার) হওয়া এবং সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ (share) নেওয়ার আমন্ত্রণ পুনর্ব্যক্ত করেন। এতে করে (অংশীদার হলে) প্রকল্পটির সকল পর্যায়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ থাকবে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্থান করে নেওয়া নিশ্চিত হবে।
আমাদের সংগৃহীত তথ্য এবং ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া আশ্বাসের ভিত্তিতে আমাদের উচিত টিপাইমুখ প্রকল্পকে আবেগ ও রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বিযুক্ত করে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিশীলতার আলোকে বিবেচনা করা। আমাদের উচিত এই পুনর্নিশ্চয়তাকে সদিবশ্বাসে গ্রহণ করা। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের উচিত হবে নিজস্ব বৈজ্ঞানিক সমীক্ষাও চালিয়ে যাওয়া। অথবা যথার্থ হবে সুরমা ও কুশিয়ারার পানিপ্রবাহের ওপর এই প্রকল্পের ‘বিরূপ প্রভাব’ নিরূপণে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী গভীর সমীক্ষা চালানো। আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত, তা কী পরিমাণে বন্যাকে সংযত করবে এবং শুষ্ক মৌসুমে কী পরিমাণ পানিপ্রবাহ বাড়াবে, তা বের করা। আমাদের উচিত ভূমিকম্পের ফলে অথবা ড্যাম ধসের কারণে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা পরিমাপ করা; আমাদের উচিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অংশীদার হওয়া আমাদের জন্য লাভজনক হবে কি না, তার বিশ্লেষণ করা; সর্বোপরি, ভারতের সঙ্গে এমন সংলাপে জড়িত হওয়া, যাতে করে আমাদের সর্বোত্তম কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়া যায়। বিতর্কটিকে বাস্তবতায় রূপান্তর করতে প্রথমেই দরকার হলো প্রস্তাবিত প্রকল্পের স্থান ও দূরত্ব (মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর জেলা) সম্পর্কে ঠিকমতো অবহিত হওয়া এবং আসামের কাছার জেলার অন্য কোনো স্থানের সঙ্গে একে গুলিয়ে না ফেলা। এর জন্য ইস্যুটাকে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে, বেরিয়ে আসতে হবে দলীয় রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ও আবেগী অতিরঞ্জন থেকে। দলীয় ও সংকীর্ণ স্বার্থের ওপর স্থান দিতে হবে জাতীয় স্বার্থকে। ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া আশ্বাস এবং বাংলাদেশের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের উচিত সরেজমিনে অনুসন্ধানী ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়োজিত হওয়া এবং জনগণের সামনে সেসব সত্যনিষ্ঠ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা। দেশের কাছে এটাই আমাদের দায়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
গওহর রিজভী: প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা।
প্রায়ই যেমন ঘটে, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের এক পাশে সরিয়ে মঞ্চ দখল করে নেয় প্রবল কণ্ঠের পল্লবগ্রাহী আলোচকবৃন্দ। এ-বিষয়ক আলোচনা ফলত অতিশয়োক্তির রূপ পেয়েছে, অন্তঃসারশূন্য গরম কথাবার্তা দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করাই এ ক্ষেত্রে প্রধান কর্ম। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই, এই বিতর্ক থেকে অনেক বাদ-বিবাদের সৃষ্টি হলেও বিষয়টি সামান্যই খোলাসা হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকের বেলায় সত্য সন্ধানের চেষ্টার পরিবর্তে লক্ষ করা যায় দলীয় রাজনীতি ও প্রচারণা।
বাংলাদেশের আরও অনেকের মতো আমিও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। দিল্লি যাওয়ার আগে টিপাইমুখ প্রকল্পের প্রভাব বিষয়ে আমি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিজ্ঞানী, নীতিপ্রণেতা এবং ভিন্ন মত ও দলের রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আমাদের সমস্যাগুলো বুঝতে সহায়তা করেছেন এবং কোন কোন বিষয়ে আমাদের ব্যাখ্যা ও নিশ্চয়তা পাওয়া দরকার, সে বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগও জানিয়েছেন। এই সফরে আমরা ভারতের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তপ্রণেতা মুখ্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনায় আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রীও। আমরা যতটা তথ্য ও সত্য জড়ো করতে পেরেছি, এখানে সেগুলো তুলে ধরতে চাই:
টিপাইমুখ ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রস্তাবিত একটি বহুমুখী প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য দুটি: প্রথমত, এটি একটি জলবিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্প, যা ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে; এবং দ্বিতীয়ত, প্রত্যাশা অনুসারে এটি ভাটিতে বন্যা-পরিস্থিতি সহনীয় করায় ভূমিকা রাখবে।
বিজ্ঞানী ও পানিবিশারদদের মতে, এটি একটি গতিশীল জলপ্রবাহ (run-of-the-river) প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ড্যামের মধ্যে অথবা জলাধারে মজুদ পানি অবিরাম ছাড়তে হবে। এর ফলে ভারী বন্যার মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রেখেও নিচের সমতলে বন্যাক্রান্ত হওয়া প্রশমনে পানি ছাড়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশে বরাক নদের দুটি শাখা সুরমা ও কুশিয়ারার পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়। কারণ, এই প্রকল্পে পানি প্রত্যাহার বা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে না। জলাধারসহ ড্যাম কার্যত শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ বাড়ায় আর বর্ষায় পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।
এটি ভাটি অঞ্চলে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে কেবল তখনই, যদি সেচ ও অন্যান্য প্রয়োজনে পানি অন্যত্র টেনে নেওয়া হয়। মণিপুরের রাজ্য সরকার এবং ভারতের ন্যাশনাল পাওয়ার করপোরেশনের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে বাঁধ (ব্যারাজ) নির্মাণ কিংবা বরাক নদ থেকে পানি প্রত্যাহারের কোনো শর্ত বা ধারা নেই। ভারতের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই নদীর পানির হিস্যা এবং পানিবণ্টন জটিল সমস্যা এবং রাজ্যে রাজ্যে বিরোধের একটা উৎস। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত সরকার তাদের আন্তরাজ্য সম্পর্কের বিষয়টি বোঝে এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের মতো আসাম ও নাগাল্যান্ড হলো নিম্ন অববাহিকার অঞ্চল এবং বাংলাদেশে ঢোকার আগে বরাক নদ এসব রাজ্য পেরিয়ে আসে। এই দুই রাজ্যের সরকার টিপাইমুখ প্রকল্পে আপত্তি তো করেইনি, বরং একে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ, তারা এ থেকে বন্যা ও খরা মোকাবিলা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের সুফল পাবে।
‘প্রমোটারস এগ্রিমেন্ট বিটুইন গভর্নমেন্ট অব মণিপুর, এনএইচপিসি লিমিটেড অ্যান্ড সাটলেজ জলবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড’-এর মধ্যে ২২ অক্টোবর, ২০১১ তারিখে সম্পাদিত চুক্তিটির লক্ষ্য হলো একটি যৌথ বিনিয়োগ (Joint venture) কোম্পানি গঠন করা। তারা আশা করছে, সরকারি অনুমোদন পাওয়ার ৮৭ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি সমাপ্ত হবে। প্রকল্পের তহবিল আসবে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের মাধ্যমে। এবং যত দূর জানতে পেরেছি, তহবিল এখনো জোগাড় হয়নি; এমনকি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কোনো আলোচনাও হয়নি।
বাংলাদেশ প্রতিবেশগতভাবে নাজুক এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার শিকার। যে অঞ্চলে বিপন্ন জনগোষ্ঠী ও প্রাণিকুল দ্রুত গতিতে প্রাকৃতিক আবাসস্থল হারানোর চাপে রয়েছে, সেখানে প্রাণবৈচিত্র্যের গুরুত্ব কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। ভারতের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এ বিষয়ে গবেষণাকর্ম পরিচালনা এবং নীতি প্রণয়নে নিরলস কাজ করছে। আমাদের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোরও উচিত দুই দেশের স্বার্থেই এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সম্পূর্ণভাবে বোঝা এবং তার সুরক্ষার জন্য যৌথভাবে কাজ করা।
বাংলাদেশে এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সজাগ। আমরা জেনেছি, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৪০ মাইল দূরে এবং এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে এর কারণে পরিবেশগত প্রভাব যেমন—বন্যা, ভূমির জলমগ্নতা, মানুষের বসতি স্থানান্তর, জীবন-জীবিকার পরিবর্তন এবং বন্য প্রাণিকুলের আবাসস্থলের ধ্বংস ইত্যাদি ঘটলে তা ঘটবে প্রধানত ভারতের ভূখণ্ডের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে দূরত্বের কারণে বাংলাদেশের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় একটি বিরাট আকারের জলাধার নির্মাণের কারণে সিলেট অঞ্চলে সম্ভাব্য ঝুঁকি বিষয়ে আমাদের নিঃসন্দেহে ভাবিয়ে তোলে। তবে এটাও মনে হয় না যে ভারতের সরকার পর্যাপ্ত অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনা ছাড়া মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও আসামে তাদের নিজেদের নাগরিকদের জীবন ও বসতিকে বিপন্ন করে ঝুঁকি নিতে চাইবে। মানচিত্রের দিকে তাকালেই পরিষ্কার হবে (বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রস্তাবিত প্রকল্পের দূরত্বের কারণে), আমাদের ঝুঁকি অনেক কম। ভারত সরকারের জন্য এটাও জরুরি যে, এমনভাবে প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন নিশ্চিত করতে হবে, যেন তা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারে।
বরাক একটি আন্তর্জাতিক নদ; এবং নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বার্থ ও উদ্বেগ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমি ও ড. মসিউর রহমান দিল্লিতে আমাদের হাইকমিশনারকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকজন ভারতীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থ, বিদ্যুৎ, গ্রাম উন্নয়ন ও পানিসম্পদমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। আমাদের আলোচনা ছিল খোলাখুলি, অকপট ও আন্তরিক। এবং আমরা আশ্বস্ত হয়েছি যে আমাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা কোনোভাবেই বিঘ্নিত হবে না। নির্দিষ্টভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আমাদের আবারও নিশ্চিত করেছেন:
শারম এল শেখ (২০০৯), দিল্লি (২০১০) এবং ঢাকায় (২০১১) দেওয়া আশ্বাস তিনি পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে টিপাইমুখে ভারত এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থের ক্ষতি হয়। আমাদের মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার চিঠির জবাবেও তিনি একই আশ্বাস দেন। [আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস সেই রাষ্ট্রের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার পাওয়ার শামিল এবং একে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়]।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্প বিষয়ে সব তথ্য আমাদের জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে পরিবেশগত প্রভাব পর্যালোচনা (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট), প্রকল্পের নকশা ও অন্যান্য; এবং বাংলাদেশ ভবিষ্যতে যেকোনো প্রতিনিধিদল কিংবা সমীক্ষাদল পাঠালে তিনি তাদেরও স্বাগত জানাবেন। [বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও বিজ্ঞানীদের উচিত এই আমন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে গভীর সমীক্ষা চালানো, যাতে আমরা নিজস্ব একটা সিদ্ধান্ত বা উপসংহারে পৌঁছাতে পারি]।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, টিপাইমুখ প্রকল্পে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ বাড়ানো হবে।
সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে বরাক নদ থেকে পানি প্রত্যাহার করা হবে না। ওই নদের ওপর ভারত সেচ বা এ ধরনের কাজে ব্যবহারের জন্য পানি প্রত্যাহারের লক্ষ্যে কোনো বাঁধ (ব্যারাজ) নির্মাণ করবে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্পের সমতাভিত্তিক অংশীদার (ইক্যুইটি পার্টনার) হওয়া এবং সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ (share) নেওয়ার আমন্ত্রণ পুনর্ব্যক্ত করেন। এতে করে (অংশীদার হলে) প্রকল্পটির সকল পর্যায়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ থাকবে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্থান করে নেওয়া নিশ্চিত হবে।
আমাদের সংগৃহীত তথ্য এবং ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া আশ্বাসের ভিত্তিতে আমাদের উচিত টিপাইমুখ প্রকল্পকে আবেগ ও রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বিযুক্ত করে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিশীলতার আলোকে বিবেচনা করা। আমাদের উচিত এই পুনর্নিশ্চয়তাকে সদিবশ্বাসে গ্রহণ করা। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের উচিত হবে নিজস্ব বৈজ্ঞানিক সমীক্ষাও চালিয়ে যাওয়া। অথবা যথার্থ হবে সুরমা ও কুশিয়ারার পানিপ্রবাহের ওপর এই প্রকল্পের ‘বিরূপ প্রভাব’ নিরূপণে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী গভীর সমীক্ষা চালানো। আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত, তা কী পরিমাণে বন্যাকে সংযত করবে এবং শুষ্ক মৌসুমে কী পরিমাণ পানিপ্রবাহ বাড়াবে, তা বের করা। আমাদের উচিত ভূমিকম্পের ফলে অথবা ড্যাম ধসের কারণে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা পরিমাপ করা; আমাদের উচিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অংশীদার হওয়া আমাদের জন্য লাভজনক হবে কি না, তার বিশ্লেষণ করা; সর্বোপরি, ভারতের সঙ্গে এমন সংলাপে জড়িত হওয়া, যাতে করে আমাদের সর্বোত্তম কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়া যায়। বিতর্কটিকে বাস্তবতায় রূপান্তর করতে প্রথমেই দরকার হলো প্রস্তাবিত প্রকল্পের স্থান ও দূরত্ব (মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর জেলা) সম্পর্কে ঠিকমতো অবহিত হওয়া এবং আসামের কাছার জেলার অন্য কোনো স্থানের সঙ্গে একে গুলিয়ে না ফেলা। এর জন্য ইস্যুটাকে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে, বেরিয়ে আসতে হবে দলীয় রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ও আবেগী অতিরঞ্জন থেকে। দলীয় ও সংকীর্ণ স্বার্থের ওপর স্থান দিতে হবে জাতীয় স্বার্থকে। ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া আশ্বাস এবং বাংলাদেশের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের উচিত সরেজমিনে অনুসন্ধানী ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়োজিত হওয়া এবং জনগণের সামনে সেসব সত্যনিষ্ঠ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা। দেশের কাছে এটাই আমাদের দায়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
গওহর রিজভী: প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা।
No comments