প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফর প্রসঙ্গে by বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই অবনতির অর্থ দুই দেশের সরকারের সম্পর্কের অবনতি, তাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও মৈত্রীর অবনতি নয়। এ অবনতির অর্থ হলো বাংলাদেশের জাতীয় ও জনগণের স্বার্থ ভারতীয় বড় পুঁজির পদতলে জলাঞ্জলি দেয়া।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান মহাজোট সরকার এ কাজটিই এখন অতি নিষ্ঠার সঙ্গে করছে। এ কারণে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতীয় শাসক-শ্রেণী ও তাদের সরকারের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। একটি সম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে ভারতের শাসক-শ্রেণী আগের যে কোনো সময়ের থেকে এখন বেশ খোলাখুলিভাবে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের জনগণের শোষক ও নির্যাতকে।
বাংলাদেশের মতো একটি শ্রেণীবিভক্ত ও লুম্পেন বুর্জোয়া শাসিত দেশের ওপর ভারতের মতো শক্তিশালী বুর্জোয়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রভাব ও হুকুমদারি কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এটা সম্ভব হতো না যদি এ দেশের শাসক-শ্রেণী হতো জাতীয় বুর্জোয়া চরিত্রসম্পন্ন এবং নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তিধর। বাংলাদেশ যে সে রকম কোনো শ্রেণী দ্বারা শাসিত হচ্ছে না এটা বলাই বাহুল্য। ১৯৭২ সালে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে লুণ্ঠনকারী একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে একদিকে জনগণের ওপর শাসন-নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে এবং অন্যদিকে দেশীয় স্বার্থ একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে জলাঞ্জলি দিয়ে জনগণ ও দেশের সর্বনাশ করেছে। এই সর্বনাশের সর্বশেষ চিত্রই এখন আমরা দেখছি।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতাপ ও আধিপত্যই সব থেকে প্রবল। আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরই ভারতের স্থান। এ কারণে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষতির পাল্লা ভারি এবং এই পাল্লা নিয়মিতভাবে আরও ভারি হচ্ছে।
এক্ষেত্রে টিপাইমুখ বাঁধের কথা প্রাসঙ্গিক। এই বাঁধ এমনই সর্বনাশা যে এর দ্বারা শুধু যে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা-ই নয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মণিপুর ইত্যাদি অঞ্চলের জনগণ এবং পরিবেশেরও দারুণ ক্ষতি হবে। কিন্তু ভারতীয় বড় পুঁজি যেমন প্রতিবেশী বাংলাদেশের জনগণের ও এখানকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো পরোয়া করে না, তেমনি তারা পরোয়া করে না নিজেদের দেশের সাধারণ মানুষ এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর স্বার্থহানির। ফারাক্কা বাঁধ হওয়ার সময় বাংলাদেশ সরকার তার বিরোধিতা করেছিল, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পর্যন্ত লংমার্চ হয়েছিল। টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা বাঁধের মতোই ক্ষতির কারণ হবে, কিন্তু লক্ষ করার বিষয় এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ সরকারের পক্ষ থেকে হচ্ছে না, যা কিছু হচ্ছে সেটা আওয়ামী ঘরানার বাইরে অন্য রাজনৈতিক দল, গ্রুপ বা ব্যক্তিদের দ্বারা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার প্রতিবাদের পরিবর্তে এই বাঁধের সুফল নিয়ে অনেক কথা বলছে। এ বাঁধ হলে যে বাংলাদেশ খুব উপকৃত হবে এটা তাদের মুখপাত্ররা ফলাও করে বলছেন।
বাংলাদেশ সরকারের এই অবস্থা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কী ধরনের লোকদের দ্বারা, কোন শ্রেণীর দ্বারা, কোন স্বার্থের প্রতিনিধিদের দ্বারা এদেশ এখন শাসিত হচ্ছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে সেই প্রতিশ্রুতির একটিও তারা কার্যকর না করে প্রত্যেকটির উল্টো কাজই করছে। ক্রসফায়ার বন্ধ থেকে নিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ পর্যন্ত একই ব্যাপার। এদের শাসন এখন দাঁড়িয়েছে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি শক্তির পদলেহীদের এবং দেশীয় শোষক-লুণ্ঠনকারীদের শাসনে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দিনবদলের আওয়াজ দিয়েছিল। এদিক দিয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি তারা পূরণ করেছে। তবে এ দিনবদল জনগণের নয়। এটা হলো তাদের নিজেদের দল, পরিবার ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের। তাদের দিনবদল হয়েছে। তারা এখন সব রকম সুযোগ-সুবিধার ভাগীদার হয়ে দেশের জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে।
এই কাঁঠাল ভাঙার কাজ করতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আগামী জানুয়ারি মাসে ভারত সফরে যাচ্ছেন। তিনি কতকগুলো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সেখানে স্বাক্ষর করবেন। এইসব মামুলি চুক্তির বাইরে যেসব সমস্যা আজ দেশের ও জনগণের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত সেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা অথবা চুক্তি হবে এমন কোনো আভাস সরকারের পক্ষ থেকেও নেই। উপরন্তু ভারতে গিয়ে তাদের খয়ের খাঁ হিসেবে নিজের অবস্থানকে আরও মসৃণ করার জন্য আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করা উত্তর-পূর্ব ভারতের উলফাসহ অন্য রাজনৈতিক দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে গ্রেফতার করে গোপনে তাদের ভারত সীমান্তে নিয়ে গিয়ে তাদের সামরিক বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এটা যে এক বড় কেলেঙ্কারি এতে সন্দেহ নেই। এই কেলেঙ্কারি আরও কুিসত হয়েছে বাংলাদেশের প্রশাসন, বিশেষত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একের পর এক মিথ্যা ভাষণে। উলফা নেতা রাজখোয়াসহ অন্যদের গ্রেফতার ও তাদের ভারতের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে তিনি একের পর এক অনেক মিথ্যা বলেছেন। অবশেষে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে এর সংবাদ প্রকাশ ও ভারত সরকার বাংলাদেশ কর্তৃক ধৃত ভারতীয় নাগরিকদের ভারতের হাতে সমর্পণ করার সত্যতা স্বীকার করার পর বাংলাদেশ সরকারও বাধ্য হয়ে এটা স্বীকার করেছে। এ মিথ্যাচারকে বড় ধরনের সরকারি কেলেঙ্কারি ছাড়া আর কীভাবে আখ্যায়িত করা যায়?
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ, তিস্তার পানি বণ্টন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ, নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা, বাণিজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘাটতি কমিয়ে আনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এমন কোনো কথা নেই। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ভারত থেকে একশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কেনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। এর আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা করে দিলে তারা অনায়াসেই এর থেকে অনেক বেশি পরিমাণ বিদ্যুত্ দেশেই উত্পাদন করতে পারেন। তাছাড়া সে ক্ষেত্রে ভারত থেকে বিদ্যুত্ নিয়ে আসার জন্য ঝামেলারও দরকার হয় না। কিন্তু এ পথ বাংলাদেশ সরকারের পথ নয়। দেশে বিদ্যুত্ উত্পাদন করার থেকে ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানি করে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের কথা প্রচার করাতেই এদের উত্সাহ বেশি।
এই সফরে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে আসল কাজটি করবেন বলে মনে হচ্ছে তা হলো, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ না করে নিশ্চুপ থাকা অথবা এর দ্বারা বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এটাই সরকারিভাবে বলার ব্যাপারে সমঝোতা, ভারতের জন্য অনুকূল শর্তে তাদের বাংলাদেশে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে কোনো নড়াচড়া না করা ইত্যাদি বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতা। আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী ভারত সরকারকে এসব সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে তারা তাকে অনেকভাবে পুরস্কৃত করছে, যার মধ্যে মেডেল ইত্যাদি প্রদান অন্যতম। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই ঢেঁড়ি পেটানো সফরের এটাই হলো মুখ্য দিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে অধীনতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার অন্য একটি দিক হলো, এই দুই রাষ্ট্রের সাহায্য ও সমর্থন লাভ করে এদেশে এক ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা চালু রাখা। বর্তমান সরকার দেশের জনগণের বিভিন্ন অংশের ওপর যে ফ্যাসিবাদী নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, ক্রসফায়ারের মতো বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড করছে, মিটিং-মিছিল ইত্যাদি বিষয়ে যেসব বিধিনিষেধ জারি রেখেছে, লুটতরাজের রাজত্ব যেভাবে কায়েম রেখেছে সেটা শুধু এদের নিজেদের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য বাইরের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের শক্তির জোগান দরকার। এই জোগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত সরকার ভালোভাবেই দিচ্ছে। এ জন্য এ দুই দেশ শুধু সরকারি লোকজন নয়, বেসরকারি জনশত্রুদেরও অনেক সম্মানে ভূষিত করে তাদের হাত মজবুত করছে। এই জনশত্রুরা নিজের দেশের ও জনগণের নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সরকারের স্বার্থে কাজ করার জন্যই তারা বাংলাদেশে তাদের অবস্থান জোরদার করছে। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক মুহাম্মদ ইউনূস সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত এই বেসরকারি লোকদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় একজন। সরকারি কর্তাব্যক্তি ছাড়া বেসকারি লোকদের এই পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের কারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা শুূধু সরকারি পর্যায়েই নয়, বেসরকারি পর্যায়েও দেশের বিভিন্ন অংশের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার ও বজায় রাখতে চায়। সমগ্র দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত করে সমাজের গভীর দেশ পর্যন্ত নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য তারা এভাবে যা কিছু করা দরকার সবই করে থাকে। সরকারি এবং এই ধরনের বেসরকারি লোক ও তাদের সংগঠন অভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধা থাকার কারণে তারা পরস্পরেরও মিত্র। হাত ধরাধরি করেই তারা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সরকারের দালাল হিসেবে কাজ করে। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, এ কারণেই সরকার সাম্রাজ্যবাদী বৈদেশিক রাষ্ট্রের দালাল হিসেবে কাজ করলে তার কোনো প্রতিবাদ না করে নিশ্চুপ থেকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সোচ্চার সমর্থন জ্ঞাপন করে তারা সরকারকে সাহায্য করে। মার্কিন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অধীনতামূলক সম্পর্ক এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল না রাখলে বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও বিপজ্জনক দিক সম্পর্কে কোনো সঠিক ধারণা সম্ভব নয়।
No comments