রূপপুর পরমাণু প্রকল্প-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: বিলাসী ও আত্মঘাতী by মাহা মীর্জা
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে একটি সমস্যাজনক চুক্তি! বলা হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বহুল বিতর্কিত এই চুক্তিটির ফলে আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে প্রাথমিকভাবে যুক্ত হবে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ! আপাতদৃষ্টিতে সুসংবাদ! আসলেই কি তাই?
আন্তর্জাতিক গবেষকেরা বরাবরই বলে আসছেন নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি এখনো পর্যন্ত শতভাগ নিরাপদ কোনো প্রযুক্তি নয়। সেই দিক থেকে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত, দরিদ্র, দুর্যোগপ্রবণ, ঘনবসতিপূর্ণ ও ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে এ ধরনের স্থাপনা কতটা বিপজ্জনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন একটি মহতী প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই দুর্ঘটনার কথা আসছে কেন? পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। কেবলমাত্র চেরনোবিল বা ফুকুশিমাই নয়, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো পারমাণবিক প্রযুক্তির বাঘা বাঘা দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি পারমাণবিককেন্দ্রেই দুর্ঘটনার নজির আছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৭টি ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুধু ভারতের পারমাণবিককেন্দ্রগুলোতেই মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে শ খানেকের বেশি বিপজ্জনক পরিস্থিতি শনাক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ভারতের দুটি পারমাণবিক স্থাপনা প্রায় দুবছর সময় বন্ধ থাকারও নজির আছে।
২ নভেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরকালে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী তিনি বলেছেন, রুপপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনায় তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবহূত হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা মোকাবিলায় সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহূত হবে, তাই দুর্যোগের সম্ভাবনা থাকছে না। অকাট্য যুক্তি! যেখানে প্রযুক্তির এভারেস্ট শৃঙ্গে বিচরণকারী জাপান তার সব সম্পদ, দক্ষ জনবল এবং তৃতীয় প্রজন্মের সব কারিগরি বিদ্যা দিয়েও পানি, জমি ও বাতাসে ব্যাপক হারে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে পারেনি, যেখানে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে জার্মানি তাদের পুরোনো সাতটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ কোন ছার। ২০২২ সালের মধ্যে ধীরে ধীরে সবকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছেন, রুপপুরের কেন্দ্রটিতে ১০ রিখটার স্কেলের অধিক পর্যন্ত ভূমিকম্প সামাল দেওয়ার মতো কাঠামো রাখা হবে। অথচ ফুকুশিমার অভিজ্ঞতা বলে, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিরোধক প্রযুক্তির শীর্ষ অবস্থানে থাকা জাপান ৯ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পই সামাল দিতে পারেনি!
পাবনা থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১২২ কিলোমিটার। জাপানের ফুকুশিমা থেকে রাজধানী টোকিওর দূরত্ব প্রায় ২৪০ কিলোমিটার হওয়া সত্ত্বেও সেখানে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক দিন। কাজেই রুপপুরে সে রকম দুর্ঘটনা ঘটলে শুধু ঢাকাই নয়, বাংলাদেশের স্থল, জল ও বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগার কথা কি?
উল্লেখ্য, ভারতে গত ২০ বছর ধরে চলছে পারমাণবিক চুক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে সাম্প্রতিককালে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তির আওতায় প্রস্তাবিত মোট পাঁচটি পারমাণবিক স্থাপনার একটি পশ্চিমবঙ্গের হরিপুরে হওয়ার কথা থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রসরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁর সরকার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে দেবে না। এ ছাড়া মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতেও চলছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ। পাবলিক লিটিগেশনের আওতায় এবিষয়ক একটি মামলাও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন আছে।
উল্লেখ্য, এক হাজার মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে খরচ পড়বে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় এককালীন বিনিয়োগ বিপুল হলেও পরে এর উৎপাদন খরচ কম এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি লাভজনক। অথচ এ ধরনের একটি অত্যাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী মেরামত-সম্পর্কিত খরচের বিষয়টি এখানে চেপে যাওয়া হয়েছে। ভারতে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত মোট ছয়টি বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পারমাণবিককেন্দ্রগুলোর মেরামত বাবদ ব্যয় হয়েছে মোট ৯০০ মিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, কয়লা বা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক বেশি। বলাবাহুল্য, রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও ছোট-বড় যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মেরামতের জন্য প্রয়োজন বিপুল অঙ্কের অর্থ, গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো তা বাংলাদেশ সরকারকেই বহন করতে হবে।
প্রতিমন্ত্রীর মতে, রুপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল হবে ৬০ বছর এবং ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করলে নাকি আরও ২০ বছর চলবে! অথচ খোদ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় সাড়ে চার শটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় আয়ু ২০ থেকে ২৫ বছর। ইউরোপে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ২৫ থেকে ৩০ বছর পর পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্থাপনাগুলো ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। তার মানে দেখা যাচ্ছে, রুপপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে বিদ্যুৎ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে দেখাতে এর মেয়াদকাল প্রায় দ্বিগুণ বলে মিথ্যা প্রবোধ দেওয়া হচ্ছে। অতএব পারমাণবিক বিদ্যুৎই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এবং এর উৎপাদন অর্থ সাশ্রয়ী, এ ধারণাগুলো ধোপে টেকে না।
অথচ অনেকেই প্রস্তাব করেছিলেন একবারে দেড় বিলিয়ন ডলার দিয়ে একটি পারমাণবিককেন্দ্র স্থাপন না করে কয়লাভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হোক। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ যদিও বেশি, এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের এককালীন বিনিয়োগের পরিমাণ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় অর্ধেক। এ দেশে কয়লার মজুদ থাকলেও কয়লা উত্তোলন নীতির বিষয়টি এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যত দিন পর্যন্ত একটি পরিবেশ ও কৃষিবান্ধব সুষম কয়লা উত্তোলন নীতি প্রণীত না হয়, তত দিন ভারত থেকে কয়লা আমদানির বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই সমাধানের কথা যদি বলতেই হয়, সে ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
একটি অঞ্চলের মানুষ, তার জীবনযাত্রা, তার জীবিকা, তার কৃষি, মৎস্য, গাছপালার সঙ্গে সম্পর্কবিহীন ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ দানবাকৃতির বিশাল উন্নয়ন প্রকল্পের ধারণাকে অনেক আগে থেকেই চ্যালেঞ্জ করে আসছেন পরিবেশবিদেরা। উন্নয়নের নতুন ধারণায় ঠাঁই পেয়েছে মানুষের কাছাকাছি থাকা পরিবেশবান্ধব, কৃষিবান্ধব, কেন্দ্র-অনির্ভর, অঞ্চলভিত্তিক এবং কমিউনিটিভিত্তিক টেকসই ছোট ছোট প্রকল্প। মোদ্দাকথা হলো, এত বিপুল অঙ্কের অর্থ যদি বিনিয়োগ করতেই হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানই যদি হয় লক্ষ্য, সে ক্ষেত্রে একটি ভয়ংকর বিপজ্জনক প্রযুক্তির বদলে পুরোপুরি নিরাপদ এবং নবায়নযোগ্য, ছোট-বড়, মাঝারি বিভিন্ন ধরনের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। সত্য যে সৌরবিদ্যুতের ক্ষমতা সীমিত এবং কলকারখানার উৎপাদন বা একটি মেট্রোপলিটন নগরের প্রয়োজন বর্তমানের সৌরবিদ্যুৎ প্রযুক্তি দিয়ে পূরণ সম্ভব নয়। কিন্তু সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে পিছিয়ে থাকা গ্রামাঞ্চলে আলো পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। নগরজীবনের হালকা প্রয়োজন মিটিয়ে জাতীয় গ্রিডের ওপর থেকে চাপ কমানো সম্ভব।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালেই শুধু সৌর প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ (সাতটি রুপপুর প্রকল্পের সমান) উৎপাদন করে নতুন বিশ্ব রেকর্ড করেছে জার্মানি। অতএব একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থাপনা এবং বণ্টনে সরকারকে কৌশলী হতে হবে। নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন বিদ্যুৎ চাহিদার এক চতুর্থাংশও যেন সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়, এমন অবকাঠামোতেই বিনিয়োগ করতে হবে। পারমাণবিক শক্তিকে বলা হয় ‘আনফরগিভিং টেকনোলজি’ বা নির্দয় প্রযুক্তি। এটি আমাদের জন্য নয়।
মাহা মীর্জা: পিএইচডি শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগ, বিলেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি।
২ নভেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরকালে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী তিনি বলেছেন, রুপপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনায় তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবহূত হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা মোকাবিলায় সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহূত হবে, তাই দুর্যোগের সম্ভাবনা থাকছে না। অকাট্য যুক্তি! যেখানে প্রযুক্তির এভারেস্ট শৃঙ্গে বিচরণকারী জাপান তার সব সম্পদ, দক্ষ জনবল এবং তৃতীয় প্রজন্মের সব কারিগরি বিদ্যা দিয়েও পানি, জমি ও বাতাসে ব্যাপক হারে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে পারেনি, যেখানে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে জার্মানি তাদের পুরোনো সাতটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ কোন ছার। ২০২২ সালের মধ্যে ধীরে ধীরে সবকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছেন, রুপপুরের কেন্দ্রটিতে ১০ রিখটার স্কেলের অধিক পর্যন্ত ভূমিকম্প সামাল দেওয়ার মতো কাঠামো রাখা হবে। অথচ ফুকুশিমার অভিজ্ঞতা বলে, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিরোধক প্রযুক্তির শীর্ষ অবস্থানে থাকা জাপান ৯ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পই সামাল দিতে পারেনি!
পাবনা থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১২২ কিলোমিটার। জাপানের ফুকুশিমা থেকে রাজধানী টোকিওর দূরত্ব প্রায় ২৪০ কিলোমিটার হওয়া সত্ত্বেও সেখানে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক দিন। কাজেই রুপপুরে সে রকম দুর্ঘটনা ঘটলে শুধু ঢাকাই নয়, বাংলাদেশের স্থল, জল ও বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগার কথা কি?
উল্লেখ্য, ভারতে গত ২০ বছর ধরে চলছে পারমাণবিক চুক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে সাম্প্রতিককালে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তির আওতায় প্রস্তাবিত মোট পাঁচটি পারমাণবিক স্থাপনার একটি পশ্চিমবঙ্গের হরিপুরে হওয়ার কথা থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রসরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁর সরকার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে দেবে না। এ ছাড়া মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতেও চলছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ। পাবলিক লিটিগেশনের আওতায় এবিষয়ক একটি মামলাও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন আছে।
উল্লেখ্য, এক হাজার মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে খরচ পড়বে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় এককালীন বিনিয়োগ বিপুল হলেও পরে এর উৎপাদন খরচ কম এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি লাভজনক। অথচ এ ধরনের একটি অত্যাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী মেরামত-সম্পর্কিত খরচের বিষয়টি এখানে চেপে যাওয়া হয়েছে। ভারতে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত মোট ছয়টি বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পারমাণবিককেন্দ্রগুলোর মেরামত বাবদ ব্যয় হয়েছে মোট ৯০০ মিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, কয়লা বা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক বেশি। বলাবাহুল্য, রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও ছোট-বড় যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মেরামতের জন্য প্রয়োজন বিপুল অঙ্কের অর্থ, গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো তা বাংলাদেশ সরকারকেই বহন করতে হবে।
প্রতিমন্ত্রীর মতে, রুপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল হবে ৬০ বছর এবং ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করলে নাকি আরও ২০ বছর চলবে! অথচ খোদ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় সাড়ে চার শটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় আয়ু ২০ থেকে ২৫ বছর। ইউরোপে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ২৫ থেকে ৩০ বছর পর পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্থাপনাগুলো ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। তার মানে দেখা যাচ্ছে, রুপপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে বিদ্যুৎ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে দেখাতে এর মেয়াদকাল প্রায় দ্বিগুণ বলে মিথ্যা প্রবোধ দেওয়া হচ্ছে। অতএব পারমাণবিক বিদ্যুৎই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এবং এর উৎপাদন অর্থ সাশ্রয়ী, এ ধারণাগুলো ধোপে টেকে না।
অথচ অনেকেই প্রস্তাব করেছিলেন একবারে দেড় বিলিয়ন ডলার দিয়ে একটি পারমাণবিককেন্দ্র স্থাপন না করে কয়লাভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হোক। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ যদিও বেশি, এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের এককালীন বিনিয়োগের পরিমাণ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় অর্ধেক। এ দেশে কয়লার মজুদ থাকলেও কয়লা উত্তোলন নীতির বিষয়টি এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যত দিন পর্যন্ত একটি পরিবেশ ও কৃষিবান্ধব সুষম কয়লা উত্তোলন নীতি প্রণীত না হয়, তত দিন ভারত থেকে কয়লা আমদানির বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই সমাধানের কথা যদি বলতেই হয়, সে ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
একটি অঞ্চলের মানুষ, তার জীবনযাত্রা, তার জীবিকা, তার কৃষি, মৎস্য, গাছপালার সঙ্গে সম্পর্কবিহীন ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ দানবাকৃতির বিশাল উন্নয়ন প্রকল্পের ধারণাকে অনেক আগে থেকেই চ্যালেঞ্জ করে আসছেন পরিবেশবিদেরা। উন্নয়নের নতুন ধারণায় ঠাঁই পেয়েছে মানুষের কাছাকাছি থাকা পরিবেশবান্ধব, কৃষিবান্ধব, কেন্দ্র-অনির্ভর, অঞ্চলভিত্তিক এবং কমিউনিটিভিত্তিক টেকসই ছোট ছোট প্রকল্প। মোদ্দাকথা হলো, এত বিপুল অঙ্কের অর্থ যদি বিনিয়োগ করতেই হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানই যদি হয় লক্ষ্য, সে ক্ষেত্রে একটি ভয়ংকর বিপজ্জনক প্রযুক্তির বদলে পুরোপুরি নিরাপদ এবং নবায়নযোগ্য, ছোট-বড়, মাঝারি বিভিন্ন ধরনের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। সত্য যে সৌরবিদ্যুতের ক্ষমতা সীমিত এবং কলকারখানার উৎপাদন বা একটি মেট্রোপলিটন নগরের প্রয়োজন বর্তমানের সৌরবিদ্যুৎ প্রযুক্তি দিয়ে পূরণ সম্ভব নয়। কিন্তু সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে পিছিয়ে থাকা গ্রামাঞ্চলে আলো পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। নগরজীবনের হালকা প্রয়োজন মিটিয়ে জাতীয় গ্রিডের ওপর থেকে চাপ কমানো সম্ভব।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালেই শুধু সৌর প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ (সাতটি রুপপুর প্রকল্পের সমান) উৎপাদন করে নতুন বিশ্ব রেকর্ড করেছে জার্মানি। অতএব একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থাপনা এবং বণ্টনে সরকারকে কৌশলী হতে হবে। নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন বিদ্যুৎ চাহিদার এক চতুর্থাংশও যেন সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়, এমন অবকাঠামোতেই বিনিয়োগ করতে হবে। পারমাণবিক শক্তিকে বলা হয় ‘আনফরগিভিং টেকনোলজি’ বা নির্দয় প্রযুক্তি। এটি আমাদের জন্য নয়।
মাহা মীর্জা: পিএইচডি শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগ, বিলেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি।
No comments