সহজিয়া কড়চা-স্বাধীনতার ৪০ বছর: একটি অনন্য উপলক্ষ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
২০০৫-এর শেষ বা ২০০৬-এর প্রথম দিকে রাজনৈতিক ইতিহাসের দুই স্বনামধন্য শিক্ষককে বললাম, মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ এবার। এ উপলক্ষে কিছু হওয়া দরকার। লেখালেখি, আলোচনা সভা, সেমিনার প্রভৃতি হতে পারে।
তাঁরা উভয়েই অবাক হলেন। ভাব এ রকম যে, বলে কী লোকটা। মনোভাব গোপন না করে যা বললেন তা সংক্ষেপে এ রকম: আপনার মধ্যে এই পাকিস্তান-মার্কা বুদ্ধিটা এল কী করে? মুসলিম লীগের কবর হয়ে গেছে বহু আগে।
তাঁরা উভয়েই অবাক হলেন। ভাব এ রকম যে, বলে কী লোকটা। মনোভাব গোপন না করে যা বললেন তা সংক্ষেপে এ রকম: আপনার মধ্যে এই পাকিস্তান-মার্কা বুদ্ধিটা এল কী করে? মুসলিম লীগের কবর হয়ে গেছে বহু আগে।
তার হাড়গোড় মিশে গেছে মাটিতে। দু-চারখানা থাকলেও পাকিস্তানে থাকতে পারে। সেই লীগের আবার শতবর্ষ পালন কি? তারপর তারা লীগকে শুধু নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেঝেতে বসেই নবাব সলিমুল্লাহকে এবং লীগের শীর্ষ নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে নিকুচি করলেন।
খুব সাবলীলভাবে যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের মুখের সামনে দ্বিমত পোষণ করা বিপজ্জনক। তাঁদের বক্তব্যের তেজ দেখে মনে হলো, ১৯০৫ সালে যদি তাঁদের বয়স ২৫ এর মতো হতো তাহলে মুসলিম লীগ গঠনের দিন ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের দিয়ে নবাববাড়ি ভাঙচুর করাতেন। নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব ভিকার-উল মুলকদের নেতাগিরি ছুটিয়ে দিতেন। এবং ১৯৩০-এর দশকে যদি তাঁদের বয়স ৩০-৩৫ হতো তাহলে জিন্নাহকে এমন জব্দ করতেন যে মনের দুঃখে তাঁকে আবার লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে হতো। ১৯৪০ সালের ২৩-২৪ মার্চের পরে ফজলুল হকের দশা হতো ৪ ডিসেম্বর সাদেক হোসেন খোকার যে অবস্থা হয়েছে। হক সাহেবের নির্ঘাৎ ঠাঁই হতো লাহোরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালে।
আমাদের বর্তমানের এই সুসময়ে আমাদের হতভাগ্য বাপ-দাদাদের সময়ের দল ও মতের কথা স্মরণ করা চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা। স্রেফ নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়। নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা।
শুধু স্বনামধন্যদের কথাই বা বলি কেন? সেই ১৯০৫-০৬ সালে এমন একটি সরকার বাংলাদেশের মসনদে ছিল যারা ঘোর মুসলিম জাতীয়তাবাদী। তাদের এক অংশ ছিল ইসলামি মৌলবাদী। ইসলামের ঝাণ্ডা তারা পত পত করে ওড়াচ্ছিল। মুসলিম লীগ নামে যে একটি সংগঠন কোনো দিন ছিল এবং তার কারণেই যে তারা সেদিন ক্ষমতায়—সে কথা তাদের জানা থাকলেও ভুলে গিয়েছিল। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-বুদ্ধিজীবীরা যে লীগকে জানতেন তা কাজী কাদেরের মুসলিম লীগ।
যা হোক, মুসলিম লীগের ঘোরতর শত্রু ভারতে দেখা গেল অন্য রকম চিত্র। সেখানকার পত্রপত্রিকা ও ইতিহাসবিদেরা শতবর্ষে লীগকে স্মরণ করলেন। গালিগালাজের মাধ্যমেও স্মরণ করা যায়। তা তাঁরা সেদিন করেননি। তাঁরা করেছেন মূল্যায়ন। লীগের ভালো-মন্দ দুই দিকই। উপমহাদেশের ইতিহাসে লীগের স্থান কোথায়? কেন লীগের জন্ম। বড় বড় কাগজ যেমন দ্য হিন্দু, হিন্দুস্থান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রভৃতিতে বছরব্যাপী লীগ নিয়ে লেখা বের হয়েছে। রোমিলা থাপার, বিপান চন্দ্র, কে এন পানিক্কর, মুশিরুল হাসান প্রমুখ বড় বড় ইতিহাসবিদেরা তাঁদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে লীগ সম্পর্কে লিখেছেন।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকগুলো ধারা ছিল। কৃষক, সন্ন্যাসী, ফকির, সাঁওতাল প্রভৃতি বিদ্রোহগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের জন্মের পর থেকে সাংগঠনিকভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার কারণে কংগ্রেসে মুসলমানেরা ঠাঁই পাচ্ছিলেন না। তাঁরা সংখ্যালঘু হলেও উপমহাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। তবে তাঁদের বিপুলাংশ বিদ্যা ও বিত্তে পিছিয়ে। তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবিদাওয়ার কথা কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে উত্থাপনের সুযোগ ছিল না। তাঁদের একটি আলাদা সাম্প্রদায়িক মঞ্চ দরকার। ১৯০৫ সালে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ গঠনের পর কংগ্রেস নেতারা যখন অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক উত্তেজনায় ফেটে পড়েন তখন মুসলমান নেতারা—নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব মোহসিন-উল-মুল্ক, নবাব ভিকার-উল-মুল্ক ও বাংলার নেতারা গঠন করেন মুসলিম লীগ। প্রথম দিকে লীগ মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিল না, মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়েই কথা বলত। এক পর্যায়ে লীগের নেতৃত্বেই উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। সেদিন পূর্ববাংলার ৯৯ ভাগ মুসলমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সমর্থন করেছিল, যেমন একাত্তরে ৯৯ ভাগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিল।
১৯৭২-এ গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের ২ (দুই) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যাবহিত পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল’ সেটাই ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হইবে।’ অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মের ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৪০ বছর পূর্ণ হবে আর মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে।
কোনো কোনো উপলক্ষ রোজ রোজ আসে না। বছরে বছরেও আসে না। বহুদিন পর একবারই আসে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪০ বছর পূর্তিও ছোটো কোনো উপলক্ষ নয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ঘাতক-দালাল ছাড়া, সব মানুষের কাছেই, দলমত-নির্বিশেষে সবার কাছেই, এই উপলক্ষটির মূল্য অসামান্য। সরকার, সরকারি দল, বিরোধী দল, জাতিধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে গোটা দেশবাসীর অহংকার করার মতো একটি উপলক্ষ। কিন্তু এই উপলক্ষের তাৎপর্য ধরা পড়ল না সরকারের কাজে, সরকারি দলের কাজে, বিরোধী দলের কাজে। পত্রপত্রিকা ও সম্প্রচার মাধ্যম মনে করিয়ে না দিলে হয়তো মানুষ জানতই না যে এবার আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৪০ বছর। অথচ মুক্তিযুদ্ধের কথা তারস্বরে বলা হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। যদিও সেটার অর্থ ও আবেদন সবার কাছে এক রকম নয়।
আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এবার সেই আওয়ামী লীগই ক্ষমতায়। ধারণা করেছিলাম এই উপলক্ষটি আওয়ামী লীগের সময় পাবে বিশেষ মাত্রা। কিন্তু হতাশ হলাম, তবে বিস্মিত হইনি। বিজয়ের রজতজয়ন্তীতে ১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। বিশেষ কিছু হয়নি।
বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাথায় বিপুল পরিমাণ সব সাংঘাতিক বুদ্ধি, হাতে তাদের সীমাহীন কাজ। কোন প্রতিষ্ঠানের নাম বদলাবেন, কোন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করবেন, বিশেষ কাউকে মন্ত্রিত্ব মঞ্জুর করা হলো, কিন্তু মন্ত্রণালয় কোথায়? ভাঙো দুই মন্ত্রণালয়, করো পাঁচটি। দাও সেগুলোর খুশিমতো নতুন নাম। এক মহানগরকে ভেঙে করো দুটো। আরও কী সব এলাহি কাণ্ড। একসময় বাঙালি মুসলমান চিঠি লিখতে গিয়ে চিঠির মাথায় লিখত ‘এলাহি ভরসা’। এখন ১৬ কোটি মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ও আদিবাসীর এলাহি ভরসা ছাড়া আর কোনো ভরসা নেই।
দেশের বৃহত্তম সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক তার মঞ্জুর করা অর্থ আমাদের মন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগে দেবে না। জাতির জন্য এ এক সাংঘাতিক অপবাদ ও লজ্জা। বিশ্বব্যাংক দেবে না বলে অন্য দাতা সংস্থাও দেবে না। বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত হলো না। বিশ্বব্যাংক নিজে কোনো দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ব ব্যাংকের দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে আমরা নাগরিকেরা গণ-ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করেছি। তাকে অভিযুক্ত করেছি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী। বিচারকদের মধ্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং আমিও ছিলাম। সেই ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে আমরা সরকারের কিছু সহায়তা চেয়েছিলাম তথ্য-উপাত্তের জন্য, কিন্তু পাওয়া যায়নি। তখন সরকার ছিল বিশ্বব্যাংকের পক্ষে, এখন গেছে বিগড়ে।
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনে জাতির কপালে কলঙ্কের চিহ্ন এঁকে দিল, তা নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিষয়টিকে দেওয়া হচ্ছে ধামাচাপা। এবং সেটা দেওয়া হচ্ছে খুব কাঁচাভাবে। মালয়েশিয়ার এক অতিথি এলেন বেড়াতে। তাঁর মুখ দিয়ে বলানো হলো, পদ্মায় সেতু বানাতে তারা রিংগিত (মালয়েশীয় মুদ্রা) দেবেন, ডলারের প্রয়োজন নেই। এখন শুনছি রিংগিতের দরকার নেই, পিপিপিতে অর্থাৎ নিজেদের টাকাতেই সেতু হবে। তবে একটা মাত্র সেতু কে করে? সেতু হবে দুটো। বিরোধী দলের কথা শুনে বুঝতে পারছি, তারা ক্ষমতায় গেলে সেতু হবে তিনটি। বিশ্বব্যাংক গেছে, মালয়েশিয়াও গেছে, পিপিপিরও কোনো প্রয়োজন হবে না। এর পরে শোনা যাবে মাটির ব্যাংকে বাচ্চারা যে কয়েন জমায় তা দিয়েই পদ্মা সেতু করা সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের বদলে মাটির ব্যাংক। শিগগিরই এমন কথাও শোনা যেতে পারে, পদ্মা সেতু বানাতে কোনো টাকাই লাগবে না, মানুষের বাঁশঝাঁড় থেকে বাঁশ এনে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে হবে পদ্মা সেতু। সিমেন্ট ও লোহার বদলে বাঁশ ও দড়ির সেতু।
কোনো জাতির জীবনে ৪০ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। একটি স্বাধীন দেশ শুধু একখণ্ড মাটি নয়। ৪০ বছর বয়সে একটি জাতি সুস্থিত হয়। গড়ে ওঠে তার একটি অনন্য চরিত্র। পরিপক্বতা আসে জাতীয় নেতৃত্বে। ৪০ বছরে একটি জাতি পূর্ণ বিকশিত হয়। ৪০ বছরে আমাদের নেতৃত্বে কি কোনো পরিপক্বতা এসেছে? জাতি হিসেবে আমরা কি সুস্থিত ও বিকশিত হতে পেরেছি? সেটাই তো হওয়া উচিত ৪০ বছর পূর্তিতে আমাদের জিজ্ঞাসা।
স্বাধীনতার ৪০ বছর উদ্যাপনের অনেকগুলো দিক। একটি আনন্দ ও উৎসবের ব্যাপার। হতে পারত সপ্তাহব্যাপী একটি বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। জেলায়-উপজেলায় হতো আলাদা অনুষ্ঠান। এই উপলক্ষের আর একটি দিক মূল্যায়নমূলক। আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন সভ্য জাতি তার ৪০ বছরের স্বাধীনতা থেকে কী পেয়েছে। অথবা কী পায়নি স্বাধীনতা থেকে, যা তার প্রত্যাশিত ছিল। এই উপলক্ষের আর একটি দিক হতে পারত পরিকল্পনামূলক। ভবিষ্যতে আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই তার একটি রূপরেখা।
স্বাধীনতা হলো সমস্ত মানুষের সম্পদ, শ্রেণীবিশেষের বা দলবিশেষের নয়। কোনো জাতির স্বাধীনতার সুফল নিয়ে কোনো কৃপণতা চলে না। তা এক গোত্র ভোগ করবে, অন্য গোত্র ভোগ করবে না, তা হয় না। এমনকি স্বাধীনতা অর্জনে যার কোনো অবদানই নেই তারও স্বাধীনতার ফল ভোগ করার অধিকার আছে। যে দেশ বাইরের শক্তির আধিপত্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, কষ্ট করে হলেও স্বয়ংসম্পূর্ণ, অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজস্বচিহ্নিত, যেখানে প্রতিটি মানুষ পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ভোগ করে, সেই দেশই সত্যিকারের স্বাধীন।
পৃথিবীর বহু জাতিই আমাদের মতো শত শত বছর পরাধীন ছিল। হয়েছে অন্যের দ্বারা শোষিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত। একসময় তারা বৈদেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের মতোই রুখে দাঁড়িয়েছে। অকাতরে রক্ত দিয়েছে। তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বন্ধুপ্রতিম দেশ সাহায্য-সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এসেছে। তাতে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হয়েছে, ত্বরান্বিত হয়েছে বিজয়। ওই ভাবেই হয়েছে আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ, চীনের বিপ্লব, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু আমরা কেন হতে পারলাম না আমেরিকার মতো, চীনের মতো, ভিয়েতনামের মতো বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো। কেন পারলাম না তার জবাব নেতাদের কাছে জানতে চাইবে ইতিহাস। আমাদের সমসাময়িক কালের ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা জবাব দিতে পারবেন, আমাদের নেতারা থাকবেন লা-জওয়াব।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৪০ বছর। আমাদের সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ অপরিমেয়। তাদের ঋণ কোনো দিন পরিশোধ হবে না। মুক্তিযুদ্ধে সেদিন দেশের বাইরের যাঁরা আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের কথা যদি আমরা ভুলে যাই তা হবে ক্ষমাহীন অকৃতজ্ঞতা। ভারতের জনগণ ও সরকারের সাহায্য ছিল প্রত্যক্ষ। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা ছিল অন্য রকম, যা আমাদের শত্রুপক্ষের মনোবল নষ্ট করতে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। সেদিন কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরপেক্ষতার ভাব ধরে নীরবতা অবলম্বন করলে বাংলাদেশের ভাগ্য হতে পারত অন্য রকম। কারণ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং কমিউনিস্ট চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।
আমি যদি আজ সরকারের নীতিনির্ধারক কোনো নেতা হতাম অথবা অসংখ্য উপদেষ্টার একজন, তাহলে সরকার ও দলকে যে পরামর্শ দিতাম তা এ রকম: সরকারি পর্যায়ে বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রী হতেন যার চেয়ারম্যান। ৪০ বছর পূর্তি উদ্যাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান অতিথি হতেন রাষ্ট্রপতি এবং বিশেষ অতিথি ভারতের কোনো শীর্ষ নেতা। সমাপনী অনুষ্ঠানের সভাপ্রধান হতেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান অতিথি স্পিকার এবং বিশেষ অতিথি রাশিয়ার কোনো বড় নেতা। আলোচনার বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে থাকত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন, ৪০ বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতার নির্মোহ বিশ্লেষণ।
শুধু আমার পরামর্শই বা সরকার গ্রহণ করবে কেন? আরও অনেক মানুষের পরামর্শ নিয়ে, সব দলমত শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে উপলক্ষটিকে করা যেত তাৎপর্যমণ্ডিত। যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজে সেটাই হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে বাস করছি। যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লেশমাত্র নেই, প্রেম ও সহমর্মিতা সমাজ ও রাজনীতি থেকে উধাও, হিংসা-বিদ্বেষ-বিভেদ অন্তহীন, সেখানে সবাই মিলে ৪০ বছর পূর্তি উদ্যাপন কল্পনাবিলাস মাত্র।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
খুব সাবলীলভাবে যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের মুখের সামনে দ্বিমত পোষণ করা বিপজ্জনক। তাঁদের বক্তব্যের তেজ দেখে মনে হলো, ১৯০৫ সালে যদি তাঁদের বয়স ২৫ এর মতো হতো তাহলে মুসলিম লীগ গঠনের দিন ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের দিয়ে নবাববাড়ি ভাঙচুর করাতেন। নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব ভিকার-উল মুলকদের নেতাগিরি ছুটিয়ে দিতেন। এবং ১৯৩০-এর দশকে যদি তাঁদের বয়স ৩০-৩৫ হতো তাহলে জিন্নাহকে এমন জব্দ করতেন যে মনের দুঃখে তাঁকে আবার লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে হতো। ১৯৪০ সালের ২৩-২৪ মার্চের পরে ফজলুল হকের দশা হতো ৪ ডিসেম্বর সাদেক হোসেন খোকার যে অবস্থা হয়েছে। হক সাহেবের নির্ঘাৎ ঠাঁই হতো লাহোরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালে।
আমাদের বর্তমানের এই সুসময়ে আমাদের হতভাগ্য বাপ-দাদাদের সময়ের দল ও মতের কথা স্মরণ করা চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা। স্রেফ নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়। নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা।
শুধু স্বনামধন্যদের কথাই বা বলি কেন? সেই ১৯০৫-০৬ সালে এমন একটি সরকার বাংলাদেশের মসনদে ছিল যারা ঘোর মুসলিম জাতীয়তাবাদী। তাদের এক অংশ ছিল ইসলামি মৌলবাদী। ইসলামের ঝাণ্ডা তারা পত পত করে ওড়াচ্ছিল। মুসলিম লীগ নামে যে একটি সংগঠন কোনো দিন ছিল এবং তার কারণেই যে তারা সেদিন ক্ষমতায়—সে কথা তাদের জানা থাকলেও ভুলে গিয়েছিল। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-বুদ্ধিজীবীরা যে লীগকে জানতেন তা কাজী কাদেরের মুসলিম লীগ।
যা হোক, মুসলিম লীগের ঘোরতর শত্রু ভারতে দেখা গেল অন্য রকম চিত্র। সেখানকার পত্রপত্রিকা ও ইতিহাসবিদেরা শতবর্ষে লীগকে স্মরণ করলেন। গালিগালাজের মাধ্যমেও স্মরণ করা যায়। তা তাঁরা সেদিন করেননি। তাঁরা করেছেন মূল্যায়ন। লীগের ভালো-মন্দ দুই দিকই। উপমহাদেশের ইতিহাসে লীগের স্থান কোথায়? কেন লীগের জন্ম। বড় বড় কাগজ যেমন দ্য হিন্দু, হিন্দুস্থান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রভৃতিতে বছরব্যাপী লীগ নিয়ে লেখা বের হয়েছে। রোমিলা থাপার, বিপান চন্দ্র, কে এন পানিক্কর, মুশিরুল হাসান প্রমুখ বড় বড় ইতিহাসবিদেরা তাঁদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে লীগ সম্পর্কে লিখেছেন।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকগুলো ধারা ছিল। কৃষক, সন্ন্যাসী, ফকির, সাঁওতাল প্রভৃতি বিদ্রোহগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের জন্মের পর থেকে সাংগঠনিকভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার কারণে কংগ্রেসে মুসলমানেরা ঠাঁই পাচ্ছিলেন না। তাঁরা সংখ্যালঘু হলেও উপমহাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। তবে তাঁদের বিপুলাংশ বিদ্যা ও বিত্তে পিছিয়ে। তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবিদাওয়ার কথা কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে উত্থাপনের সুযোগ ছিল না। তাঁদের একটি আলাদা সাম্প্রদায়িক মঞ্চ দরকার। ১৯০৫ সালে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ গঠনের পর কংগ্রেস নেতারা যখন অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক উত্তেজনায় ফেটে পড়েন তখন মুসলমান নেতারা—নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব মোহসিন-উল-মুল্ক, নবাব ভিকার-উল-মুল্ক ও বাংলার নেতারা গঠন করেন মুসলিম লীগ। প্রথম দিকে লীগ মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিল না, মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়েই কথা বলত। এক পর্যায়ে লীগের নেতৃত্বেই উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। সেদিন পূর্ববাংলার ৯৯ ভাগ মুসলমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সমর্থন করেছিল, যেমন একাত্তরে ৯৯ ভাগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিল।
১৯৭২-এ গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের ২ (দুই) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যাবহিত পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল’ সেটাই ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হইবে।’ অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মের ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৪০ বছর পূর্ণ হবে আর মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে।
কোনো কোনো উপলক্ষ রোজ রোজ আসে না। বছরে বছরেও আসে না। বহুদিন পর একবারই আসে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪০ বছর পূর্তিও ছোটো কোনো উপলক্ষ নয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ঘাতক-দালাল ছাড়া, সব মানুষের কাছেই, দলমত-নির্বিশেষে সবার কাছেই, এই উপলক্ষটির মূল্য অসামান্য। সরকার, সরকারি দল, বিরোধী দল, জাতিধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে গোটা দেশবাসীর অহংকার করার মতো একটি উপলক্ষ। কিন্তু এই উপলক্ষের তাৎপর্য ধরা পড়ল না সরকারের কাজে, সরকারি দলের কাজে, বিরোধী দলের কাজে। পত্রপত্রিকা ও সম্প্রচার মাধ্যম মনে করিয়ে না দিলে হয়তো মানুষ জানতই না যে এবার আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৪০ বছর। অথচ মুক্তিযুদ্ধের কথা তারস্বরে বলা হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। যদিও সেটার অর্থ ও আবেদন সবার কাছে এক রকম নয়।
আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এবার সেই আওয়ামী লীগই ক্ষমতায়। ধারণা করেছিলাম এই উপলক্ষটি আওয়ামী লীগের সময় পাবে বিশেষ মাত্রা। কিন্তু হতাশ হলাম, তবে বিস্মিত হইনি। বিজয়ের রজতজয়ন্তীতে ১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। বিশেষ কিছু হয়নি।
বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাথায় বিপুল পরিমাণ সব সাংঘাতিক বুদ্ধি, হাতে তাদের সীমাহীন কাজ। কোন প্রতিষ্ঠানের নাম বদলাবেন, কোন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করবেন, বিশেষ কাউকে মন্ত্রিত্ব মঞ্জুর করা হলো, কিন্তু মন্ত্রণালয় কোথায়? ভাঙো দুই মন্ত্রণালয়, করো পাঁচটি। দাও সেগুলোর খুশিমতো নতুন নাম। এক মহানগরকে ভেঙে করো দুটো। আরও কী সব এলাহি কাণ্ড। একসময় বাঙালি মুসলমান চিঠি লিখতে গিয়ে চিঠির মাথায় লিখত ‘এলাহি ভরসা’। এখন ১৬ কোটি মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ও আদিবাসীর এলাহি ভরসা ছাড়া আর কোনো ভরসা নেই।
দেশের বৃহত্তম সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক তার মঞ্জুর করা অর্থ আমাদের মন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগে দেবে না। জাতির জন্য এ এক সাংঘাতিক অপবাদ ও লজ্জা। বিশ্বব্যাংক দেবে না বলে অন্য দাতা সংস্থাও দেবে না। বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত হলো না। বিশ্বব্যাংক নিজে কোনো দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ব ব্যাংকের দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে আমরা নাগরিকেরা গণ-ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করেছি। তাকে অভিযুক্ত করেছি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী। বিচারকদের মধ্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং আমিও ছিলাম। সেই ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে আমরা সরকারের কিছু সহায়তা চেয়েছিলাম তথ্য-উপাত্তের জন্য, কিন্তু পাওয়া যায়নি। তখন সরকার ছিল বিশ্বব্যাংকের পক্ষে, এখন গেছে বিগড়ে।
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনে জাতির কপালে কলঙ্কের চিহ্ন এঁকে দিল, তা নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিষয়টিকে দেওয়া হচ্ছে ধামাচাপা। এবং সেটা দেওয়া হচ্ছে খুব কাঁচাভাবে। মালয়েশিয়ার এক অতিথি এলেন বেড়াতে। তাঁর মুখ দিয়ে বলানো হলো, পদ্মায় সেতু বানাতে তারা রিংগিত (মালয়েশীয় মুদ্রা) দেবেন, ডলারের প্রয়োজন নেই। এখন শুনছি রিংগিতের দরকার নেই, পিপিপিতে অর্থাৎ নিজেদের টাকাতেই সেতু হবে। তবে একটা মাত্র সেতু কে করে? সেতু হবে দুটো। বিরোধী দলের কথা শুনে বুঝতে পারছি, তারা ক্ষমতায় গেলে সেতু হবে তিনটি। বিশ্বব্যাংক গেছে, মালয়েশিয়াও গেছে, পিপিপিরও কোনো প্রয়োজন হবে না। এর পরে শোনা যাবে মাটির ব্যাংকে বাচ্চারা যে কয়েন জমায় তা দিয়েই পদ্মা সেতু করা সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের বদলে মাটির ব্যাংক। শিগগিরই এমন কথাও শোনা যেতে পারে, পদ্মা সেতু বানাতে কোনো টাকাই লাগবে না, মানুষের বাঁশঝাঁড় থেকে বাঁশ এনে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে হবে পদ্মা সেতু। সিমেন্ট ও লোহার বদলে বাঁশ ও দড়ির সেতু।
কোনো জাতির জীবনে ৪০ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। একটি স্বাধীন দেশ শুধু একখণ্ড মাটি নয়। ৪০ বছর বয়সে একটি জাতি সুস্থিত হয়। গড়ে ওঠে তার একটি অনন্য চরিত্র। পরিপক্বতা আসে জাতীয় নেতৃত্বে। ৪০ বছরে একটি জাতি পূর্ণ বিকশিত হয়। ৪০ বছরে আমাদের নেতৃত্বে কি কোনো পরিপক্বতা এসেছে? জাতি হিসেবে আমরা কি সুস্থিত ও বিকশিত হতে পেরেছি? সেটাই তো হওয়া উচিত ৪০ বছর পূর্তিতে আমাদের জিজ্ঞাসা।
স্বাধীনতার ৪০ বছর উদ্যাপনের অনেকগুলো দিক। একটি আনন্দ ও উৎসবের ব্যাপার। হতে পারত সপ্তাহব্যাপী একটি বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। জেলায়-উপজেলায় হতো আলাদা অনুষ্ঠান। এই উপলক্ষের আর একটি দিক মূল্যায়নমূলক। আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন সভ্য জাতি তার ৪০ বছরের স্বাধীনতা থেকে কী পেয়েছে। অথবা কী পায়নি স্বাধীনতা থেকে, যা তার প্রত্যাশিত ছিল। এই উপলক্ষের আর একটি দিক হতে পারত পরিকল্পনামূলক। ভবিষ্যতে আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই তার একটি রূপরেখা।
স্বাধীনতা হলো সমস্ত মানুষের সম্পদ, শ্রেণীবিশেষের বা দলবিশেষের নয়। কোনো জাতির স্বাধীনতার সুফল নিয়ে কোনো কৃপণতা চলে না। তা এক গোত্র ভোগ করবে, অন্য গোত্র ভোগ করবে না, তা হয় না। এমনকি স্বাধীনতা অর্জনে যার কোনো অবদানই নেই তারও স্বাধীনতার ফল ভোগ করার অধিকার আছে। যে দেশ বাইরের শক্তির আধিপত্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, কষ্ট করে হলেও স্বয়ংসম্পূর্ণ, অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজস্বচিহ্নিত, যেখানে প্রতিটি মানুষ পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ভোগ করে, সেই দেশই সত্যিকারের স্বাধীন।
পৃথিবীর বহু জাতিই আমাদের মতো শত শত বছর পরাধীন ছিল। হয়েছে অন্যের দ্বারা শোষিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত। একসময় তারা বৈদেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের মতোই রুখে দাঁড়িয়েছে। অকাতরে রক্ত দিয়েছে। তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বন্ধুপ্রতিম দেশ সাহায্য-সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এসেছে। তাতে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হয়েছে, ত্বরান্বিত হয়েছে বিজয়। ওই ভাবেই হয়েছে আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ, চীনের বিপ্লব, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু আমরা কেন হতে পারলাম না আমেরিকার মতো, চীনের মতো, ভিয়েতনামের মতো বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো। কেন পারলাম না তার জবাব নেতাদের কাছে জানতে চাইবে ইতিহাস। আমাদের সমসাময়িক কালের ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা জবাব দিতে পারবেন, আমাদের নেতারা থাকবেন লা-জওয়াব।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৪০ বছর। আমাদের সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ অপরিমেয়। তাদের ঋণ কোনো দিন পরিশোধ হবে না। মুক্তিযুদ্ধে সেদিন দেশের বাইরের যাঁরা আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের কথা যদি আমরা ভুলে যাই তা হবে ক্ষমাহীন অকৃতজ্ঞতা। ভারতের জনগণ ও সরকারের সাহায্য ছিল প্রত্যক্ষ। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা ছিল অন্য রকম, যা আমাদের শত্রুপক্ষের মনোবল নষ্ট করতে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। সেদিন কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরপেক্ষতার ভাব ধরে নীরবতা অবলম্বন করলে বাংলাদেশের ভাগ্য হতে পারত অন্য রকম। কারণ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং কমিউনিস্ট চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।
আমি যদি আজ সরকারের নীতিনির্ধারক কোনো নেতা হতাম অথবা অসংখ্য উপদেষ্টার একজন, তাহলে সরকার ও দলকে যে পরামর্শ দিতাম তা এ রকম: সরকারি পর্যায়ে বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রী হতেন যার চেয়ারম্যান। ৪০ বছর পূর্তি উদ্যাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান অতিথি হতেন রাষ্ট্রপতি এবং বিশেষ অতিথি ভারতের কোনো শীর্ষ নেতা। সমাপনী অনুষ্ঠানের সভাপ্রধান হতেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান অতিথি স্পিকার এবং বিশেষ অতিথি রাশিয়ার কোনো বড় নেতা। আলোচনার বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে থাকত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন, ৪০ বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতার নির্মোহ বিশ্লেষণ।
শুধু আমার পরামর্শই বা সরকার গ্রহণ করবে কেন? আরও অনেক মানুষের পরামর্শ নিয়ে, সব দলমত শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে উপলক্ষটিকে করা যেত তাৎপর্যমণ্ডিত। যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজে সেটাই হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে বাস করছি। যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লেশমাত্র নেই, প্রেম ও সহমর্মিতা সমাজ ও রাজনীতি থেকে উধাও, হিংসা-বিদ্বেষ-বিভেদ অন্তহীন, সেখানে সবাই মিলে ৪০ বছর পূর্তি উদ্যাপন কল্পনাবিলাস মাত্র।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments