আজও নির্মাণ হয়নি স্মৃতিসৌধঃ এই সজ্ঞান অবহেলার অবসান চাই
আটত্রিশ বছর পেরিয়ে গেলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের অসংখ্য স্মারকচিহ্ন হারিয়ে যেতে বসেছে। স্থান বিশেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির স্মারক সৌধ নামফলক ইত্যাদি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে দেশের একাধিক স্থানে শহীদ স্মরণে বার বার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও নানা অজুহাতে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এই অবিমৃশ্যকারিতার মধ্য দিয়েই আমরা বিগত ৩৮ বছর ধরে পালন করে আসছি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস। এবারের বিজয় দিবসের প্রাক্কালেও এই সজ্ঞান বিভ্রান্তি নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—আর কতদিন পরে আমরা শহীদদের আত্মত্যাগকে যথাযথভাবে স্মরণ করার তাড়নাবোধ করব?
নিঃসন্দেহে আটত্রিশ বছর সময় স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত স্থান, শহীদের রক্তস্নাত মাটি, গণকবর শনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট। অনেক ক্ষেত্রেই আজ পর্যন্ত এ কাজটিও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এমন অবস্থা হয়েছে যে, নতুন প্রজন্মকে দেখিয়ে না দিলে জানার উপায় নেই যে, এই জায়গাটিতেই মাতৃভূমির জন্য শত্রুর হাতে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষ। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি সেক্টর, ৬নং সেক্টর-এ আজও নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতি স্মারক। প্রস্তাবিত স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়নি নীলফামারী জেলার রক্ত লাঞ্ছিত রণাঙ্গনের কেন্দ্রস্থলে। সৈয়দপুরে একাধিকবার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের যোগান, স্থান সঙ্কট ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতার কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সৈয়দপুরে কতজন শহীদ হয়েছেন তার সঠিক হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন সূত্রমতে এ সংখ্যা হাজারেরও বেশি। জানা যায়, ’৭১-এর ১৩ জুন এখানে ট্রেন থেকে নামিয়ে ৩৫০ জনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে হানাদার বাহিনীর লোকরা। এখানে এমনও অনেক পরিবার ছিল যাদের কেউ মুক্তিযুদ্ধের হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি। অথচ সেখানে স্মৃতিসৌধের নকশা করার পরও স্থান নির্ধারণের জটিলতাকে কেন্দ্র করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ স্থগিত রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সৈয়দপুর ওয়াপদা মোড়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের স্থানে রোপণ করা হয়েছে একটি বটগাছ। উল্লেখ্য, ২০০০ সালের ৯ অক্টোবর এই মোড়ের সড়ক দ্বীপে অমর শহীদ স্মৃতি ভাস্কর্য ‘স্বাধীনতা’ নির্মাণের ভিত্তি ফলক উন্মোচন করা হয়। নামকরণ করা হয় ‘স্বাধীনতা শহীদ স্মৃতি ভাস্কর্য’। সবাই জানে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এ সময় ৬ নম্বর সেক্টরটির কেন্দ্র ছিল বর্তমান লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী হাসরউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সেখানেও অজ্ঞাত কারণে নির্মিত হয়নি কোনো স্মারকচিহ্ন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের তাবত ইতিহাসকে বহুলাংশে মূর্ত করে রাখে বিভিন্ন স্মৃতিবিজড়িত স্মারকচিহ্ন বা সৌধাদি। এগুলো শুধু অতীত ইতিহাসকেই জীবন্ত করে রাখে না বরং ভবিষ্যতের জন্য ইতিহাসের অন্যতম উপাত্ত হিসেবেও নির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষের কাছে অতীত বাঙ্ময় হয়ে ওঠে স্মারকচিহ্নের সামনে দাঁড়ালে। পৃথিবীর সব দেশেই বিশেষত স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সব ঘটনা বিভিন্ন স্মারকের মাধ্যমে স্মরণ করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির স্মারক নিয়ে যে সজ্ঞান অবহেলা তা অন্য কোথাও দেখা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের ৩৮ বছর পর হলেও আমরা এই বেদনাদায়ক অক্ষমতা থেকে পরিত্রাণ চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত রাখার স্বার্থেই এসব অসমাপ্ত স্মারক নির্মাণের জন্য সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই।
No comments