দুই বছর গণনা শুরুর দিনটিতে-রাজনীতি by আসিফ কবীর
২৫ অক্টোবর, ২০১৩ চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। আজ থেকে ঠিক দুই বছর পর। এদিন থেকে বর্তমান সরকার কেবল রুটিন কাজে সীমাবদ্ধ থাকবে। তখন থেকে তিন মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি, ২০১৪ নবম (চলতি) সংসদের পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার মধ্যেই সাধারণ নির্বাচন হতে হবে। এ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোট নতুন সরকার গঠন করবে। সর্বশেষ ১৫তম সংশোধনী অনুযায়ী নির্বাচন ও পরবর্তী সরকার গঠন পদ্ধতির সময়সীমা মোটামুটি এরকমই।
এ বিষয়গুলো নিয়ে যদিও প্রধান বিরোধী দল ও সমমনাদের আপত্তি আছে। দশম সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য, অবাধ, নিরপেক্ষ করতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নির্বাচনবিধি ও পদ্ধতির আরও সংস্কারে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণে সরকার ও বিরোধী দলের দায়িত্বশীল যৌথ অংশগ্রহণ থাকা জরুরি।
আগামী ৬ জানুয়ারি সরকারের ও ২৫ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের তিন বছর পূর্তি হলেও আজ থেকে সরকারের আক্ষরিক মেয়াদ থাকছে মাত্র দুই বছর। নব্বইয়ের পরিবর্তিত অবস্থার পর ২১ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল চ্যালেঞ্জ দুটি_ এক. পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতাসীন থাকা এবং দুই. রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্য ছাড়া অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতারোহণ বন্ধ করা। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার জয়লাভ করে ক্ষমতা লাভ ও অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করতে আওয়ামী লীগের আন্তরিক চেষ্টা ছিল। '৯৬ সালে বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে তার বিগত মেয়াদের অভিজ্ঞতা থাকার বিষয়টি ভোটারদের মনোযোগ কাড়তে উল্লেখ করেছিলেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ২০০১-০৬ মেয়াদকালে মাহথির মোহাম্মদ কর্তৃক ঢাকা সফরের সময়কার কি-নোটে কোনো সরকারের একনাগাড়ে কয়েক পর্ব ক্ষমতায় থাকা উন্নয়নের পক্ষে অনুকূল উল্লেখ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেয় তদানীন্তন ক্ষমতাসীনরা। রাজনৈতিক দল মাত্রই নিজেদের অনুসৃত আদর্শে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে ইশতেহার, তার বাস্তবায়নে একনিষ্ঠ চেষ্টা, বাস্তবায়নের সন্তোষজনক হারের উল্লেখপূর্বক সমর্থন আদায়ে চেষ্টা করবে। ক্লাব, সমিতি, অন্যান্য সংগঠনের মতো রাজনৈতিক দল নয়। জনগণকে আস্থায় নিয়ে জনসমর্থনপুষ্ট হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ক্ষমতায় গিয়ে সফলভাবে শাসন কাজ পরিচালনায় যে কোনো দলের সার্থকতা। এই পথপরিক্রমায় ঘাত-প্রতিঘাত, ষড়যন্ত্র ও নানামুখী চাপের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের দিন যায়। বাংলাদেশে ৪০ বছরের গণতন্ত্রহীনতা ও গণতান্ত্রিক মিত্র শাসনে প্রধান দুই দলের জন্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের তাগিদ তুলনামূলকভাবে বেশি। এ জন্য বর্তমান ক্ষমতাসীনদের জনগণের আবেগ অনুভূতি ও প্রত্যাশাকে আরও বেশি বেশি করে স্পর্শ করা এবং বিগত তিন বছরের অর্জনের ফলাফল ও নেপথ্যের আন্তরিক চেষ্টাকে তুলে ধরতে হবে। অন্যদিকে বিরোধী দলের ক্ষমতাকালীন ব্যর্থতাগুলো এড়িয়ে বা অস্বীকার না করে অনুসন্ধানপূর্বক তাদের প্রতিশ্রুতিগুলোকে জাতির কাছে বাস্তবসম্মত করতে ব্যাপৃত হওয়া উচিত। বর্তমান সরকারের প্রত্যাশাগত ঈপ্সিত লক্ষ্যে উপনীত না হওয়ার দায় আছে। আমরা এ বিষয়টিকে দেখতে পারি ধারণার চেয়ে বেশি সময় লাগিয়ে নির্মাণাধীন অট্টালিকার মতো। ইট-বালি-সুরকিতে মাখামাখি, যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা, ছাদ ঢালাইয়ের দিনে ঢালাই মসলা বা পানির অপ্রতুলতা নিয়ে নির্মাতাদের দুশ্চিন্তা, একদিন ওপর থেকে ইট পড়ে পথচারী আহত হওয়া, মজুরি নিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের অসন্তোষ_ এই অপ্রিয় গল্পগুলোর যবনিকা ঘটিয়ে অবশেষে সুরম্য আধুনিক ইমারতের অস্তিত্ব জানান দেওয়া অনুরূপ। সে উন্নয়ন অভিমুখী যাত্রা তিন বছর ধরে চলমান, তার দৃশ্যমান ফল লাভ হতে শুরু করলে দুই বছরের শেষে নির্বাচনী বৈতরণী অতিক্রম ক্ষমতাসীনদের জন্য সহজ হবে। বর্তমান সরকারের গ্রামমুখী নীতি, মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করায় জোরারোপ, অবকাঠামো উন্নয়ন, নিজস্ব প্রযুক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করে টেকসই উন্নয়নের নীতি গ্রহণ, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখাকে প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদির ফলাফল দ্রুত ও বিলম্বিত দুই মিশ্র প্রকৃতির। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনদের দেশ পরিচালনার পুনর্বার সুযোগ লাভ করতে দুই বছরের মধ্যে সাফল্যগুলো স্থূলভাবে দৃশ্যমান হওয়ার বিকল্প নেই। এ ছাড়া মানুষের প্রগলভ আবেগ বা স্পর্শকাতরতাপ্রসূত ইস্যুগুলোকে সাপেক্ষতাভেদে নিয়ন্ত্রণ, লঘু বা হ্রাস করা, কখনও কেবলই স্বীকার করায় সর্বোচ্চ সংবেদনশীল হতে হবে। দুটি শিশুর মধ্যে বল নিয়ে মারামারি, দুই গ্রামের ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে স্পষ্ট দ্বন্দ্ব, দুই সহকর্মীর ঠাণ্ডা লড়াই যেমন সংশ্লিষ্ট অভিভাবক-স্থানীয়দের দায়িত্বশীল উপদেশ দিয়ে মেটাতে হয়, অপ্রয়োজনীয় হলেও সেন্টিমেন্টাল ইস্যু হিসেবে উদাসীন থাকার জো থাকে না। সরকারকেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও বাহুল্য স্বীকৃত এ দেশে সংবাদপত্র গুরুত্বসহকারে ইথারে বা টিভির পর্দায় গুরুত্বসহকারে উঠে আসা বিষয়গুলোকে সংবেদনশীল বিবৃতি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। বর্তমান সরকারের অপ্রতিহত সুবিধা হলো গণমাধ্যমের বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপনায় সরকারের সমালোচনার বিপরীতে বিরোধী দলকে দিয়ে উদ্দিষ্ট সমস্যাগুলো মেটানোর অভিমত খুব একটা আসে না। সরকারের ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলোতে বিরোধী দল সফল হবে এমন মতামত প্রতিষ্ঠা করাই দুরূহ। পল্টনের জনসভায় ২৭ সেপ্টেম্বর বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া অবশ্য জনগণের কল্যাণার্থে অনেক কিছু করবেন বা অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে তার নেতৃত্বাধীন জোট আগামীতে ক্ষমতায় গেলে_ বলেছেন। কিন্তু এ ফর্মুলা বা সাফল্যের উপায় সরকারকে দিয়ে সহায়তা করার মতো উদারতা বা রাজনৈতিক সাবলকত্ব এ দেশে আজও অনুপস্থিত।
সরকারের অনেক অদৃশ্য সাফল্যও থাকে, জনগণকে আস্থায় নেওয়ার স্বার্থে এ বিষয়গুলোও অনুভূতির নাগালে আনা প্রয়োজন। যেমন_ জঙ্গি দমন, যত্রতত্র বোমা হামলা বন্ধ, আত্মঘাতী বোমারুদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে বলে জনাকীর্ণ স্থান বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় মানুষ স্বচ্ছন্দে বিচরণ করছে। এর পেছনে অক্লান্ত কর্মী বিশেষভাবে বাছাই করা শব্দটি সম্পাদনাকালে অপরিবর্তিত রাখার অনুরোধক্রমে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশেষত গোয়েন্দাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি আছে, তা মানুষকে জানাতে হবে। প্রায় একই জনবল ও সরঞ্জামাদি দিয়ে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সংঘবদ্ধ দলগত সন্ত্রাস নির্মূল সম্ভব হয়েছে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যা বরং বাড়ারই কথা ছিল।
আগামী দুই বছর বিরোধী দল সরকারকে বিচলিত রাখার পণ করেছে। ১৫তম সংশোধনীর অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে সর্বাত্মক সরকারবিরোধী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেছে। যদিও বাংলাদেশের মানুষ ভালোই জানে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপ না হলেও বিএনপি ও সমমনারা অকুণ্ঠভাবে এ সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন ভিন্ন অন্য কিছু করত না। বিএনপি নিজে ক্ষমতাসীন থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর একই সংশোধনী আরও কৌশল আশ্রয়ী হয়ে রচনা করত। প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের অর্থের বিনিময়ে ওই রায় প্রদান সম্পর্কিত বিএনপির অভিযোগ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আত্মঘাতী হামলা বলারই প্রতিধ্বনি মাত্র। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়া অর্থের বিনিময়ে জলাঞ্জলি দেওয়ার গল্প আদপে বাস্তব ঘনিষ্ঠ কিছু নয়। অনেকে বলবেন_ এ জন্য তিনি পরবর্তী একাধিক নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার করতে পারে বলে পথ খোলা রেখে গেছেন বা এটা অনুসৃত হচ্ছে না কেন? কিন্তু বিগত নির্বাচনগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না রাখতেই এমনটা করা হয়েছে মনে করাই অধিকতর সঙ্গত। এমন উল্লেখ না থাকলে আরও একটা অন্তহীন বিতর্কে দিগভ্রান্ত হতে হতো জাতিকে।
আসিফ কবীর : সাংবাদিক
No comments