স্মৃতি হয়ে গেলেন রশীদ ভাই by রফিকুর রহমান
ছবির পাগল রশীদ তালুকদার ছিলেন আমার শিক্ষক। তার হাত ধরেই 'নিউজ ফটোগ্রাফি'তে আমার হাতেখড়ি। শুধু আমি নই, অনেক ফটোসাংবাদিকই শিখেছেন তার কাছে। তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো হাতে ধরে শিখিয়েছেন। তার সহায়তায় জীবনের প্রথম ক্যামেরাটি কিনি। রশীদ ভাই ছিলেন এ অঙ্গনের এক দিকপাল। প্রতিদিন এক্সক্লুসিভ ও ভালো ছবি তোলাই যেন তার নেশা ছিল।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন ঘটনায় তার তোলা ছবি আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৬৯ সালে যখন আমি বিএ ফাইনালে পড়ি, তখনই সিনেমা ফটোগ্রাফিতে কাজ শুরু করি; কিন্তু ওই অঙ্গনে কাজ করতে ভালো না লাগায় তার পরামর্শে নিউজ ফটোগ্রাফিতে চলে আসি। পরের বছর তার সুপারিশেই আমি তখনকার ইংরেজি দৈনিক 'দ্য পিপল'-এ চাকরি পেয়ে যাই। তখন থেকেই পরম শ্রদ্ধেয় 'রশীদ ভাই'য়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক আমি। টানা প্রায় ১০ বছর তার ভেসপার পেছনেই ঘুরেছি। আমার কাজ ছিল রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার বাসায় চলে যাওয়া। যাওয়ামাত্র আমরা যুদ্ধে বেরিয়ে যেতাম। ছবি তোলাকে তিনি 'যুদ্ধ' হিসেবেই মনে করতেন।
রশীদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তদানীন্তন দৈনিক বাংলার মরহুম গোলাম মওলা ভাই। তবে পেশার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতাও ছিল। সকালে প্রেস ক্লাবে গিয়ে একজন আরেকজনকে না দেখলেই অস্থির হয়ে উঠতেন। না জানি কী ছবি তুলতে সে গিয়েছে। কী না কী ভালো ছবি মিস হচ্ছে। এ কারণে একজন আরেকজনকে না দেখলেই টেনশনে পড়তেন। মোটরসাইকেল নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়তেন নতুন ছবির সন্ধানে। এখন ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়। ইন্টারনেটের কল্যাণে অন্যের সঙ্গে শেয়ারও হয়; কিন্তু তখন অনেক সময় ডেইলি ইভেন্টও শেয়ার করা হতো না।
সৃজনশীল ও মেধাবী হওয়ায় রশীদ ভাইয়ের ছবির মধ্যেও তার প্রভাব ফুটে উঠত। তার সাহসও ছিল অসম্ভব। একটা ঘটনা বললেই পাঠকরা বুঝতে পারবেন। মুক্তিযুদ্ধের একেবারেই শুরুতে, সম্ভবত ২৭ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী 'সংবাদ' ও 'পিপল' পত্রিকা দুটিতে আগুন দিয়েছে। খবর পেয়ে মুহূর্তেই তিনি আমাকে নিয়ে সেখানে ছুটে যান। দুঃখের সঙ্গে তিনি আমাকে বলেন, আমাদের বোধহয় সাংবাদিকতার 'আইডেনটি' থাকল না। ওই এলাকায় গিয়ে আর্মিদের চোখ ফাঁকি দিয়েই তিনি আগুনের ছবি তুলে নেন। আরেকটি ঘটনাও তার সাহস ও আমার প্রতি স্নেহের প্রমাণ দেয়। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রেস ক্লাবের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি চালালে চার-পাঁচজন মারা যান। ঘটনার ছবি তুলতে গিয়ে আমি নিজেও বুকের পাশে গুলিবিদ্ধ হই। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক রশীদ ভাই ক্ষেপে গিয়ে এক পুলিশ অফিসারের কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বলেন, 'তুই আমার ভাইকে গুলি করেছিস!'
রশিদ ভাই ছিলেন খুবই বন্ধুবৎসল। দীর্ঘদিন সংবাদ-এ কাজ করার সুবাদে বাম ঘরানার নেতাকর্মীরা তাকে আপনজন হিসেবেই দেখতেন। তবে সব রাজনৈতিক দলের নেতার কাছেই তিনি প্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুও তাকে ভালোবাসতেন। প্রথম দিকে রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে মাঝে মধ্যে আমিও বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতাম।
ছবি তুলতে অনেকবার আরিচা, জয়দেবপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীতেও তার ভেসপায় চেপে গিয়েছি। তখন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। সিরাজগঞ্জে বড় ধরনের রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা কীভাবে ওই ছবি তুলতে যাব? ভাবনায় পড়ে গেলাম। রশীদ ভাই দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে বললেন, 'দেখিস একটা পথ ঠিকই বাতলাব।' পরক্ষণেই গেলেন যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী সাহেবের কাছে। হেলিকপ্টারে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেও কাজ হলো না। আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে যাই। রশীদ ভাই বিষয়টি জানালে বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করে যোগাযোগমন্ত্রীকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়ার নির্দেশ দেন, সঙ্গে আমাদেরও নিয়ে যেতে বলেন। তাই সিরাজগঞ্জের দুর্ঘটনার ছবি ঠিকই পেয়ে যাই। যা তখন হেলিকপ্টার ছাড়া কোনোভাবেই আমাদের পক্ষে তোলা সম্ভব হতো না।
গণঅভ্যুত্থানের সেরা ছবিগুলোই রশিদ ভাইয়ের তোলা। আজ যেটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, সেখানে যুদ্ধের সময় একটি লাশ পড়ে ছিল, হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা। এমন অনেক ঐতিহাসিক ছবি রয়েছে। তার ভাণ্ডারে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গণহত্যার অসংখ্য ছবি। পেছনে বসে দেখতাম তিনি ভেসপা চালানোর সময়ও চারদিকে ছবি তোলার বিষয় খুঁজছেন। কোনোদিন তিনি ভালো ছবি পেয়েও যেতেন।
শুধু ছবি তোলার দক্ষ হাত নয়, তার একটা বিরল গুণও ছিল। শুরু থেকেই তোলা প্রতিটি নেগেটিভ ঘটনার বিবরণসহ ক্যাপশন ও তারিখ দিয়ে সংরক্ষণ করতেন। আজও সেগুলো আছে। তার কাছ থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যম ছবি নিয়ে ছাপত। টেলিভিশনেও দেখানো হতো। তিনি একালের ডিজিটাল সুবিধা খুব একটা পাননি। জীবনের শেষদিকে কিছুটা পেলেও কর্মজীবনের দীর্ঘ সময় ম্যানুয়াল ক্যামেরা দিয়েই কাজ করেছেন। দেশ স্বাধীনের পরপর এ দেশে দৈনিক বাংলা ও অবজারভার ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকায় নিজস্ব ল্যাব ছিল না। 'নেগেটিভ' প্রসেস এবং ছবি প্রিন্ট করার জন্য আমরা পল্টনের একটি স্টুডিওতে যেতাম। পরে আমাদের পত্রিকায় নিজস্ব ল্যাব হলে রশীদ ভাইয়ের কাছ থেকেই আমি নেগেটিভ প্রসেস ও সাদা-কালো ছবি প্রিন্ট করা শিখি। তখন এ দেশে রঙিন ছবির প্রচলন শুরু হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রপত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলেও তিনি ছবি তোলা বন্ধ করেননি। পুরানা পল্টনে তার এক বন্ধুর স্টুডিও দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। সেখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালান। পেশাদার ফটোসাংবাদিক হিসেবে ১৯৬২ সালে দৈনিক সংবাদ-এ যোগ দেন রশীদ তালুকদার। সেখান থেকে ১৯৭৫ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে এবং ২০০৭ সালে অবসরে যান।
বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন গঠনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ জন্য অবশ্য বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। রশীদ তালুকদার প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে 'পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড-২০১০' লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ৭৫টি দেশি-বিদেশি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শিক্ষিতরা যাতে ফটোসাংবাদিকতায় আসে, এ জন্য তিনি অনেককেই উৎসাহিত করেছেন। আমি যখন ২০০৮ সালে রয়টার্সের ক্যামেরাম্যান অব ইয়ারে ভূষিত হই, তখন শরীর ভালো না থাকা সত্ত্বেও রশীদ ভাই প্রেস ক্লাবে ছুটে এসে আমাকে শুভকামনা জানান।
আজ এই দুঃখের মুহূর্তে একটি মজার ঘটনাও মনে পড়ছে। একদিন আমরা গণভবন থেকে বের হলাম। তিনি ভেসপা স্টার্ট দিলেন; কিন্তু পেছনে ওঠার আগেই তার ভেসপা ছুটে চলল। তিনি বুঝতেই পারলেন না যে আমি উঠতে পারিনি। বাধ্য হয়ে আমি হাঁটা শুরু করলাম। কিছু সময় পর তিনি ফিরে এলেন। জানালেন, পাঁচ মিনিট ধরে তিনি কথা বলে চলেছেন। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পেছনে ফিরে দেখেন আমি নেই।
তাকে যে মানুষ কতটা ভালোবাসে তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। এবার তিনি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, খবর পেয়ে তাকে দেখতে ছুটে যাই। আমার বন্ধুসহ সবাইকে তার অসুস্থতার খবর জানাতে ফেসবুকে দিয়ে সবাইকে তার জন্য দোয়া করতে বলি। জবাবে অনেকে দোয়া কামনা করেন। আমাদের প্রিয় রশীদ ভাই এই দুনিয়া ছেড়ে গেলেও তার তোলা ছবি আর ভালোবাসা আমাদের ছেড়ে যাবে না কখনও।
রফিকুর রহমান :রয়টার্স টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান
রশীদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তদানীন্তন দৈনিক বাংলার মরহুম গোলাম মওলা ভাই। তবে পেশার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতাও ছিল। সকালে প্রেস ক্লাবে গিয়ে একজন আরেকজনকে না দেখলেই অস্থির হয়ে উঠতেন। না জানি কী ছবি তুলতে সে গিয়েছে। কী না কী ভালো ছবি মিস হচ্ছে। এ কারণে একজন আরেকজনকে না দেখলেই টেনশনে পড়তেন। মোটরসাইকেল নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়তেন নতুন ছবির সন্ধানে। এখন ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়। ইন্টারনেটের কল্যাণে অন্যের সঙ্গে শেয়ারও হয়; কিন্তু তখন অনেক সময় ডেইলি ইভেন্টও শেয়ার করা হতো না।
সৃজনশীল ও মেধাবী হওয়ায় রশীদ ভাইয়ের ছবির মধ্যেও তার প্রভাব ফুটে উঠত। তার সাহসও ছিল অসম্ভব। একটা ঘটনা বললেই পাঠকরা বুঝতে পারবেন। মুক্তিযুদ্ধের একেবারেই শুরুতে, সম্ভবত ২৭ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী 'সংবাদ' ও 'পিপল' পত্রিকা দুটিতে আগুন দিয়েছে। খবর পেয়ে মুহূর্তেই তিনি আমাকে নিয়ে সেখানে ছুটে যান। দুঃখের সঙ্গে তিনি আমাকে বলেন, আমাদের বোধহয় সাংবাদিকতার 'আইডেনটি' থাকল না। ওই এলাকায় গিয়ে আর্মিদের চোখ ফাঁকি দিয়েই তিনি আগুনের ছবি তুলে নেন। আরেকটি ঘটনাও তার সাহস ও আমার প্রতি স্নেহের প্রমাণ দেয়। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রেস ক্লাবের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি চালালে চার-পাঁচজন মারা যান। ঘটনার ছবি তুলতে গিয়ে আমি নিজেও বুকের পাশে গুলিবিদ্ধ হই। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক রশীদ ভাই ক্ষেপে গিয়ে এক পুলিশ অফিসারের কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বলেন, 'তুই আমার ভাইকে গুলি করেছিস!'
রশিদ ভাই ছিলেন খুবই বন্ধুবৎসল। দীর্ঘদিন সংবাদ-এ কাজ করার সুবাদে বাম ঘরানার নেতাকর্মীরা তাকে আপনজন হিসেবেই দেখতেন। তবে সব রাজনৈতিক দলের নেতার কাছেই তিনি প্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুও তাকে ভালোবাসতেন। প্রথম দিকে রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে মাঝে মধ্যে আমিও বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতাম।
ছবি তুলতে অনেকবার আরিচা, জয়দেবপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীতেও তার ভেসপায় চেপে গিয়েছি। তখন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। সিরাজগঞ্জে বড় ধরনের রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা কীভাবে ওই ছবি তুলতে যাব? ভাবনায় পড়ে গেলাম। রশীদ ভাই দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে বললেন, 'দেখিস একটা পথ ঠিকই বাতলাব।' পরক্ষণেই গেলেন যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী সাহেবের কাছে। হেলিকপ্টারে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেও কাজ হলো না। আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে যাই। রশীদ ভাই বিষয়টি জানালে বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করে যোগাযোগমন্ত্রীকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়ার নির্দেশ দেন, সঙ্গে আমাদেরও নিয়ে যেতে বলেন। তাই সিরাজগঞ্জের দুর্ঘটনার ছবি ঠিকই পেয়ে যাই। যা তখন হেলিকপ্টার ছাড়া কোনোভাবেই আমাদের পক্ষে তোলা সম্ভব হতো না।
গণঅভ্যুত্থানের সেরা ছবিগুলোই রশিদ ভাইয়ের তোলা। আজ যেটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, সেখানে যুদ্ধের সময় একটি লাশ পড়ে ছিল, হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা। এমন অনেক ঐতিহাসিক ছবি রয়েছে। তার ভাণ্ডারে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গণহত্যার অসংখ্য ছবি। পেছনে বসে দেখতাম তিনি ভেসপা চালানোর সময়ও চারদিকে ছবি তোলার বিষয় খুঁজছেন। কোনোদিন তিনি ভালো ছবি পেয়েও যেতেন।
শুধু ছবি তোলার দক্ষ হাত নয়, তার একটা বিরল গুণও ছিল। শুরু থেকেই তোলা প্রতিটি নেগেটিভ ঘটনার বিবরণসহ ক্যাপশন ও তারিখ দিয়ে সংরক্ষণ করতেন। আজও সেগুলো আছে। তার কাছ থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যম ছবি নিয়ে ছাপত। টেলিভিশনেও দেখানো হতো। তিনি একালের ডিজিটাল সুবিধা খুব একটা পাননি। জীবনের শেষদিকে কিছুটা পেলেও কর্মজীবনের দীর্ঘ সময় ম্যানুয়াল ক্যামেরা দিয়েই কাজ করেছেন। দেশ স্বাধীনের পরপর এ দেশে দৈনিক বাংলা ও অবজারভার ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকায় নিজস্ব ল্যাব ছিল না। 'নেগেটিভ' প্রসেস এবং ছবি প্রিন্ট করার জন্য আমরা পল্টনের একটি স্টুডিওতে যেতাম। পরে আমাদের পত্রিকায় নিজস্ব ল্যাব হলে রশীদ ভাইয়ের কাছ থেকেই আমি নেগেটিভ প্রসেস ও সাদা-কালো ছবি প্রিন্ট করা শিখি। তখন এ দেশে রঙিন ছবির প্রচলন শুরু হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রপত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলেও তিনি ছবি তোলা বন্ধ করেননি। পুরানা পল্টনে তার এক বন্ধুর স্টুডিও দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। সেখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালান। পেশাদার ফটোসাংবাদিক হিসেবে ১৯৬২ সালে দৈনিক সংবাদ-এ যোগ দেন রশীদ তালুকদার। সেখান থেকে ১৯৭৫ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে এবং ২০০৭ সালে অবসরে যান।
বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন গঠনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ জন্য অবশ্য বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। রশীদ তালুকদার প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে 'পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড-২০১০' লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ৭৫টি দেশি-বিদেশি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শিক্ষিতরা যাতে ফটোসাংবাদিকতায় আসে, এ জন্য তিনি অনেককেই উৎসাহিত করেছেন। আমি যখন ২০০৮ সালে রয়টার্সের ক্যামেরাম্যান অব ইয়ারে ভূষিত হই, তখন শরীর ভালো না থাকা সত্ত্বেও রশীদ ভাই প্রেস ক্লাবে ছুটে এসে আমাকে শুভকামনা জানান।
আজ এই দুঃখের মুহূর্তে একটি মজার ঘটনাও মনে পড়ছে। একদিন আমরা গণভবন থেকে বের হলাম। তিনি ভেসপা স্টার্ট দিলেন; কিন্তু পেছনে ওঠার আগেই তার ভেসপা ছুটে চলল। তিনি বুঝতেই পারলেন না যে আমি উঠতে পারিনি। বাধ্য হয়ে আমি হাঁটা শুরু করলাম। কিছু সময় পর তিনি ফিরে এলেন। জানালেন, পাঁচ মিনিট ধরে তিনি কথা বলে চলেছেন। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পেছনে ফিরে দেখেন আমি নেই।
তাকে যে মানুষ কতটা ভালোবাসে তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। এবার তিনি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, খবর পেয়ে তাকে দেখতে ছুটে যাই। আমার বন্ধুসহ সবাইকে তার অসুস্থতার খবর জানাতে ফেসবুকে দিয়ে সবাইকে তার জন্য দোয়া করতে বলি। জবাবে অনেকে দোয়া কামনা করেন। আমাদের প্রিয় রশীদ ভাই এই দুনিয়া ছেড়ে গেলেও তার তোলা ছবি আর ভালোবাসা আমাদের ছেড়ে যাবে না কখনও।
রফিকুর রহমান :রয়টার্স টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান
No comments