শিক্ষা-ভর্তিযুদ্ধ বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ঋতু এসেছে। যেসব ছেলেমেয়ে বাসায় খেলা করে সময় কাটিয়েছে, জীবনের প্রথম তাদের স্কুলে যেতে হবে; যদিও মাথাব্যথাটা তাদের নয়, মাথাব্যথা তাদের পিতামাতার। দেড় কোটি মানুষের রাজনীতিতে একটি উন্নয়ন-উন্নয়নশীল দেশে জোগানের থেকে চাহিদা বেশি হবেই, আর শিক্ষাঙ্গনে তো তা অধিকতর সত্য, তা না হলে কি আর আমরা উন্নয়নশীল হই? প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিও একসময় যুদ্ধসম ছিল, যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে খুদে সেনারা ধরতে পারত না, কেন তাদের পিতামাতার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা।
বর্তমান সরকার অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আর ছোট ছেলেমেয়েদের দুর্বোধ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। লটারির মাধ্যমে ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এখন এই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার জন্য, ভর্তি নিয়ে পিতামাতার ভোগান্তি কমানোর জন্য একটি সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। সে বিষয়টি নিয়েই একটি প্রস্তাব উত্থাপন করছি।
রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান এবং প্রথম শ্রেণীর আসনসংখ্যার পরিসংখ্যান নিয়ে একটি ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। এ ডেটাবেজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ব্যানবেইজে থাকতে পারে। এবার ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রদের জন্য তাদের অভিভাবকেরা পর্যাপ্ত অফিশিয়াল কাগজপত্রের রেফারেন্সসহ (যেমন—জন্মসনদ, বাসস্থান, পড়ুয়া ভাইবোনদের বিদ্যালয় ইত্যাদি) অনলাইনে দরখাস্ত করবেন গ্রহণযোগ্যতার ক্রমানুসারে বিদ্যালয়ের তালিকা দিয়ে। তারপর আসনসংখ্যার সমানসংখ্যক আবেদনপত্র লটারির মাধ্যমে বের করে আনতে হবে। এবার এই নতুন তালিকার (লটারিতে বিজয়ী) ছাত্রছাত্রীদের গ্রহণযোগ্য বিদ্যালয় ও তার বাসস্থান থেকে বিদ্যালয়ের নৈকট্য এবং অধ্যয়নরত ভাইবোনদের বিদ্যালয়ের তালিকার ওপর ভিত্তি করে কোন বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তার নাম দেওয়া হবে। বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যত অপশন দেওয়া হবে, অভিভাবকদের দুর্ভোগ ততই বৃদ্ধি পাবে। তাই মাত্রাতিরিক্ত গণতান্ত্রিক অধিকারচর্চা করার মতো সমৃদ্ধ ভৌত অবকাঠামো যেহেতু আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি, তাই এ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। এভাবে সারা রাজধানীর ভর্তি-ব্যবস্থা সমন্বিতভাবে সমাধান করলে অভিভাবকেরা নানা দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাবেন। গুটিকয়েক মানসম্পন্ন স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করাতে পিতামাতারা মরিয়া হয়ে যান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশে যখন আমরা পর্যাপ্তসংখ্যক ভালো স্কুল তৈরি করতে পারিনি এই দুর্ভোগও আমাদেরই পোহাতে হবে। আশা করি, এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় এলাকায় এলাকায় ভালো ভালো স্কুল-কলেজ তৈরি হবে, এলাকায় এলাকায় শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির বিষয় শুধু রাজধানী কেন ছোট-বড় শহরের জন্যও করা যেতে পারে; যাতে করে সারা দেশের ছেলেমেয়েরা, অভিভাবকেরা স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ পান। ফলে অভিভাবকেরা হয়রানি, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থেকে রেহাই পাবেন। একই সঙ্গে ছেলেমেয়েরা যৌক্তিক দূরত্বের স্কুলে ভর্তি হওয়ার ফলে রাজধানীর যানজট বৃদ্ধিতে কম অবদান রাখবে। ভারতের মতোই একটি ছেলেমেয়েকে কোন স্কুলে দেওয়া যেতে পারে, তার জন্য তার স্কুলগামী ভাইবোনদের স্কুলে ভর্তির জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের একটি ভর্তিপদ্ধতি গ্রহণ করলে অবশ্যই দূর-দূরান্তরে থাকা ছাত্রছাত্রীদের দূরে অবস্থিত নামকরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না হলেও ওই আসনগুলোতে অপেক্ষাকৃত কাছে বসবাসকারী আমাদের দেশের নাগরিকেরাই সুযোগ পাবেন।
এরপর ভর্তিসংক্রান্ত আরও যে বড় সমস্যা আমরা মোকাবিলা করি তা হলো, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের বয়স প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো না হলেও বিশেষ করে ছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে অভিভাবকেরা অসম্ভব দুর্ভোগ পোহান। এ সপ্তাহে রাজশাহী, তার পরের দিন চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ইত্যাদি করা অসম্ভব প্রায়। একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য অবশ্যই আমাদের চেষ্টা করা উচিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য একটি সমন্বিত পরীক্ষা স্যাট (স্কলাস্টিক অ্যাপ্টিচিউড টেস্ট অধুনা স্কলাস্টিক অ্যাসেসমেন্ট টেস্ট এবং বর্তমানে এর কোনো স্বীকৃত পূর্ণাঙ্গরূপ নেই) ১৯২৬ সাল থেকে চালু আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য স্কুলের গ্রেডের সঙ্গে স্যাটের স্কোর বিবেচনা করা হয়। এটা লক্ষ করা গেছে যে স্কুলের গ্রেড এবং স্যাটের স্কোর সম্মিলিতভাবে প্রথম বর্ষের গ্রেডের সঙ্গে অত্যন্ত ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। অবশ্য স্যাট ছাড়াও এসিটি (আমেরিকান কলেজ টেস্টিং) বিশেষ করে আমেরিকার মধ্যাঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জনপ্রিয়। স্যাটের স্কোর দিয়ে শুধু আমেরিকায় নয়, বিভিন্ন দেশের যোগ্যতর ছাত্রদের বিভিন্ন নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়।
স্যাটের তিনটি অংশ পড়া, গণিত ও লেখার দক্ষতা যাচাই। ৮০-৯০ বছরের ইতিহাসে ছাত্রদের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করে স্যাটের কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০০৫ সালে স্যাটের যুক্তি পরীক্ষার সূচনা হয়েছে। তিনটি অংশের পরীক্ষা ৮০০ করে ২৪০০-এর মধ্যে স্কোর করা হয়। তিন ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের এই টেস্টে মোট ১০ সেকশনে প্রশ্ন থাকে। এখানে যেমন নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন থাকে, ঠিক তেমনি গ্রাফনির্ভর প্রশ্ন। সর্বশেষে ২০০৮ সালে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে ছাত্রদের পারফরম্যান্স বিবেচনায় রেখে স্যাট নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হচ্ছে এবং টেস্টকে সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। ভারতের নামকরা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিসমূহে ভর্তির জন্য রয়েছে জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সামিনেশন। ১২-১৪টি আইআইটিতে ভর্তির জন্য আলাদা আলাদা পরীক্ষা দিতে হলে ভোগান্তির অভাব হতো না। সুতরাং ছাত্র ও অভিভাবকদের ভোগান্তি হ্রাসের কথা মাথায় রেখে তারা একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। যানজটে বিধ্বস্ত রাজধানী ও ভঙ্গুর রাস্তাব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অবিভাবকদের যাতে দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, তার জন্য সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য স্যাট এর অনুরূপ একটি সাধারণ পরীক্ষা। তা ছাড়া প্রকৌশল, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন, কৃষি বিষয়ে পড়ার জন্য বিষয়ভিত্তিক স্যাট পরীক্ষা আয়োজন করা যেতে পারে। স্যাটের স্কোর এবং স্কুলের গ্রেড দেখে এমআইটি, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, বার্কলের মতো জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। আমরাও এ ধরনের পরীক্ষা আমাদের ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্র ও অভিভাবকদের ভোগান্তি হ্রাস করে তাদের প্রতি, দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ব বোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাই।
তা ছাড়া এ ধরনের একটি পক্ষপাতিত্বহীন টেস্ট পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে পাবলিক পরীক্ষাসমূহের প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়নের যথার্থতাকেও ক্রসচেক করা সম্ভব হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষ নিয়ে এখনো বলার মতো কিছু নেই।
আমাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য যে খুদে ছেলেমেয়েরা অথবা তাদের অভিভাবকেরা অপেক্ষা করে আছেন, তাদের একটি সমন্বিত ভর্তিপ্রক্রিয়া সূচনার মাধ্যমে নানা উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও ভোগান্তি থেকে মুক্ত করা উচিত। একইভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তির প্রক্রিয়াও সমন্বিত করে শিক্ষার্থীদের একটি স্বচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পছন্দমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া দরকার। এ কাজটি আমাদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও মমত্ববোধ থেকে এখনই করা উচিত।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান এবং প্রথম শ্রেণীর আসনসংখ্যার পরিসংখ্যান নিয়ে একটি ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। এ ডেটাবেজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ব্যানবেইজে থাকতে পারে। এবার ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রদের জন্য তাদের অভিভাবকেরা পর্যাপ্ত অফিশিয়াল কাগজপত্রের রেফারেন্সসহ (যেমন—জন্মসনদ, বাসস্থান, পড়ুয়া ভাইবোনদের বিদ্যালয় ইত্যাদি) অনলাইনে দরখাস্ত করবেন গ্রহণযোগ্যতার ক্রমানুসারে বিদ্যালয়ের তালিকা দিয়ে। তারপর আসনসংখ্যার সমানসংখ্যক আবেদনপত্র লটারির মাধ্যমে বের করে আনতে হবে। এবার এই নতুন তালিকার (লটারিতে বিজয়ী) ছাত্রছাত্রীদের গ্রহণযোগ্য বিদ্যালয় ও তার বাসস্থান থেকে বিদ্যালয়ের নৈকট্য এবং অধ্যয়নরত ভাইবোনদের বিদ্যালয়ের তালিকার ওপর ভিত্তি করে কোন বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তার নাম দেওয়া হবে। বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যত অপশন দেওয়া হবে, অভিভাবকদের দুর্ভোগ ততই বৃদ্ধি পাবে। তাই মাত্রাতিরিক্ত গণতান্ত্রিক অধিকারচর্চা করার মতো সমৃদ্ধ ভৌত অবকাঠামো যেহেতু আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি, তাই এ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। এভাবে সারা রাজধানীর ভর্তি-ব্যবস্থা সমন্বিতভাবে সমাধান করলে অভিভাবকেরা নানা দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাবেন। গুটিকয়েক মানসম্পন্ন স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করাতে পিতামাতারা মরিয়া হয়ে যান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশে যখন আমরা পর্যাপ্তসংখ্যক ভালো স্কুল তৈরি করতে পারিনি এই দুর্ভোগও আমাদেরই পোহাতে হবে। আশা করি, এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় এলাকায় এলাকায় ভালো ভালো স্কুল-কলেজ তৈরি হবে, এলাকায় এলাকায় শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির বিষয় শুধু রাজধানী কেন ছোট-বড় শহরের জন্যও করা যেতে পারে; যাতে করে সারা দেশের ছেলেমেয়েরা, অভিভাবকেরা স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ পান। ফলে অভিভাবকেরা হয়রানি, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থেকে রেহাই পাবেন। একই সঙ্গে ছেলেমেয়েরা যৌক্তিক দূরত্বের স্কুলে ভর্তি হওয়ার ফলে রাজধানীর যানজট বৃদ্ধিতে কম অবদান রাখবে। ভারতের মতোই একটি ছেলেমেয়েকে কোন স্কুলে দেওয়া যেতে পারে, তার জন্য তার স্কুলগামী ভাইবোনদের স্কুলে ভর্তির জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের একটি ভর্তিপদ্ধতি গ্রহণ করলে অবশ্যই দূর-দূরান্তরে থাকা ছাত্রছাত্রীদের দূরে অবস্থিত নামকরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না হলেও ওই আসনগুলোতে অপেক্ষাকৃত কাছে বসবাসকারী আমাদের দেশের নাগরিকেরাই সুযোগ পাবেন।
এরপর ভর্তিসংক্রান্ত আরও যে বড় সমস্যা আমরা মোকাবিলা করি তা হলো, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের বয়স প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো না হলেও বিশেষ করে ছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে অভিভাবকেরা অসম্ভব দুর্ভোগ পোহান। এ সপ্তাহে রাজশাহী, তার পরের দিন চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ইত্যাদি করা অসম্ভব প্রায়। একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য অবশ্যই আমাদের চেষ্টা করা উচিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য একটি সমন্বিত পরীক্ষা স্যাট (স্কলাস্টিক অ্যাপ্টিচিউড টেস্ট অধুনা স্কলাস্টিক অ্যাসেসমেন্ট টেস্ট এবং বর্তমানে এর কোনো স্বীকৃত পূর্ণাঙ্গরূপ নেই) ১৯২৬ সাল থেকে চালু আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য স্কুলের গ্রেডের সঙ্গে স্যাটের স্কোর বিবেচনা করা হয়। এটা লক্ষ করা গেছে যে স্কুলের গ্রেড এবং স্যাটের স্কোর সম্মিলিতভাবে প্রথম বর্ষের গ্রেডের সঙ্গে অত্যন্ত ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। অবশ্য স্যাট ছাড়াও এসিটি (আমেরিকান কলেজ টেস্টিং) বিশেষ করে আমেরিকার মধ্যাঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জনপ্রিয়। স্যাটের স্কোর দিয়ে শুধু আমেরিকায় নয়, বিভিন্ন দেশের যোগ্যতর ছাত্রদের বিভিন্ন নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়।
স্যাটের তিনটি অংশ পড়া, গণিত ও লেখার দক্ষতা যাচাই। ৮০-৯০ বছরের ইতিহাসে ছাত্রদের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করে স্যাটের কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০০৫ সালে স্যাটের যুক্তি পরীক্ষার সূচনা হয়েছে। তিনটি অংশের পরীক্ষা ৮০০ করে ২৪০০-এর মধ্যে স্কোর করা হয়। তিন ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের এই টেস্টে মোট ১০ সেকশনে প্রশ্ন থাকে। এখানে যেমন নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন থাকে, ঠিক তেমনি গ্রাফনির্ভর প্রশ্ন। সর্বশেষে ২০০৮ সালে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে ছাত্রদের পারফরম্যান্স বিবেচনায় রেখে স্যাট নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হচ্ছে এবং টেস্টকে সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। ভারতের নামকরা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিসমূহে ভর্তির জন্য রয়েছে জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সামিনেশন। ১২-১৪টি আইআইটিতে ভর্তির জন্য আলাদা আলাদা পরীক্ষা দিতে হলে ভোগান্তির অভাব হতো না। সুতরাং ছাত্র ও অভিভাবকদের ভোগান্তি হ্রাসের কথা মাথায় রেখে তারা একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। যানজটে বিধ্বস্ত রাজধানী ও ভঙ্গুর রাস্তাব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অবিভাবকদের যাতে দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, তার জন্য সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য স্যাট এর অনুরূপ একটি সাধারণ পরীক্ষা। তা ছাড়া প্রকৌশল, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন, কৃষি বিষয়ে পড়ার জন্য বিষয়ভিত্তিক স্যাট পরীক্ষা আয়োজন করা যেতে পারে। স্যাটের স্কোর এবং স্কুলের গ্রেড দেখে এমআইটি, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, বার্কলের মতো জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। আমরাও এ ধরনের পরীক্ষা আমাদের ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্র ও অভিভাবকদের ভোগান্তি হ্রাস করে তাদের প্রতি, দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ব বোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাই।
তা ছাড়া এ ধরনের একটি পক্ষপাতিত্বহীন টেস্ট পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে পাবলিক পরীক্ষাসমূহের প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়নের যথার্থতাকেও ক্রসচেক করা সম্ভব হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষ নিয়ে এখনো বলার মতো কিছু নেই।
আমাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য যে খুদে ছেলেমেয়েরা অথবা তাদের অভিভাবকেরা অপেক্ষা করে আছেন, তাদের একটি সমন্বিত ভর্তিপ্রক্রিয়া সূচনার মাধ্যমে নানা উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও ভোগান্তি থেকে মুক্ত করা উচিত। একইভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তির প্রক্রিয়াও সমন্বিত করে শিক্ষার্থীদের একটি স্বচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পছন্দমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া দরকার। এ কাজটি আমাদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও মমত্ববোধ থেকে এখনই করা উচিত।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments