ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান হয়েও... by আসিফ আহমদ

ষাটের দশকে আইয়ুব খানের জমানায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ ছিল কার্যত ক্ষমতাহীন। দেশের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে এবং প্রদেশের ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত দুই গভর্নরের হাতে। গভর্নর কতক্ষণ ক্ষমতায় থাকবেন, তা নির্ভর করত প্রেসিডেন্টের মর্জির ওপর।


প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের কাছে দায়ী ছিলেন না, প্রাদেশিক পরিষদও গভর্নরের কাছে জবাবদিহি চাইতে পারত না। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ছিল আইয়ুব খানের মুসলিম লীগের দখলে। এ দুটি পরিষদের সদস্যরা 'বিডি মেম্বার' দ্বারা নির্বাচিত হতেন, যাদের অনেককেই সামরিক শাসকদের দল আইয়ুব খানের মুসলিম লীগ কিনে নিতে পারত। উভয় পরিষদে বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। কিন্তু তারপরও পরিষদে তাদের কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। বিরোধী সদস্যরা যা বলতেন, সেটা ঢাকার ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ও অবজারভারে ফলাও করে ছাপা হতো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিপুলসংখ্যক অধিবাসী এ জন্য বিরোধীদলীয় সদস্যদের বাহবা দিত। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে জনপ্রিয় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মালেক উকিল, আহমদুল কবির, নিরোদ নাগসহ আরও কয়েকজন। কেন্দ্রে জাতীয় পরিষদে মিজানুর রহমান চৌধুরী, মশিউর রহমান যাদু মিয়াসহ কয়েকজন এমএনএ আইয়ুব খানের শাসনের কড়া সমালোচনা করতেন। সে সময় জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদের আনা কোনো প্রস্তাবই গৃহীত হতো না, কিন্তু তাদের বক্তব্য ও মতামত গুরুত্ব পেত জনগণের কাছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠবে, এমনটিই প্রত্যাশা ছিল। প্রথম সংসদে বিরোধী সদস্য ছিল ৮-১০ জন। তারা একটানা সংসদ বর্জনের কথা ভাবেননি। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের অধীনে ১৯৭৯ সালে যে নির্বাচন হয় তাতে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সদস্য ছিল মাত্র ৩৯ জন। কিন্তু তারা সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারে তাদের কোনো প্রস্তাব গৃহীত হতো না। কিন্তু জনগণ তা গুরুত্ব দিত। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয় আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। এ নির্বাচনের ফল বেতার ও টেলিভিশনে ঘোষণা হতে থাকায় ধারণা হচ্ছিল যে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে চলেছে। এ অবস্থায় হঠাৎ করেই ফল ঘোষণা স্থগিত হয়ে যায় এবং পরে নির্বাচন কমিশন যে ফল ঘোষণা করে তাতে দেখা যায়, এইচএম এরশাদের দল জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে ২০০-এর বেশি আসন পেয়েছে।
অনেক আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে ফের যায়। সংসদের হাতেই সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা। এরপর কয়েকটি সাধারণ নির্বাচন হয়েছে এবং নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এমন অবস্থাতেও জাতীয় সংসদ আর কার্যকর নেই। নবম সংসদে বিরোধীদলীয় সদস্য সংখ্যা খুব কম। কিন্তু আগের দুই-তিনটি সংসদে তারা ছিলেন যথেষ্ট সংখ্যায়। কিন্তু তাদের কণ্ঠ আর শোনা যায় না।
বিরোধীরা টানা সংসদ বর্জনের রেওয়াজ চালু করেছেন। সরকারি দলের সদস্যরাও অনেকে সংসদে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন মনে করেন না। টেলিভিশনে সংসদ অধিবেশন সরাসরি দেখানো হয়। দেখা যায়, সরকারি দলের বেশিরভাগ আসন শূূন্য। আর বিরোধীরা তো সংসদেই নেই। তাদের কেবল দাবি আর দাবি। তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন না, কিন্তু সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রেও বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখেন না। আর সরকার পক্ষও বিরোধীদের সংসদে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। বিরোধীরা যেহেতু সংসদে যায় না, সংবাদপত্র এবং বেতার-টেলিভিশনও সংসদ কার্যক্রমের বিষয়ে তেমন আগ্রহ দেখায় না। সংসদে কী হচ্ছে, সে বিষয়ে জনগণেরও কি উৎসাহ আছে? সরকারি দলের সদস্যরা এ প্রশ্নের ভালো উত্তর দিতে পারবেন।
 

No comments

Powered by Blogger.