চিকিৎসাসেবায় ইতিবাচক উদ্যোগ-প্রতিক্রিয়া by এবিএম আবদুল্লাহ
গত ১১ অক্টোবর সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় 'চিকিৎসা ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ সম্পূর্ণ হতে চলেছে' শীর্ষক একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে। বদরুদ্দীন উমরের লেখা কলামটি পড়ে আমার ও চিকিৎসকদের অনেকের উপলব্ধি হয়েছে যে, তার এই লেখাটি একতরফা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল ধারণাপ্রসূত।
লেখার শুরুতেই তিনি অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হলেও 'বাংলাদেশের জনগণের জন্য কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে তা বলা যাবে না।' এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, উন্নত চিকিৎসাগুলো খুব ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় তা সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে। অর্থাৎ আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসাগুলো ব্যয়বহুল বিধায় আমাদের দেশে কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থাই নেই। মোটা দাগে হুট করে এমন চরম সিদ্ধান্ত টানার আগে আমাদের একটু বিষয়টার গভীরে গিয়ে বাস্তব অবস্থাটা চিন্তা করা দরকার। দেশের জনগণের জন্য, বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যসেবার কী কী ব্যবস্থা আছে, কী কী নেই এবং তা কোন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তা বোঝা প্রয়োজন। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বিপুল কিন্তু সম্পদ সীমিত। চিকিৎসক-নার্সের সংখ্যা অপ্রতুল, অবকাঠামো সীমিত। এর মাঝেও সরকার স্বাস্থ্য খাতে যে সেবা দিয়ে যাচ্ছে তা নেহাত ফেল না নয়। হাজার হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে মূলত দরিদ্র রোগীদের নামমাত্র মূল্যে সেবা দেওয়া হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দিনরাত চিকিৎসাসেবা চলছে। এখানে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ অনেক কম, চিকিৎসকের জন্য কোনো ফি নেই বললেই চলে। সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক আধুনিক, জটিল ও ব্যয়বহুল চিকিৎসাও দরিদ্রদের প্রায় বিনামূল্যে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সরকারের মূল বিনিয়োগ রোগ প্রতিরোধের দিকে। শিশুদের টিকাদান, ভিটামিন-এ খাওয়ানো, আয়োডিনের অভাব দূরীকরণ, নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু হার কমানো, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়ন_ এসব ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য সর্বজনস্বীকৃত এবং আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এগুলোর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। চিকিৎসা খাতে সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড জনগণের মূল অংশের কথা চিন্তা করেই পরিচালিত হয়। স্বাস্থ্য বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় অপুষ্টি, ডায়রিয়া, কৃমি প্রতিরোধ, আর্সেনিক প্রতিরোধ_ এ ধরনের খাতে মেদভুঁড়ি কমানোর জন্য নয়। জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের ভূমিকা পর্যালোচনা করতে হলে শুধু কতগুলো হাসপাতাল তৈরি হলো, নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলো কি-না, বড় বড় অপারেশন বিনামূল্যে করা হলো কি-না এসব না দেখে আমাদের বরং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলোকেই মূল্যায়ন করা উচিত। শেষ পর্যন্ত ধনী-গরিব নির্বিশেষে আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে এদের ভূমিকাই প্রধান।
আগেই বলেছি, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি এবং রোগীও বেশি। দরিদ্র জনগণের সব চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা করা আছে এমন দাবি আমি করছি না। কিন্তু নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই তা ঠিক নয়। আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসার কথা ভিন্ন। চিকিৎসা বিজ্ঞান যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে সারাবিশ্বেই চিকিৎসার খরচ ক্রমেই আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে। ধনী দেশগুলোর সরকারের পক্ষেও এসব উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে উঠছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশেও অনেকেই আজকাল বিকল্প চিকিৎসার দিকে ঝুঁকছেন শুধু চিকিৎসার মাত্রাতিরিক্ত খরচের কথা চিন্তা করে। সেই তুলনায় আমাদের দেশে চিকিৎসার খরচ অনেক কম। একেবারেই বিনামূল্যে সব চিকিৎসা দেওয়া গেলে তো ভালোই হতো; কিন্তু বাস্তবের জমিনে দাঁড়িয়ে তা কি সম্ভব? সরকার তার সীমিত বাজেট নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে জনগণ অন্তত গ্রহণযোগ্য স্তরের চিকিৎসাসেবা পায়। কিন্তু সব উন্নত চিকিৎসা সবাইকেই বিনামূল্যে দেওয়া যাবে এমন আশা কতটা যৌক্তিক?
আমরা স্বাস্থ্যসেবার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এখনও পেঁৗছাতে পারিনি। প্রতিটি নাগরিকের জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স আমরা তৈরি করতে পারিনি, সব ওষুধ সবসময় সব রোগীকে বিনামূল্যে দিতে পারছি না, সব হাসপাতালে সবসময় চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারিনি, সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার উচ্চমান নিশ্চিত করতে পারিনি_ এমন অনেক অপ্রাপ্তি আমাদের আছে। এর পেছনে আছে আমাদের দারিদ্র্য, দক্ষ জনবলের অভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতাসহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি। কিন্তু যে কাজগুলো হচ্ছে তার স্বীকৃতি তো দেওয়া দরকার। লেখক সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার বিনিময়ে ফি নেওয়ার সমালোচনা করেছেন এবং অভিযোগ করেছেন, এতে নাকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাহলে বাণিজ্য কে করছেন? সরকার? সরকারই যদি বাণিজ্য করে তবে এত কোটি কোটি টাকা দিয়ে হাজার হাজার কমিউনিটি হাসপাতাল পরিচালনা করছে কে? এতগুলো সরকারি চিকিৎসক-নাসের বেতন দিচ্ছে কে? রোগ নির্ণয়ে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, প্রতিরোধে প্রচার, সহায়তা সব ক্ষেত্রে এত ভর্তুকি দিচ্ছে কে? সত্য বটে, সরকার কুলিয়ে উঠতে পারছে না। স্বাস্থ্য খাতে বিপুল খরচের ধাক্কা সামলাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নামমাত্র ফি নেওয়া হচ্ছে। আগেই বলেছি, এর কারণ আমাদের জনসংখ্যার বিপুল চাপ। আর তাই সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি খাত। তারা জনগণের একটি অংশ যারা খরচ করতে সক্ষম, তাদের সেবা দেওয়ার মাধ্যমে সরকারের ভার কিছুটা তো লাঘব হচ্ছে। অন্যথায় তারা ঠিকই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতেন।
লেখক শ্রেণীবৈষম্যের কথা বলেছেন। একই দেশের নাগরিক হয়ে কেউ পাঁচ তারকা হোটেলের মতো পরিবেশে জ্বরের চিকিৎসা করবেন আর কেউ হাসপাতালের মাটিয়ে শুয়ে শেষ নিঃশ্বাস নেবেন_ এই দৃশ্য নিতান্তই অমানবিক। যারা একটু অবস্থাপন্ন তারা সাধারণত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নেন না, বেসরকারিভাবে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। ব্যবসায়ীদের ব্যাপক বিনিয়োগের ফলে এই বেসরকারি খাত এখন যথেষ্ট উন্নত, আধুনিক। কিন্তু দরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় যেটুকু কমতি তার জন্য তো বেসরকারি হাসপাতাল দায়ী নয়। বরং দেশের জনগণের একটি অংশের চিকিৎসাসেবার দায়িত্ব নিয়ে তারা সরকারের ভারটাই কমিয়ে দিচ্ছেন।
লেখক তার কলমের মূল আঘাতটা এনেছেন সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হওয়া বৈকালিক স্পেশালিস্ট সার্ভিসটির ওপর। এই সার্ভিসের আওতায় সরকারি ছুটির দিন ছাড়া অন্যান্য দিন বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত রোগীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বিভাগে ২০০ টাকা ফির বিনিময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন। একবার টিকিট কিনলে একই বিভাগে এক মাস পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যাবে। লেখক এই ২০০ টাকার মধ্যে 'বাণিজ্য' খুঁজে পেয়েছেন। দেখা যাক এই 'বাণিজ্য' না করলে কী হতো? একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যদি এখানে রোগী না দেখে একই সময় নিজের চেম্বারে রোগী দেখেন তবে তিনি প্রতি রোগী থেকে কমপক্ষে ৫০০ টাকা আয় করতে পারেন। আর বৈকালিক এই সার্ভিসে রোগী দেখে তিনি পাবেন মাত্র ১০০ টাকা! অর্থাৎ চিকিৎসকের জন্য ৪০০ টাকা ক্ষতি। কোনো কোনো অধ্যাপকের চেম্বারের ফি আরও বেশি, তাদের ক্ষতির পরিমাণও তেমন বেশি। এই ব্যবস্থা যদি 'বাণিজ্য' হয় তবে এর চেয়ে ক্ষতিকর বাণিজ্য আর কী হতে পারে? অবশ্য এই সার্ভিসের বাকি ১০০ টাকার একাংশ পাবেন সংশিল্গষ্ট কর্মচারীরা, যার দ্বারা তারা কিছুটা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। দরিদ্র কর্মচারীদের কিছুটা আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া নিশ্চয় বাণিজ্য হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে না। সামান্য অংশ যাবে হাসপাতালের তহবিলে, যা ভবিষ্যতে এই হাসপাতালেরই কাজে আসবে, এখানে যারা সেবা পান তাদের কাজেই ব্যয় হবে। মনে রাখা দরকার, এ হাসপাতাল সরকারি হাসপাতাল নয়, বরং স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতাল। এখানে হাসপাতাল পরিচালনার যে ব্যয় তার একটি বড় অংশ কর্তৃপক্ষকেই জোগাড় করতে হয়।
এসব কর্মকাণ্ড অন্যায় হতো যদি দরিদ্রদের জন্য যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয় তা বন্ধ করে নতুন সেবা চালু করা হতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা তো বন্ধ করা হয়নি। বরং আগের অবস্থা বহাল রেখে হাসপাতালে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে টিকিটের দাম ৩০ টাকা, যা দিয়ে যে কোনো বিভাগে যতদিন খুশি দেখানো যায়। এখানে সাধারণ চিকিৎসকদের পাশাপাশি ক্ষেত্রভেদে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক বা বিশেষজ্ঞরাও রোগী দেখে থাকেন। নতুন প্রবর্তিত সেবাটি দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালের অফিস টাইমের পরে। আগেই বলেছি এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের কিছু আয় হলেও বিশেষজ্ঞদের জন্য তা আর্থিক ক্ষতিরই নামান্তর। সাধারণ জনগণ যারা চাইলেও বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন না, তাদের জন্যই এই সার্ভিস চালু করা হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞরা সীমিত আকারে হলেও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে সেবাগ্রহীতারা সেবা পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা দ্রুত আরও নতুন নতুন বিভাগে এ ধরনের সেবাদানের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেছেন।
চমৎকার এই ব্যবস্থার মূল কৃতিত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণগোপাল দত্ত ও তার সুযোগ্য প্রশাসনের। বেসরকারি খাতের উন্নয়ন কিংবা অফিস টাইমের পরে চিকিৎসকের প্র্যাকটিস, কোনোটাই সরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা প্রদানের অন্তরায় নয়। বরং অবকাঠামোর অভাব, পর্যাপ্ত লোকবল ও ওষুধের অভাব এখানে মূল সমস্যা। এর সঙ্গে যদি চিকিৎসক বা সংশিল্গষ্ট কারও গাফিলতি থাকে তবে তা অবশ্যই দণ্ডনীয়। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ এবং তার যথাযথ ব্যবহার, দক্ষ লোকবল গড়ে তোলা আর তাদের কর্মক্ষেত্রে যথাযথ সেবা প্রদান নিশ্চিত করা_ এসব দাবি তোলাই যায়। কিন্তু বেসরকারিভাবে কিংবা অফিস টাইমের বাইরে সামান্য অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসাসেবা দিলে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাই নীতিহীনতায় পর্যবসিত হবে এমন চিন্তা অমূলক।
উপসংহারে লেখক বলেছেন, 'সব রকম সরকারি ভর্তুকি প্রত্যাহার করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এখন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।' তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সবিনয়ে জানাতে চাই যে, এই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। চিকিৎসা ক্ষেত্রে যত সামান্য ব্যয় বাড়লেও সব ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়নি এবং বর্তমানে দেশের বাস্তব অবস্থায় এই পরিস্থিতিকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আশানুরূপ উন্নতি না হলেও একেবারে ভয়াবহ বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
ডা. এবিএম আবদুল্লাহ : ডিন, মেডিসিন অনুষদ অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
আগেই বলেছি, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি এবং রোগীও বেশি। দরিদ্র জনগণের সব চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা করা আছে এমন দাবি আমি করছি না। কিন্তু নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই তা ঠিক নয়। আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসার কথা ভিন্ন। চিকিৎসা বিজ্ঞান যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে সারাবিশ্বেই চিকিৎসার খরচ ক্রমেই আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে। ধনী দেশগুলোর সরকারের পক্ষেও এসব উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে উঠছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশেও অনেকেই আজকাল বিকল্প চিকিৎসার দিকে ঝুঁকছেন শুধু চিকিৎসার মাত্রাতিরিক্ত খরচের কথা চিন্তা করে। সেই তুলনায় আমাদের দেশে চিকিৎসার খরচ অনেক কম। একেবারেই বিনামূল্যে সব চিকিৎসা দেওয়া গেলে তো ভালোই হতো; কিন্তু বাস্তবের জমিনে দাঁড়িয়ে তা কি সম্ভব? সরকার তার সীমিত বাজেট নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে জনগণ অন্তত গ্রহণযোগ্য স্তরের চিকিৎসাসেবা পায়। কিন্তু সব উন্নত চিকিৎসা সবাইকেই বিনামূল্যে দেওয়া যাবে এমন আশা কতটা যৌক্তিক?
আমরা স্বাস্থ্যসেবার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এখনও পেঁৗছাতে পারিনি। প্রতিটি নাগরিকের জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স আমরা তৈরি করতে পারিনি, সব ওষুধ সবসময় সব রোগীকে বিনামূল্যে দিতে পারছি না, সব হাসপাতালে সবসময় চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারিনি, সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার উচ্চমান নিশ্চিত করতে পারিনি_ এমন অনেক অপ্রাপ্তি আমাদের আছে। এর পেছনে আছে আমাদের দারিদ্র্য, দক্ষ জনবলের অভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতাসহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি। কিন্তু যে কাজগুলো হচ্ছে তার স্বীকৃতি তো দেওয়া দরকার। লেখক সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার বিনিময়ে ফি নেওয়ার সমালোচনা করেছেন এবং অভিযোগ করেছেন, এতে নাকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাহলে বাণিজ্য কে করছেন? সরকার? সরকারই যদি বাণিজ্য করে তবে এত কোটি কোটি টাকা দিয়ে হাজার হাজার কমিউনিটি হাসপাতাল পরিচালনা করছে কে? এতগুলো সরকারি চিকিৎসক-নাসের বেতন দিচ্ছে কে? রোগ নির্ণয়ে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, প্রতিরোধে প্রচার, সহায়তা সব ক্ষেত্রে এত ভর্তুকি দিচ্ছে কে? সত্য বটে, সরকার কুলিয়ে উঠতে পারছে না। স্বাস্থ্য খাতে বিপুল খরচের ধাক্কা সামলাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নামমাত্র ফি নেওয়া হচ্ছে। আগেই বলেছি, এর কারণ আমাদের জনসংখ্যার বিপুল চাপ। আর তাই সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি খাত। তারা জনগণের একটি অংশ যারা খরচ করতে সক্ষম, তাদের সেবা দেওয়ার মাধ্যমে সরকারের ভার কিছুটা তো লাঘব হচ্ছে। অন্যথায় তারা ঠিকই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতেন।
লেখক শ্রেণীবৈষম্যের কথা বলেছেন। একই দেশের নাগরিক হয়ে কেউ পাঁচ তারকা হোটেলের মতো পরিবেশে জ্বরের চিকিৎসা করবেন আর কেউ হাসপাতালের মাটিয়ে শুয়ে শেষ নিঃশ্বাস নেবেন_ এই দৃশ্য নিতান্তই অমানবিক। যারা একটু অবস্থাপন্ন তারা সাধারণত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নেন না, বেসরকারিভাবে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। ব্যবসায়ীদের ব্যাপক বিনিয়োগের ফলে এই বেসরকারি খাত এখন যথেষ্ট উন্নত, আধুনিক। কিন্তু দরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় যেটুকু কমতি তার জন্য তো বেসরকারি হাসপাতাল দায়ী নয়। বরং দেশের জনগণের একটি অংশের চিকিৎসাসেবার দায়িত্ব নিয়ে তারা সরকারের ভারটাই কমিয়ে দিচ্ছেন।
লেখক তার কলমের মূল আঘাতটা এনেছেন সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হওয়া বৈকালিক স্পেশালিস্ট সার্ভিসটির ওপর। এই সার্ভিসের আওতায় সরকারি ছুটির দিন ছাড়া অন্যান্য দিন বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত রোগীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বিভাগে ২০০ টাকা ফির বিনিময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন। একবার টিকিট কিনলে একই বিভাগে এক মাস পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যাবে। লেখক এই ২০০ টাকার মধ্যে 'বাণিজ্য' খুঁজে পেয়েছেন। দেখা যাক এই 'বাণিজ্য' না করলে কী হতো? একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যদি এখানে রোগী না দেখে একই সময় নিজের চেম্বারে রোগী দেখেন তবে তিনি প্রতি রোগী থেকে কমপক্ষে ৫০০ টাকা আয় করতে পারেন। আর বৈকালিক এই সার্ভিসে রোগী দেখে তিনি পাবেন মাত্র ১০০ টাকা! অর্থাৎ চিকিৎসকের জন্য ৪০০ টাকা ক্ষতি। কোনো কোনো অধ্যাপকের চেম্বারের ফি আরও বেশি, তাদের ক্ষতির পরিমাণও তেমন বেশি। এই ব্যবস্থা যদি 'বাণিজ্য' হয় তবে এর চেয়ে ক্ষতিকর বাণিজ্য আর কী হতে পারে? অবশ্য এই সার্ভিসের বাকি ১০০ টাকার একাংশ পাবেন সংশিল্গষ্ট কর্মচারীরা, যার দ্বারা তারা কিছুটা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। দরিদ্র কর্মচারীদের কিছুটা আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া নিশ্চয় বাণিজ্য হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে না। সামান্য অংশ যাবে হাসপাতালের তহবিলে, যা ভবিষ্যতে এই হাসপাতালেরই কাজে আসবে, এখানে যারা সেবা পান তাদের কাজেই ব্যয় হবে। মনে রাখা দরকার, এ হাসপাতাল সরকারি হাসপাতাল নয়, বরং স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতাল। এখানে হাসপাতাল পরিচালনার যে ব্যয় তার একটি বড় অংশ কর্তৃপক্ষকেই জোগাড় করতে হয়।
এসব কর্মকাণ্ড অন্যায় হতো যদি দরিদ্রদের জন্য যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয় তা বন্ধ করে নতুন সেবা চালু করা হতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা তো বন্ধ করা হয়নি। বরং আগের অবস্থা বহাল রেখে হাসপাতালে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে টিকিটের দাম ৩০ টাকা, যা দিয়ে যে কোনো বিভাগে যতদিন খুশি দেখানো যায়। এখানে সাধারণ চিকিৎসকদের পাশাপাশি ক্ষেত্রভেদে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক বা বিশেষজ্ঞরাও রোগী দেখে থাকেন। নতুন প্রবর্তিত সেবাটি দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালের অফিস টাইমের পরে। আগেই বলেছি এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের কিছু আয় হলেও বিশেষজ্ঞদের জন্য তা আর্থিক ক্ষতিরই নামান্তর। সাধারণ জনগণ যারা চাইলেও বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন না, তাদের জন্যই এই সার্ভিস চালু করা হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞরা সীমিত আকারে হলেও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে সেবাগ্রহীতারা সেবা পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা দ্রুত আরও নতুন নতুন বিভাগে এ ধরনের সেবাদানের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেছেন।
চমৎকার এই ব্যবস্থার মূল কৃতিত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণগোপাল দত্ত ও তার সুযোগ্য প্রশাসনের। বেসরকারি খাতের উন্নয়ন কিংবা অফিস টাইমের পরে চিকিৎসকের প্র্যাকটিস, কোনোটাই সরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা প্রদানের অন্তরায় নয়। বরং অবকাঠামোর অভাব, পর্যাপ্ত লোকবল ও ওষুধের অভাব এখানে মূল সমস্যা। এর সঙ্গে যদি চিকিৎসক বা সংশিল্গষ্ট কারও গাফিলতি থাকে তবে তা অবশ্যই দণ্ডনীয়। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ এবং তার যথাযথ ব্যবহার, দক্ষ লোকবল গড়ে তোলা আর তাদের কর্মক্ষেত্রে যথাযথ সেবা প্রদান নিশ্চিত করা_ এসব দাবি তোলাই যায়। কিন্তু বেসরকারিভাবে কিংবা অফিস টাইমের বাইরে সামান্য অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসাসেবা দিলে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাই নীতিহীনতায় পর্যবসিত হবে এমন চিন্তা অমূলক।
উপসংহারে লেখক বলেছেন, 'সব রকম সরকারি ভর্তুকি প্রত্যাহার করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এখন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।' তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সবিনয়ে জানাতে চাই যে, এই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। চিকিৎসা ক্ষেত্রে যত সামান্য ব্যয় বাড়লেও সব ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়নি এবং বর্তমানে দেশের বাস্তব অবস্থায় এই পরিস্থিতিকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আশানুরূপ উন্নতি না হলেও একেবারে ভয়াবহ বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
ডা. এবিএম আবদুল্লাহ : ডিন, মেডিসিন অনুষদ অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
No comments