কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতাদের সমালোচনা করে বলেছেন, সরকারের ব্যর্থতার কথা বলে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন না। সরকারের সাফল্যের কথা প্রচার না করে ব্যর্থতার কথা বলায় তিনি বিরক্তিও প্রকাশ করেছেন। গণমাধ্যমে, বিশেষ করে প্রতি রাতের টক শোগুলোতে 'বাকুমবুকুম' টকারদের কথাবার্তার ব্যাপারে তিনি অখুশি।
পত্রপত্রিকার তথাকথিত বিজ্ঞ কলামিস্টদের ব্যাপারেও নিশ্চয় একই প্রতিক্রিয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। এটা অযৌক্তিক কিংবা অস্বাভাবিক নয়। এই যে আড়াই বছরে তাঁর সরকার ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াল, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করল, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো, দেশে বাংলা ভাইয়ের মতো জঙ্গিদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দিল না এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে জঙ্গিবাদ দমনে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধুদেশগুলোর সঙ্গে সমানে সমান কাজ করে সুনাম অর্জন করল, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়াল, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা হলো, অসাধারণ এক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করল, সংস্কৃতিচর্চায় রেকর্ড পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিল_এগুলো সম্পর্কে এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে দারিদ্র্য দূর করা, পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক ভূমিকা পালন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পক্ষে সত্যকথনের পরিমাণ কম। এটা দুঃখজনকও বটে। অথচ কত না জ্ঞানীজন, কত না বড় বড় বোলচাল! কিন্তু কলম হাতে নিলে অথবা টিভি ক্যামেরার সামনে বসলেই তাঁরা অদ্ভুত রকমের নিরপেক্ষ হয়ে যান। এটাও ভালো ওটাও ভালো জাতীয় কথা বলে কালক্ষেপণ করেন। তবে হ্যাঁ, এসব জ্ঞানীজনকে সংগঠিত করে সরকার, দল কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সাফল্যের কথা দেশে ও বিদেশে প্রচার করানোর কাজটি গত আড়াই বছরে এটা ঠিক যে গুছিয়ে করা হয়নি। এ ব্যাপারে পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও মনে হয় না। উল্টো দিকে সরকার, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ যথেষ্ট গুছিয়ে কাজ করে চলেছে। তাদের একটা নিজস্ব সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী আছে, যারা পত্রিকায় কলাম লিখে এবং টক শোতে জোরালো কণ্ঠে কথা বলে সাধারণ মানুষকে নিয়মিত বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল এদের সব রকম সহযোগিতাও দিয়ে থাকে। সরকারের সফলতার বিবরণ যথার্থভাবে দেশে-বিদেশে তুলে ধরার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনার কথা বহুবার বলেছি। আরো কেউ কেউ বলেছেন, কাজ হয়নি। কাজ হয় না। তাই প্রধানমন্ত্রী যখন টেলিভিশন ও পত্রিকার অবান্তর সমালোচনায় বিরক্ত হন, তখন খুব একটা আশ্চর্য হই না। সরকার এবং আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ও নেতারা এ ব্যাপারে গত আড়াই বছরে কাজের কাজ খুব একটা করতে পারেননি। বিদেশে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। তার পরও যেটুকু হয়েছে-হয়, তা একেবারেই যার যার নিজস্ব তাগিদে। পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপার সেখানে নেই বললেই চলে। বর্তমান সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রে যেসব টেলিভিশনের অনুমতি দিয়েছে, তারা যেন সবাই ব্যবসাকেই তাদের আরাধ্য হিসেবে মনে করছে। কেবল বিটিভি দিয়ে যে কাজের কাজ কিছুই হবে না, এটা নতুন করে বলার দরকার নেই। বিটিভি তো সরকারের ভাঙা ঢাক_এটা সাধারণ মানুষ এতই বুঝে গেছে যে সেখানে সত্য কথা বললেও মানুষ গুরুত্বসহকারে নেয় না। তবে সময় শেষ হয়ে যায়নি। পরিকল্পিত উদ্যোগে সব কিছু ঠিকঠাক করে ফেলা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। তবে এর দায়িত্ব নিতে হবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি এ ব্যাপারে একটি কার্যকর সেল তৈরি করতে পারেন। কাজের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের পথ তিনিই বাতলে দেবেন। মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকতে পারেন একজন বিশ্বস্ত ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তিত্ব, যিনি দিন বা সপ্তাহান্তে কাজের প্রতিবেদন দেবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলো এই কাজে ভালো ফল দেখাতে পারেনি অথবা সবার কাজের ভেতর সমন্বয়ও তৈরি হয়নি। কাজটা অনেকটা গেরিলা যুদ্ধকৌশলের মতো। ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়, এ ধরনের কাজ করতে হবে নীরবে ও নিভৃতে। বেছে নিতে হবে নির্লোভ নিরহংকার, আধুনিকমনস্ক, বঙ্গবন্ধুভক্তদের, যাঁদের অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র দর্শন চিরস্থায়ী এবং যাঁরা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে নিয়ে উচ্চাভিলাষী।
আমাদের একটি পুরনো সমস্যা আছে। তা হলো সরকারের সফলতার কথা সব সময় সেই পুরনো ধাঁচে প্রচার করা হয়। সাধারণ মানুষ সেই কথাগুলোকে গৎবাঁধা প্রোপাগান্ডা হিসেবে ধরে নিয়ে গুরুত্ব কম দেয়। সরকারের মন্ত্রী কিংবা দলের নেতারাও মানুষের সামনে বিষয়গুলো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেন না। নারীনীতি, শিক্ষানীতি নিয়ে যখন ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা হৈচৈ করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করল, তখন আমার এ রকমই মনে হয়েছে। আসলে নেতাদের বুঝতে হবে, কেবল ভোটের জন্য রাজনীতি করলেই হবে না; করতে হবে মানুষের মঙ্গলের রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনীতিবিদদের রাজনীতি তো হবে সে রকমই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী সরকারের সমালোচনা করে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেও ভয়ের কিছু নেই। বিরোধীরা তাদের নিজের হাতে অস্ত্র চালাতেই যেখানে ব্যর্থ, সেখানে নতুন অস্ত্র ব্যবহার করার মতো সবল সংগঠন তাদের নেই। আড়াই বছরে তারা এমন কোনো ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, যাতে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছে। তবে আগেই বলেছি, তাদের প্রচার কর্মকাণ্ড খারাপ নয়। সুকৌশলে মিথ্যাকে সত্য বলায় যথেষ্ট পারদর্শী তারা। পরিবর্তে সাফল্যের প্রকৃত সত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সরকার ও দলের পক্ষে যারা, তারা যেন কেমন এলোমেলো।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমাদের একটি পুরনো সমস্যা আছে। তা হলো সরকারের সফলতার কথা সব সময় সেই পুরনো ধাঁচে প্রচার করা হয়। সাধারণ মানুষ সেই কথাগুলোকে গৎবাঁধা প্রোপাগান্ডা হিসেবে ধরে নিয়ে গুরুত্ব কম দেয়। সরকারের মন্ত্রী কিংবা দলের নেতারাও মানুষের সামনে বিষয়গুলো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেন না। নারীনীতি, শিক্ষানীতি নিয়ে যখন ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা হৈচৈ করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করল, তখন আমার এ রকমই মনে হয়েছে। আসলে নেতাদের বুঝতে হবে, কেবল ভোটের জন্য রাজনীতি করলেই হবে না; করতে হবে মানুষের মঙ্গলের রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনীতিবিদদের রাজনীতি তো হবে সে রকমই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী সরকারের সমালোচনা করে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেও ভয়ের কিছু নেই। বিরোধীরা তাদের নিজের হাতে অস্ত্র চালাতেই যেখানে ব্যর্থ, সেখানে নতুন অস্ত্র ব্যবহার করার মতো সবল সংগঠন তাদের নেই। আড়াই বছরে তারা এমন কোনো ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, যাতে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছে। তবে আগেই বলেছি, তাদের প্রচার কর্মকাণ্ড খারাপ নয়। সুকৌশলে মিথ্যাকে সত্য বলায় যথেষ্ট পারদর্শী তারা। পরিবর্তে সাফল্যের প্রকৃত সত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সরকার ও দলের পক্ষে যারা, তারা যেন কেমন এলোমেলো।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments