জ্বালানি-কয়লা না ওঠানোর সিদ্ধান্ত সঠিক নয় by বদরূল ইমাম
প্রধানমন্ত্রী দেশের মাটির তলায় বিদ্যমান কয়লা উত্তোলন না করে বরং আমদানিকৃত কয়লা ব্যবহার করার কথা বলেছেন। বিষয়টি ইতিমধ্যেই জনগণের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অবশ্য ওই বক্তব্যটি কি সরকারি সিদ্ধান্ত, না কেবল তাঁর বা তাঁর পরামর্শকদের নিজস্ব মত, তা স্পষ্ট নয়।
কারণ, কয়লাবিষয়ক সরকারি প্রশাসন কার্যক্রমের পক্ষ থেকে দেশের নিজস্ব কয়লা উত্তোলন না করার পক্ষে কোনো বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি বা দেশের কয়লানীতি চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে এখনো এ ধরনের কোনো নীতি প্রণীত হয়নি। দেশের কয়লানীতি প্রণয়নের কাজ সুদীর্ঘ সময় যাবৎ চলমান হলেও তা কখন চূড়ান্তভাবে প্রণীত হবে বা প্রকাশিত হবে, তার কোনো হদিস পাওয়া দুরূহ। দেশের সরকারি সূত্রসমূহ একাধিকবার তাদের বক্তব্যে অতি শিগগিরই কয়লানীতি চূড়ান্তকরণের আশ্বাস দিয়ে থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কেবল তা-ই নয়, কয়লানীতিটি চূড়ান্তকরণের পরিবর্তে ইতিমধ্যে প্রণীত খসড়া কয়লানীতি বারবার পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও যাচাই-বাছাই করার নামে একের পর এক কমিটির কাছে হস্তান্তর করা হতে থাকছে।
অথচ ২০০৭ সালে সর্ববিষয়ক বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করে সরকার নির্ধারিত যে বিশেষজ্ঞ কমিটি কয়লার খসড়া নীতি প্রণয়ন করে, তা দেশের সকল শ্রেণী বা পক্ষের মততে বিবেচনা করেই করা হয়। তাতে দেশের কয়লা সম্পদ আহরণে রক্ষণশীল হওয়ার যেমন পরামর্শ দেওয়া হয়, একইভাবে দেশের জ্বালানি সংকটের বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে প্রতিটি কয়লা খনি এলাকার জন্য আলাদাভাবে জরিপ করে সর্বোত্তম ও সর্বজন স্বীকৃত খনন পদ্ধতি (ভূগর্ভস্থ কিংবা উন্মুক্ত পদ্ধতি) নির্ধারণের পরামর্শ দেয়।
পরবর্তী সময়ে দেশের গ্যাসসংকট আরও অধিক ঘনীভূত হয়ে পড়লে সব মহলই দেশে বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যাপক ব্যবহারের অনিবার্যতাকে স্বীকার করে। কেবল তা-ই নয়, সরকারি মহলেও এটি ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় যে দেশে আবিষ্কৃত নিজস্ব কয়লা সম্পদ উত্তোলন করে মোট কয়লার চাহিদার বড় অংশ (বাকি কয়লা আমদানিকৃত হয়ে থাকলে) জোগান দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কয়লার চাহিদার পুরো অংশ আমদানি করা হলে তা অতি ব্যয়সাপেক্ষ হবে এবং তাতে দেশের অর্থনীতিতে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর একটি নমুনা আমরা দেখতে পাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ চালুর নেতিবাচক প্রভাবের মাধ্যমে। আগে থেকে তেল আমদানি খাতে বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে আসছে। কিন্তু তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে দেশে প্রতিবছর বাড়তি তেল আমদানি করতে হয়, যার কারণে মোট তেল আমদানি খরচ বছরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটিতে পৌঁছায়। আর এই বাড়তি খরচের ভার সরকার নিজে সামাল দিতে না পেরে অনিবার্য কারণবশত তেলের ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে থাকে, যার পুরো ভার জনগণকে বহন করতে হয়।
একইভাবে দেশের নিজস্ব কয়লা ব্যাপক বা সাধ্যমতো ব্যবহার না করে কেবল আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে সরকার পরিকল্পিত ব্যাপক বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে দেশের অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমান বাজারে নিজস্ব কয়লা উত্তোলন করলে টনপ্রতি যেখানে খরচ হবে ১১০ ডলার, সেখানে বাইরে থেকে কয়লা আমদানি করলে কয়লার জন্য খরচ হবে টনপ্রতি ১৬০ থেকে ১৭০ ডলার। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে উৎপাদনে যেতে আরও অন্তত চার বছর লাগবে এবং তখন কয়লার আন্তর্জাতিক মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই তুলনামূলক কম মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের যে পরিকল্পনা করছে, আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তা ছাড়া আমদানিকৃত কয়লাবাহী জাহাজসমূহ বর্তমানে দেশের সমুদ্রবন্দরসমূহে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে ভিড়তে পারবে না এবং তাই বন্দর অবকাঠামো তৈরিতেও বিরাট বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।
তাহলে প্রধানমন্ত্রী কেন দেশের কয়লা ব্যবহার না করার পরামর্শ বা সিদ্ধান্তের কথা বলছেন? পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী যতটা না দেশের জ্বালানি সমস্যার বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনেছেন, তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনাকে। দেশের নির্বাচন হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসার কারণে সম্ভবত একপক্ষ জনগণের বিতর্ককে বা ক্ষোভকে জাগিয়ে তোলার সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা থেকে এটি বলা হয়েছে। কিন্তু খতিয়ে দেখলে বিষয়টি কি ইঙ্গিত দেয়?
এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশের ভূগর্ভে কয়লা মজুদসমূহ যে পরিবেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা কয়লা খননের জন্য সর্বোত্তম নয়। বিশেষ করে উন্মুক্ত পদ্ধতির খনন করতে গেলে কয়লা স্তরের ওপর পানিবাহী নরম বালুস্তর খননকাজে ব্যাঘাত ঘটাবে, যদিও অনেক খনি বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অন্যান্য স্থানে স্থাপিত খনির মতো এখানে উন্মুক্ত খনি স্থাপন সম্ভব। তবে খনি এলাকার জনগণের মধ্যে এ নিয়ে চরম বিরোধিতা রয়েছে। কেবল পানি ব্যবস্থাপনাই নয়, কয়লা মজুদ এলাকাসমূহ ঘনবসতিপূর্ণ এবং তা সুফলা উর্বর কৃষিজমিও বটে। উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হিসেবে জনগণকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করে পুরো জমি খননের পরিকল্পনা থাকে, যা কিনা কয়লা এলাকার জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য। তাই ২০০৬ সালে এশিয়া এনার্জি কোম্পানি ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি স্থাপন করতে গেলে জনগণ তা রুখতে গিয়ে সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ও কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটে। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও আমলে এনে কয়লা এলাকার জনগণের পক্ষে উন্মুক্ত খননের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
উন্মুক্ত খননের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা কমিটি সর্বাপেক্ষা সোচ্চার থাকে। কেবল তা-ই নয়, বরং উন্মুক্ত খনি বিরোধিতায় এটির আক্রমণাত্মক মনোভাব সহজেই খনি এলাকার জনগণের সুনজর কাড়ে। তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা কমিটি কয়লা খননে উন্মুক্ত পদ্ধতির পরিবর্তে ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতিকে সমর্থন জানিয়ে আসে।
বাংলাদেশে কেবল একটি ভূগর্ভস্থ কয়লা খনি (বড়পুকুরিয়া) চালু আছে। এটির কর্মকাণ্ড একটি চীনা কোম্পানির কারিগরি নির্দেশনায় পরিচালিত হয়ে আসছে। বিগত পাঁচ বছরের অধিক সময়ে এ খনিটি কার্যকর থাকাকালীন যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা হলো ভূগর্ভে যে স্থানে কয়লা কেটে উত্তোলন করা হয়েছে, তার ওপরে অবস্থিত জমি দেবে যাওয়া (সাবসিডেন্স)। এর ফলে লোকজনের বাসস্থানে যেমন ফাটল ধরাসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে, তেমন কৃষিজমি পানিবদ্ধ হয়ে চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। বড়পুকুরিয়া ভূগর্ভস্থ কয়লা খনির সমস্যা ও তার নেতিবাচক প্রভাব তাই ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। অপর যে বিষয়টি ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে তা হলো ভূগর্ভস্থ কয়লা খনি থেকে ১০ বা ২০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা যায় মাত্র।
চীনা কারিগরি নির্দেশনায় পরিচালিত বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি মোটেই ভূগর্ভস্থ খনির উপযুক্ত মডেল নয়। চীনা কোম্পানি যে পদ্ধতিতে কয়লা তুলছে, তাতে বহু ফাঁক বা অসংগতি রয়েছে। বড়পুকুরিয়ায় কয়লা তোলার জন্য জমি দেবে গিয়ে কৃষিজমির যে ক্ষতি হয়েছে, তা মোটেই অবশ্যম্ভাবী ছিল না বরং চীনা কোম্পানির ভুল পদক্ষেপের জন্য তা ঘটেছে। যদি কয়লা উত্তোলন করে ভূগর্ভের সে স্থানটি বালু বা ওই জাতীয় বস্তু দিয়ে ভরে দেওয়া হতো (যাকে স্যান্ড স্টোয়িং কারিগরি বলা হয়) তাহলে জমি দেবে যাওয়ার সমস্যা থাকত না। একইভাবে উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করলে ভূগর্ভস্থ খনি থেকে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে চীনা কোম্পানি কেন স্যান্ড স্টোয়িং (বালু ভরাটকরণ) করেনি? এটি সম্ভবত এ কারণে যে ছয় বছর আগে যখন বড়পুকুরিয়া খনি চালু হয়, তখন কয়লার দাম ছিল টনপ্রতি ৫০ ডলারের মতো, যার কারণে বালু ভরাটকরণের ব্যয় বহন করা লাভজনক ছিল না। কিন্তু বর্তমান বাজারে কয়লার যে মূল্য তা বালুভরাটকরণকে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব করবে। বিশ্বের বহু স্থানে ভূগর্ভস্থ কয়লা খনিতে বালু ভরাটকরণ পদ্ধতি চালু আছে, যার কোনো কোনোটিতে খনি থেকে ৫০ বা ৬০ কিলোমিটার দূরবর্তী নদীর বালু পাইপ লাইন দিয়ে টেনে এনে এ কাজে লাগানো হচ্ছে। এ পদ্ধতি বড়পুকুরিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
প্রধানমন্ত্রীর কারিগরি উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে তাঁকে বিষয়সমূহ সম্যক অবহিত করা হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি তাঁর দলগত বা রাষ্ট্রগত কারণে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত উল্টোমুখী ফল বয়ে আনতে পারে। দেশের বিদ্যুৎ বা জ্বালানি সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু দেশের কয়লা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের পরিণতি আগামী দিনে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে, তা রাজনৈতিকভাবে সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে।
ড. বদরূল ইমাম: ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অথচ ২০০৭ সালে সর্ববিষয়ক বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করে সরকার নির্ধারিত যে বিশেষজ্ঞ কমিটি কয়লার খসড়া নীতি প্রণয়ন করে, তা দেশের সকল শ্রেণী বা পক্ষের মততে বিবেচনা করেই করা হয়। তাতে দেশের কয়লা সম্পদ আহরণে রক্ষণশীল হওয়ার যেমন পরামর্শ দেওয়া হয়, একইভাবে দেশের জ্বালানি সংকটের বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে প্রতিটি কয়লা খনি এলাকার জন্য আলাদাভাবে জরিপ করে সর্বোত্তম ও সর্বজন স্বীকৃত খনন পদ্ধতি (ভূগর্ভস্থ কিংবা উন্মুক্ত পদ্ধতি) নির্ধারণের পরামর্শ দেয়।
পরবর্তী সময়ে দেশের গ্যাসসংকট আরও অধিক ঘনীভূত হয়ে পড়লে সব মহলই দেশে বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যাপক ব্যবহারের অনিবার্যতাকে স্বীকার করে। কেবল তা-ই নয়, সরকারি মহলেও এটি ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় যে দেশে আবিষ্কৃত নিজস্ব কয়লা সম্পদ উত্তোলন করে মোট কয়লার চাহিদার বড় অংশ (বাকি কয়লা আমদানিকৃত হয়ে থাকলে) জোগান দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কয়লার চাহিদার পুরো অংশ আমদানি করা হলে তা অতি ব্যয়সাপেক্ষ হবে এবং তাতে দেশের অর্থনীতিতে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর একটি নমুনা আমরা দেখতে পাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ চালুর নেতিবাচক প্রভাবের মাধ্যমে। আগে থেকে তেল আমদানি খাতে বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে আসছে। কিন্তু তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে দেশে প্রতিবছর বাড়তি তেল আমদানি করতে হয়, যার কারণে মোট তেল আমদানি খরচ বছরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটিতে পৌঁছায়। আর এই বাড়তি খরচের ভার সরকার নিজে সামাল দিতে না পেরে অনিবার্য কারণবশত তেলের ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে থাকে, যার পুরো ভার জনগণকে বহন করতে হয়।
একইভাবে দেশের নিজস্ব কয়লা ব্যাপক বা সাধ্যমতো ব্যবহার না করে কেবল আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে সরকার পরিকল্পিত ব্যাপক বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে দেশের অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমান বাজারে নিজস্ব কয়লা উত্তোলন করলে টনপ্রতি যেখানে খরচ হবে ১১০ ডলার, সেখানে বাইরে থেকে কয়লা আমদানি করলে কয়লার জন্য খরচ হবে টনপ্রতি ১৬০ থেকে ১৭০ ডলার। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে উৎপাদনে যেতে আরও অন্তত চার বছর লাগবে এবং তখন কয়লার আন্তর্জাতিক মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই তুলনামূলক কম মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের যে পরিকল্পনা করছে, আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তা ছাড়া আমদানিকৃত কয়লাবাহী জাহাজসমূহ বর্তমানে দেশের সমুদ্রবন্দরসমূহে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে ভিড়তে পারবে না এবং তাই বন্দর অবকাঠামো তৈরিতেও বিরাট বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।
তাহলে প্রধানমন্ত্রী কেন দেশের কয়লা ব্যবহার না করার পরামর্শ বা সিদ্ধান্তের কথা বলছেন? পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী যতটা না দেশের জ্বালানি সমস্যার বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনেছেন, তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনাকে। দেশের নির্বাচন হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসার কারণে সম্ভবত একপক্ষ জনগণের বিতর্ককে বা ক্ষোভকে জাগিয়ে তোলার সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা থেকে এটি বলা হয়েছে। কিন্তু খতিয়ে দেখলে বিষয়টি কি ইঙ্গিত দেয়?
এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশের ভূগর্ভে কয়লা মজুদসমূহ যে পরিবেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা কয়লা খননের জন্য সর্বোত্তম নয়। বিশেষ করে উন্মুক্ত পদ্ধতির খনন করতে গেলে কয়লা স্তরের ওপর পানিবাহী নরম বালুস্তর খননকাজে ব্যাঘাত ঘটাবে, যদিও অনেক খনি বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অন্যান্য স্থানে স্থাপিত খনির মতো এখানে উন্মুক্ত খনি স্থাপন সম্ভব। তবে খনি এলাকার জনগণের মধ্যে এ নিয়ে চরম বিরোধিতা রয়েছে। কেবল পানি ব্যবস্থাপনাই নয়, কয়লা মজুদ এলাকাসমূহ ঘনবসতিপূর্ণ এবং তা সুফলা উর্বর কৃষিজমিও বটে। উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হিসেবে জনগণকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করে পুরো জমি খননের পরিকল্পনা থাকে, যা কিনা কয়লা এলাকার জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য। তাই ২০০৬ সালে এশিয়া এনার্জি কোম্পানি ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি স্থাপন করতে গেলে জনগণ তা রুখতে গিয়ে সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ও কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটে। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও আমলে এনে কয়লা এলাকার জনগণের পক্ষে উন্মুক্ত খননের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
উন্মুক্ত খননের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা কমিটি সর্বাপেক্ষা সোচ্চার থাকে। কেবল তা-ই নয়, বরং উন্মুক্ত খনি বিরোধিতায় এটির আক্রমণাত্মক মনোভাব সহজেই খনি এলাকার জনগণের সুনজর কাড়ে। তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা কমিটি কয়লা খননে উন্মুক্ত পদ্ধতির পরিবর্তে ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতিকে সমর্থন জানিয়ে আসে।
বাংলাদেশে কেবল একটি ভূগর্ভস্থ কয়লা খনি (বড়পুকুরিয়া) চালু আছে। এটির কর্মকাণ্ড একটি চীনা কোম্পানির কারিগরি নির্দেশনায় পরিচালিত হয়ে আসছে। বিগত পাঁচ বছরের অধিক সময়ে এ খনিটি কার্যকর থাকাকালীন যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা হলো ভূগর্ভে যে স্থানে কয়লা কেটে উত্তোলন করা হয়েছে, তার ওপরে অবস্থিত জমি দেবে যাওয়া (সাবসিডেন্স)। এর ফলে লোকজনের বাসস্থানে যেমন ফাটল ধরাসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে, তেমন কৃষিজমি পানিবদ্ধ হয়ে চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। বড়পুকুরিয়া ভূগর্ভস্থ কয়লা খনির সমস্যা ও তার নেতিবাচক প্রভাব তাই ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। অপর যে বিষয়টি ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে তা হলো ভূগর্ভস্থ কয়লা খনি থেকে ১০ বা ২০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা যায় মাত্র।
চীনা কারিগরি নির্দেশনায় পরিচালিত বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি মোটেই ভূগর্ভস্থ খনির উপযুক্ত মডেল নয়। চীনা কোম্পানি যে পদ্ধতিতে কয়লা তুলছে, তাতে বহু ফাঁক বা অসংগতি রয়েছে। বড়পুকুরিয়ায় কয়লা তোলার জন্য জমি দেবে গিয়ে কৃষিজমির যে ক্ষতি হয়েছে, তা মোটেই অবশ্যম্ভাবী ছিল না বরং চীনা কোম্পানির ভুল পদক্ষেপের জন্য তা ঘটেছে। যদি কয়লা উত্তোলন করে ভূগর্ভের সে স্থানটি বালু বা ওই জাতীয় বস্তু দিয়ে ভরে দেওয়া হতো (যাকে স্যান্ড স্টোয়িং কারিগরি বলা হয়) তাহলে জমি দেবে যাওয়ার সমস্যা থাকত না। একইভাবে উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করলে ভূগর্ভস্থ খনি থেকে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে চীনা কোম্পানি কেন স্যান্ড স্টোয়িং (বালু ভরাটকরণ) করেনি? এটি সম্ভবত এ কারণে যে ছয় বছর আগে যখন বড়পুকুরিয়া খনি চালু হয়, তখন কয়লার দাম ছিল টনপ্রতি ৫০ ডলারের মতো, যার কারণে বালু ভরাটকরণের ব্যয় বহন করা লাভজনক ছিল না। কিন্তু বর্তমান বাজারে কয়লার যে মূল্য তা বালুভরাটকরণকে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব করবে। বিশ্বের বহু স্থানে ভূগর্ভস্থ কয়লা খনিতে বালু ভরাটকরণ পদ্ধতি চালু আছে, যার কোনো কোনোটিতে খনি থেকে ৫০ বা ৬০ কিলোমিটার দূরবর্তী নদীর বালু পাইপ লাইন দিয়ে টেনে এনে এ কাজে লাগানো হচ্ছে। এ পদ্ধতি বড়পুকুরিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
প্রধানমন্ত্রীর কারিগরি উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে তাঁকে বিষয়সমূহ সম্যক অবহিত করা হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি তাঁর দলগত বা রাষ্ট্রগত কারণে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত উল্টোমুখী ফল বয়ে আনতে পারে। দেশের বিদ্যুৎ বা জ্বালানি সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু দেশের কয়লা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের পরিণতি আগামী দিনে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে, তা রাজনৈতিকভাবে সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে।
ড. বদরূল ইমাম: ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments