বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডের ইস্যুতে তোলপাড় ভারতের রাজনীতি by আহমেদ জামিল
সম্প্রতি বেশক’টি রাজ্যে লোকসভার উপনির্বাচন, রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন এবং এর আগে লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি রাজনৈতিকভাবে মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। এই পটভূমিতে গত ২৪ নভেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত লিবারহান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি নেতৃত্ব বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।
এই ইস্যুতে ভারতের রাজনীতিও বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং তার রেশ এখনও কাটেনি। বাবরি মসজিদ ধ্বংস সম্পর্কে লিবারহান কমিশনের রিপোর্টে ৪৮ জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টির জন্য বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে মি. ক্লিনম্যান ও বামপন্থী বলে পরিচিত বিজেপি’র অন্যতম নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির নামও রয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ১৬ শতকে নির্মিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে বিজেপি এবং তার সংঘপরিবারভুক্ত উগ্রপন্থী হিন্দুরা। এই ঘটনার ১০ দিন পর তদন্তের জন্য সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি লিবারহানের নেতৃত্বে ‘লিবারহান কমিশন’ গঠন করা হয়। দীর্ঘ ১৭ বছর পর চলতি বছরের ৩০ জুন কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। মূল আলোচনা শুরুর আগে একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। ২০০১ সালের এপ্রিলে বিজেপির অন্যতম কট্টরপন্থী নেতা এবং তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আদভানি ঘোষণা করেছিলেন, বাবরি মসজিদ বাস্তবে এবং আইনগতভাবে একটি মন্দির এবং সেখানে কোনো মসজিদ ছিল না। বাবরি মসজিদ ধ্বংসকারীদের শনাক্তকরণের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি এলকে আদভানির এ ধরনের মন্তব্যকে মিথ্যাচার বলে আখ্যায়িত করেছিল।
শুধু তা-ই নয়, আদভানি একই সময় দাবি করেছিলেন, বাবরি মসজিদে নামাজ পড়া হতো না। তিনি বলেন, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত পূজা-পার্বণের ভিত্তিতে এটি একটি মন্দিরই ছিল, শুধু এর বাইরের কাঠামোটি ছিল মসজিদের মতো। আসলে ফৈজাবাদ হাইকোর্টের তত্কালীন হিন্দুত্ববাদী বিচারকদের পক্ষপাতদুষ্ট রায়ের কারণে আদভানির পক্ষে বাবরি মসজিদ ইস্যুতে এ ধরনের মিথ্যাচার করা সম্ভব হয়েছিল। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর দেশ-ভাগজনিত অস্থিরতার সুযোগে সংঘপরিবারের লোকেরা রাতের অন্ধকারে মসজিদের ভেতরে দুটি প্রতিমা স্থাপন এবং মন্দির নির্মাণ করে। তার আগে পর্যন্ত বাবরি মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়া হতো। এ সম্পর্কে উত্তর প্রদেশ সরকারের গেজেটে বলা হয়েছে, মন্দিরটি ওয়াকফের মালিকানাধীন জমিতে অবস্থিত এবং এটি মুসলিম ওয়াকফ হিসেবে ১৯৪৪ সালে সরকারিভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া বাবরি মসজিদে মন্দির স্থাপন করার পরের দিন অ্যাকোয়ার সম্পর্কিত একটি এফআইআর পুলিশ থানায় দায়ের করে। বলা হয়, আদালতের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত মূর্তি সরানো যাবে না। মুসলমানদের বাবরি মসজিদের ১০০ গজের মধ্যে আসার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যার ফলে বাবরি মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ হয়ে যায়। অথচ আদভানি দাবি করেছিলেন, এই মসজিদে কোনো দিন নামাজ আদায় করা হয়নি। ভারতীয় হিন্দুদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও বিশ্বাস করে যে, ১৫২৮ সালে অযোধ্যায় পৌরাণিক ভগবান রামের জন্মভূমিতে মোগল সম্রাট জহিরুদ্দিন বাবর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। বিজেপি ও তার সংঘপরিবারভুক্ত মিত্র সংগঠনগুলো এবং উগ্রপন্থী হিন্দুরা দাবি করেন, বাবরি মসজিদের তলদেশে রামের মন্দির রয়েছে।
অথচ ২০০২ সালের ৫ মার্চ এলাহাবাদ হাইকোর্টের ৫ সদস্যের লক্ষেষ্টৗ বেঞ্চ ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থাকে খনন কাজ চালানোর নির্দেশ দেয়। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই) এবং কানাডীয় কোম্পানি তোজোইন্ডিয়া বিকাশ ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবিআই) যৌথভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে ৫৭৪ পাতার যে জরিপ রিপোর্ট পেশ করে, তাতে কোথাও মন্দিরের অস্তিত্বের কথা বলা হয়নি। এরপরও বিজেপি ও তার সংঘপরিবারের মিত্ররা মন্দির ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছে। তাছাড়া বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডের আগে দিল্লি জওয়াহরলাল স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ২৮ জন বিশিষ্ট অধ্যাপক এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছিলেন, রাম মন্দিরের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, বাবরি মসজিদ হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য এবং এ মসজিদের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। এটি ভারতের সম্পদ। এরপরও বিজেপি ও তার সংঘপরিবারভুক্ত মিত্ররা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর প্রায় গোটা ভারতে শুরু হয় ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এতে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম সম্প্রদায়ের।
বিশ্লেষকদের অনেকেরই অভিমত, ধর্মীয় নয়—মূলত রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যই সংঘপরিবারের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি রাম জন্মভূমি এবং বাবরি মসজিদ বিতর্ককে ইস্যু এবং তাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলে। সর্বভারতীয় পর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব ও শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এর নেপথ্যে। যে কারণে শুধু হিন্দিভাষী গোবলয়ই নয়, দক্ষিণ অঞ্চলেও বিজেপি তার পায়ের তলায় শক্ত জমিন পেয়েছে রাম মন্দির ইস্যুকে কেন্দ্র করে, যে কারণে দলটি কেন্দ্রে একাধিকবার সরকার গঠন করেছে। সরকার গঠন করে যাচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যেও। কেন্দ্রীয় আইনসভায় বিজেপি এখন প্রধান বিরোধী দল। ১৯৮৪ সালের লোকসভায় বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৪টি। প্রসঙ্গক্রমে বলা হচ্ছে, শুধু হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও বিভিন্ন সময় রাম মন্দির এবং হিন্দুত্ববাদ নিয়ে মতলবি রাজনীতি করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। বলা চলে, বিজেপিকে রাম মন্দির নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ কংগ্রেস সরকারই করে দেয়। ১৯৮৭ সালের গোড়াতে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে সেখানে ১৯৪৯ সালে গোপনে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রবেশ করানো রামপালা পূজার ব্যবস্থা করে দেন। আর এই কাজটি করানো হয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মাধ্যমে। বিজেপি এবং আরএসএস সঙ্গে সঙ্গে এটিকেও তাদের প্রচারের বিষয় করে তোলে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডের সময় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ছিল নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার।
নরসিমা রাও সরকারও বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা থেকে উগ্র হিন্দুদের বিরত রাখার ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যে কারণে ভারতীয় রাজনীতির বিশ্লেষকদের অনেকে প্রায়ই বলে থাকেন, ভোটের রাজনীতির ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতাকে কংগ্রেস যেভাবে ব্যবহার করছে, বিজেপিও অনুরূপটিই করছে। যাহোক, এবছরের নভেম্বরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস সম্পর্কিত লিবারহান কমিশনের রিপোর্ট কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে পেশ করেছে। লিবারহান কমিশনের রিপোর্টে যে ৪৮ জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী এলকে আদভানি, সাবেক বিজেপি মন্ত্রী এবং বর্তমানে পার্লামেন্ট সদস্য মুরলি মনোহর যোশি, বিজেপি নেত্রী এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মধ্য প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী উমাভারতী এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোঘারিয়া।
এছাড়াও এদের সঙ্গে রয়েছে ফৈজাবাদের তত্কালীন জেলা প্রশাসক আরএন শ্রীবাস্তব, উত্তর প্রদেশের কমিশনার এসপি রাউর, পুলিশের ডিজি এসভিএন ত্রিপাঠি, শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে, ফৈজাবাদের পুলিশ সুপার ডিবি রায় এবং উত্তর প্রদেশের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং। অভিযোগ উঠেছে, সত্য প্রকাশ নয়—নিছক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল তথা বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার লক্ষ্যে ইউপিএ সরকার পার্লামেন্টে লিবারহান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যে কারণে ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভার দু’কক্ষেই সৃষ্টি হয় মহা শোরগোল। আর একথাও সত্য, এই রিপোর্ট বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে আরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। রাম মন্দির ইস্যু তথা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নিয়ে বিজেপি যে আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারছে না, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারছে না—তার প্রমাণ মিলেছে সর্বশেষ লোকসভা এবং বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে হারের মাধ্যমে।
মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রিস্টানদের ওপর দমন-নিপীড়নের কারণেও ভারতের সংখ্যালঘুদের বড় অংশের আস্থা ও সমর্থন হারিয়েছে বিজেপি। যে কারণে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ এখন চরম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে লিবারহান কমিশনের রিপোর্ট বিজেপির জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তবে লক্ষণীয় দিক হলো, লিবারহান কমিটির রিপোর্টে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের কোনো সুপারিশ করা হয়নি। এখানেই এই রিপোর্টের সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডের বহু বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ভারতে অনেক সরকার এলে-গেলেও এই চরম নিন্দনীয় কাজের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেউই কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং বিষয়টি সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং লিবারহান কমিশনের রিপোর্টে বর্ণিত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যে নেয়া হবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আর যেটি হবে, তা হলো এ নিয়ে নোংরা রাজনীতি।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক
শুধু তা-ই নয়, আদভানি একই সময় দাবি করেছিলেন, বাবরি মসজিদে নামাজ পড়া হতো না। তিনি বলেন, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত পূজা-পার্বণের ভিত্তিতে এটি একটি মন্দিরই ছিল, শুধু এর বাইরের কাঠামোটি ছিল মসজিদের মতো। আসলে ফৈজাবাদ হাইকোর্টের তত্কালীন হিন্দুত্ববাদী বিচারকদের পক্ষপাতদুষ্ট রায়ের কারণে আদভানির পক্ষে বাবরি মসজিদ ইস্যুতে এ ধরনের মিথ্যাচার করা সম্ভব হয়েছিল। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর দেশ-ভাগজনিত অস্থিরতার সুযোগে সংঘপরিবারের লোকেরা রাতের অন্ধকারে মসজিদের ভেতরে দুটি প্রতিমা স্থাপন এবং মন্দির নির্মাণ করে। তার আগে পর্যন্ত বাবরি মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়া হতো। এ সম্পর্কে উত্তর প্রদেশ সরকারের গেজেটে বলা হয়েছে, মন্দিরটি ওয়াকফের মালিকানাধীন জমিতে অবস্থিত এবং এটি মুসলিম ওয়াকফ হিসেবে ১৯৪৪ সালে সরকারিভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া বাবরি মসজিদে মন্দির স্থাপন করার পরের দিন অ্যাকোয়ার সম্পর্কিত একটি এফআইআর পুলিশ থানায় দায়ের করে। বলা হয়, আদালতের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত মূর্তি সরানো যাবে না। মুসলমানদের বাবরি মসজিদের ১০০ গজের মধ্যে আসার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যার ফলে বাবরি মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ হয়ে যায়। অথচ আদভানি দাবি করেছিলেন, এই মসজিদে কোনো দিন নামাজ আদায় করা হয়নি। ভারতীয় হিন্দুদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও বিশ্বাস করে যে, ১৫২৮ সালে অযোধ্যায় পৌরাণিক ভগবান রামের জন্মভূমিতে মোগল সম্রাট জহিরুদ্দিন বাবর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। বিজেপি ও তার সংঘপরিবারভুক্ত মিত্র সংগঠনগুলো এবং উগ্রপন্থী হিন্দুরা দাবি করেন, বাবরি মসজিদের তলদেশে রামের মন্দির রয়েছে।
অথচ ২০০২ সালের ৫ মার্চ এলাহাবাদ হাইকোর্টের ৫ সদস্যের লক্ষেষ্টৗ বেঞ্চ ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থাকে খনন কাজ চালানোর নির্দেশ দেয়। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই) এবং কানাডীয় কোম্পানি তোজোইন্ডিয়া বিকাশ ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবিআই) যৌথভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে ৫৭৪ পাতার যে জরিপ রিপোর্ট পেশ করে, তাতে কোথাও মন্দিরের অস্তিত্বের কথা বলা হয়নি। এরপরও বিজেপি ও তার সংঘপরিবারের মিত্ররা মন্দির ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছে। তাছাড়া বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডের আগে দিল্লি জওয়াহরলাল স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ২৮ জন বিশিষ্ট অধ্যাপক এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছিলেন, রাম মন্দিরের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, বাবরি মসজিদ হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য এবং এ মসজিদের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। এটি ভারতের সম্পদ। এরপরও বিজেপি ও তার সংঘপরিবারভুক্ত মিত্ররা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর প্রায় গোটা ভারতে শুরু হয় ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এতে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম সম্প্রদায়ের।
বিশ্লেষকদের অনেকেরই অভিমত, ধর্মীয় নয়—মূলত রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যই সংঘপরিবারের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি রাম জন্মভূমি এবং বাবরি মসজিদ বিতর্ককে ইস্যু এবং তাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলে। সর্বভারতীয় পর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব ও শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এর নেপথ্যে। যে কারণে শুধু হিন্দিভাষী গোবলয়ই নয়, দক্ষিণ অঞ্চলেও বিজেপি তার পায়ের তলায় শক্ত জমিন পেয়েছে রাম মন্দির ইস্যুকে কেন্দ্র করে, যে কারণে দলটি কেন্দ্রে একাধিকবার সরকার গঠন করেছে। সরকার গঠন করে যাচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যেও। কেন্দ্রীয় আইনসভায় বিজেপি এখন প্রধান বিরোধী দল। ১৯৮৪ সালের লোকসভায় বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৪টি। প্রসঙ্গক্রমে বলা হচ্ছে, শুধু হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও বিভিন্ন সময় রাম মন্দির এবং হিন্দুত্ববাদ নিয়ে মতলবি রাজনীতি করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। বলা চলে, বিজেপিকে রাম মন্দির নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ কংগ্রেস সরকারই করে দেয়। ১৯৮৭ সালের গোড়াতে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে সেখানে ১৯৪৯ সালে গোপনে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রবেশ করানো রামপালা পূজার ব্যবস্থা করে দেন। আর এই কাজটি করানো হয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মাধ্যমে। বিজেপি এবং আরএসএস সঙ্গে সঙ্গে এটিকেও তাদের প্রচারের বিষয় করে তোলে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডের সময় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ছিল নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার।
নরসিমা রাও সরকারও বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা থেকে উগ্র হিন্দুদের বিরত রাখার ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যে কারণে ভারতীয় রাজনীতির বিশ্লেষকদের অনেকে প্রায়ই বলে থাকেন, ভোটের রাজনীতির ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতাকে কংগ্রেস যেভাবে ব্যবহার করছে, বিজেপিও অনুরূপটিই করছে। যাহোক, এবছরের নভেম্বরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস সম্পর্কিত লিবারহান কমিশনের রিপোর্ট কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে পেশ করেছে। লিবারহান কমিশনের রিপোর্টে যে ৪৮ জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী এলকে আদভানি, সাবেক বিজেপি মন্ত্রী এবং বর্তমানে পার্লামেন্ট সদস্য মুরলি মনোহর যোশি, বিজেপি নেত্রী এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মধ্য প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী উমাভারতী এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোঘারিয়া।
এছাড়াও এদের সঙ্গে রয়েছে ফৈজাবাদের তত্কালীন জেলা প্রশাসক আরএন শ্রীবাস্তব, উত্তর প্রদেশের কমিশনার এসপি রাউর, পুলিশের ডিজি এসভিএন ত্রিপাঠি, শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে, ফৈজাবাদের পুলিশ সুপার ডিবি রায় এবং উত্তর প্রদেশের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং। অভিযোগ উঠেছে, সত্য প্রকাশ নয়—নিছক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল তথা বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার লক্ষ্যে ইউপিএ সরকার পার্লামেন্টে লিবারহান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যে কারণে ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভার দু’কক্ষেই সৃষ্টি হয় মহা শোরগোল। আর একথাও সত্য, এই রিপোর্ট বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে আরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। রাম মন্দির ইস্যু তথা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নিয়ে বিজেপি যে আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারছে না, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারছে না—তার প্রমাণ মিলেছে সর্বশেষ লোকসভা এবং বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে হারের মাধ্যমে।
মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রিস্টানদের ওপর দমন-নিপীড়নের কারণেও ভারতের সংখ্যালঘুদের বড় অংশের আস্থা ও সমর্থন হারিয়েছে বিজেপি। যে কারণে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ এখন চরম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে লিবারহান কমিশনের রিপোর্ট বিজেপির জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তবে লক্ষণীয় দিক হলো, লিবারহান কমিটির রিপোর্টে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের কোনো সুপারিশ করা হয়নি। এখানেই এই রিপোর্টের সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডের বহু বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ভারতে অনেক সরকার এলে-গেলেও এই চরম নিন্দনীয় কাজের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেউই কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং বিষয়টি সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং লিবারহান কমিশনের রিপোর্টে বর্ণিত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যে নেয়া হবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আর যেটি হবে, তা হলো এ নিয়ে নোংরা রাজনীতি।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক
No comments