বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাঃ নিশ্চিত হবে কীভাবে by স. ম. গোলাম কিবরিয়া
খাদ্য নিরাপত্তা বর্তমান বিশ্বের এক বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ুর পরিবর্তন এ চ্যালেঞ্জকে আরও জটিলরূপ দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার নিজ নিজ দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবিলার উপায় খুঁজছে। আগামীতে বিভিন্ন দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করে দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এরই মধ্যে কৃষিতে বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এ চ্যালেঞ্জকে আরও জটিল করে তুলছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জি-৮ গ্রুপের বৈঠকে ২০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনে উন্নত দেশগুলোকে সম্মত করাতে সক্ষম হয়েছেন। এ অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ব্যয় করা হবে বলে জানা গেছে।
সমপ্রতি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সদর দফতর রোমে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্লোগান দিয়ে ১৫-১৯ নভেম্বর বিশ্ব নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন। খাদ্য উত্পাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি খাদ্য সরবরাহ সুষমকরণের ওপর জোর দিয়েছেন, গুরুত্বারোপ করছেন একটি তহবিল গঠনের। এ সম্মেলনে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য রোম ঘোষণাও গৃহীত হয়। সম্মেলনের বেশকিছু সাফল্য থাকলেও বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ঝুঁকি কিন্তু রয়েই গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশকে কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা এখন বড় ভাবনার বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার—উভয় দিক থেকেই বাংলাদেশ ঝুঁকিতে রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার চেয়ে অধিকমাত্রায় বরফ গলছে বলে জানা গেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং অনেক দেশের কৃষিজমি তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিক থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবে। অপরদিকে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে অনেক দেশেই খাদ্যশস্যের উত্পাদন হ্রাস পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে গমের উত্পাদন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশেও গমের উত্পাদন হ্রাস পেয়েছে। চলতি বছরে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আমন ধানের ফলন কম হয়েছে। ভারতের মতো বৃহত্ দেশগুলো খাদ্যশস্য আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিলেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যায়।
বাজারে খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সরবরাহকে অনেকেই খাদ্য নিরাপত্তার সমার্থক বলে গণ্য করেন। পর্যাপ্ত সরবরাহ খাদ্য নিরাপত্তার একটি অংশ হলেও খাদ্য নিরাপত্তার অর্থ আরও বিস্তৃত। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে এমন একটি অবস্থা বুঝায়, সেখানে সব মানুষের কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর ও উত্পাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সব সময় পর্যাপ্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যের সরবরাহ, প্রাপ্তি ও সহজলভ্য পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকে। অর্থাত্ খাদ্য নিরাপত্তা বলতে শুধু বাজারে খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সরবরাহকেই বুঝায় না, জনগণের জন্য তা সহজলভ্য হওয়াও অন্যতম বিষয়।
বিশেষ কয়েকটি দিক লক্ষ্য রেখে আমাদের দেশে খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—সরকারি খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য সরবরাহ করা, দুর্যোগকালে ত্রাণসহায়তা হিসেবে খাদ্য সরবরাহ করা, বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রির মাধ্যমে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করা, গ্রামীণ দরিদ্র ও বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা। এসব লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় মজুত গড়ে তুলতে সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে এবং আমদানির মাধ্যমে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করবে। অতীতের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশীয় উত্পাদন কম হলে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য মজুত গড়ে তোলা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। যখনই বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে তখনই আরও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। তখন সরকারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকলেও উচ্চমূল্যে খাদ্যশস্য আমদানি করা সম্ভব হয় না। আর এর প্রভাব পড়ে গোটা জাতির ওপর।
আমাদের দেশে প্রতি বছর ১৫ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হারের কারণে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ লোক নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে প্রতি বছর খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন। অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য অকৃষি কাজে প্রতি বছর প্রায় ১ শতাংশ কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি পানিতে ডুবে যাবে। আর তার চেয়েও অধিক পরিমাণ জমি লবণাক্ততার শিকার হবে। এ অবস্থায় চাহিদা মোতাবেক খাদ্য উত্পাদন করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য সংকট দেখা দিয়ে থাকে। ২০০৭ সালে দু’বার বন্যা ও নভেম্বর মাসে সাইক্লোন-সিডরের কারণে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এ কারণে খাদ্য উত্পাদন কম হয়েছিল প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও খাদ্যশস্যের দাম দ্রুতগতিতে বেড়ে গিয়েছিল। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যেখানে চাল ও গমের মূল্য ছিল যথাক্রমে ২২৮ ও ১৯০ মার্কিন ডলার, ২০০৮ সালের মার্চে তা পৌঁছে যথাক্রমে ১০২৫ ও ৪৫০ মার্কিন ডলারে। ভারতসহ অধিকাংশ রফতানিকারক দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মোকাবিলার কথা বিবেচনা করে খাদ্যশস্য রফতানির পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধ করে দেয়। এতে বাংলাদেশ চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়ে। এ খাদ্য সঙ্কটের কারণে প্রায় ৪০ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে বলে ধারণা করা হয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কোনোভাবেই আমাদের আমদানির ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। ফলে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমাদের দেশীয় উত্পাদন বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। আশার কথা যে, বর্তমান সরকার দেশীয় উত্পাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে সারের দাম কমিয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সরকার ইউরিয়া সার এবং সমপ্রতি অন্যান্য সারের দামও কমিয়েছে। এ জন্য সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হলেও দেখা যাবে উত্পাদিত খাদ্যশস্যের মূল্য ভর্তুকির চেয়ে বেশি হবে। এর ফলে একদিকে যেমন খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়বে, অপরদিকে উত্পাদন ব্যয় কম হওয়ায় খাদ্যশস্যের দাম জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক বড় পদক্ষেপ।
খাদ্যশস্য উত্পাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্যও রয়েছে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ, চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও অন্যান্য সহায়ক পদক্ষেপের ফলে গত ৩৮ বছরে খাদ্য উত্পাদন বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। স্বাধীনতার পর দেশে খাদ্য উত্পাদন হতো ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে তা প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। এ থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমে গেলেও উন্নত জাত উদ্ভাবন, পরিকল্পিত উপায়ে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে বিদ্যমান কৃষিজমি থেকে দেশের চাহিদামাফিক খাদ্যশস্য উত্পাদন করা সম্ভব। একই সঙ্গে উত্পাদন বাড়াতে কৃষকদের উত্সাহিত করতে প্রণদোনা দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সারের মূল্য কমানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কৃষি উপকরণের মূল্য কমানো সর্বোপরি কৃষি ফসলের উত্পাদন ব্যয় কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে প্রতিকূল পরিবেশ সহনীয় নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে, কৃষিবান্ধব প্রযুক্তি তুলে দিতে হবে কৃষকের হাতে। তাহলেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আমাদের কৃষকরাই উত্পাদন করতে পারবে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দূর করা সম্ভব হবে আমদানি নির্ভরতা।
সমপ্রতি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সদর দফতর রোমে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্লোগান দিয়ে ১৫-১৯ নভেম্বর বিশ্ব নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন। খাদ্য উত্পাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি খাদ্য সরবরাহ সুষমকরণের ওপর জোর দিয়েছেন, গুরুত্বারোপ করছেন একটি তহবিল গঠনের। এ সম্মেলনে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য রোম ঘোষণাও গৃহীত হয়। সম্মেলনের বেশকিছু সাফল্য থাকলেও বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ঝুঁকি কিন্তু রয়েই গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশকে কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা এখন বড় ভাবনার বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার—উভয় দিক থেকেই বাংলাদেশ ঝুঁকিতে রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার চেয়ে অধিকমাত্রায় বরফ গলছে বলে জানা গেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং অনেক দেশের কৃষিজমি তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিক থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবে। অপরদিকে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে অনেক দেশেই খাদ্যশস্যের উত্পাদন হ্রাস পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে গমের উত্পাদন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশেও গমের উত্পাদন হ্রাস পেয়েছে। চলতি বছরে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আমন ধানের ফলন কম হয়েছে। ভারতের মতো বৃহত্ দেশগুলো খাদ্যশস্য আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিলেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যায়।
বাজারে খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সরবরাহকে অনেকেই খাদ্য নিরাপত্তার সমার্থক বলে গণ্য করেন। পর্যাপ্ত সরবরাহ খাদ্য নিরাপত্তার একটি অংশ হলেও খাদ্য নিরাপত্তার অর্থ আরও বিস্তৃত। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে এমন একটি অবস্থা বুঝায়, সেখানে সব মানুষের কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর ও উত্পাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সব সময় পর্যাপ্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যের সরবরাহ, প্রাপ্তি ও সহজলভ্য পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকে। অর্থাত্ খাদ্য নিরাপত্তা বলতে শুধু বাজারে খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সরবরাহকেই বুঝায় না, জনগণের জন্য তা সহজলভ্য হওয়াও অন্যতম বিষয়।
বিশেষ কয়েকটি দিক লক্ষ্য রেখে আমাদের দেশে খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—সরকারি খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য সরবরাহ করা, দুর্যোগকালে ত্রাণসহায়তা হিসেবে খাদ্য সরবরাহ করা, বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রির মাধ্যমে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করা, গ্রামীণ দরিদ্র ও বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা। এসব লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় মজুত গড়ে তুলতে সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে এবং আমদানির মাধ্যমে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করবে। অতীতের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশীয় উত্পাদন কম হলে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য মজুত গড়ে তোলা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। যখনই বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে তখনই আরও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। তখন সরকারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকলেও উচ্চমূল্যে খাদ্যশস্য আমদানি করা সম্ভব হয় না। আর এর প্রভাব পড়ে গোটা জাতির ওপর।
আমাদের দেশে প্রতি বছর ১৫ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হারের কারণে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ লোক নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে প্রতি বছর খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন। অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য অকৃষি কাজে প্রতি বছর প্রায় ১ শতাংশ কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি পানিতে ডুবে যাবে। আর তার চেয়েও অধিক পরিমাণ জমি লবণাক্ততার শিকার হবে। এ অবস্থায় চাহিদা মোতাবেক খাদ্য উত্পাদন করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য সংকট দেখা দিয়ে থাকে। ২০০৭ সালে দু’বার বন্যা ও নভেম্বর মাসে সাইক্লোন-সিডরের কারণে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এ কারণে খাদ্য উত্পাদন কম হয়েছিল প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও খাদ্যশস্যের দাম দ্রুতগতিতে বেড়ে গিয়েছিল। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যেখানে চাল ও গমের মূল্য ছিল যথাক্রমে ২২৮ ও ১৯০ মার্কিন ডলার, ২০০৮ সালের মার্চে তা পৌঁছে যথাক্রমে ১০২৫ ও ৪৫০ মার্কিন ডলারে। ভারতসহ অধিকাংশ রফতানিকারক দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মোকাবিলার কথা বিবেচনা করে খাদ্যশস্য রফতানির পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধ করে দেয়। এতে বাংলাদেশ চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়ে। এ খাদ্য সঙ্কটের কারণে প্রায় ৪০ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে বলে ধারণা করা হয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কোনোভাবেই আমাদের আমদানির ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। ফলে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমাদের দেশীয় উত্পাদন বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। আশার কথা যে, বর্তমান সরকার দেশীয় উত্পাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে সারের দাম কমিয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সরকার ইউরিয়া সার এবং সমপ্রতি অন্যান্য সারের দামও কমিয়েছে। এ জন্য সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হলেও দেখা যাবে উত্পাদিত খাদ্যশস্যের মূল্য ভর্তুকির চেয়ে বেশি হবে। এর ফলে একদিকে যেমন খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়বে, অপরদিকে উত্পাদন ব্যয় কম হওয়ায় খাদ্যশস্যের দাম জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক বড় পদক্ষেপ।
খাদ্যশস্য উত্পাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্যও রয়েছে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ, চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও অন্যান্য সহায়ক পদক্ষেপের ফলে গত ৩৮ বছরে খাদ্য উত্পাদন বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। স্বাধীনতার পর দেশে খাদ্য উত্পাদন হতো ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে তা প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। এ থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমে গেলেও উন্নত জাত উদ্ভাবন, পরিকল্পিত উপায়ে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে বিদ্যমান কৃষিজমি থেকে দেশের চাহিদামাফিক খাদ্যশস্য উত্পাদন করা সম্ভব। একই সঙ্গে উত্পাদন বাড়াতে কৃষকদের উত্সাহিত করতে প্রণদোনা দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সারের মূল্য কমানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কৃষি উপকরণের মূল্য কমানো সর্বোপরি কৃষি ফসলের উত্পাদন ব্যয় কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে প্রতিকূল পরিবেশ সহনীয় নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে, কৃষিবান্ধব প্রযুক্তি তুলে দিতে হবে কৃষকের হাতে। তাহলেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আমাদের কৃষকরাই উত্পাদন করতে পারবে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দূর করা সম্ভব হবে আমদানি নির্ভরতা।
No comments