নাসিক-কুসিক নির্বাচন : বিপ্রতীপ এবং সমরূপের সমাহার by ড. সা'দত হুসাইন
মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনে একজন মেয়র এবং প্রায় ছয় ডজন কাউন্সিলর সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন জাতীয় পর্যায়ে তথা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এর মূল কারণ ছিল, মেয়র পদে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রার্থিতা। ভোটযুদ্ধে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন সন্ত্রাস, অনাচার এবং অশুভ প্রভাবনাশিনীরূপে। এ দেশের মানুষ মনের গভীর থেকে এমন ব্যক্তিকে তাদের নেতা-নেত্রী বা ভোটে বিজয়ী হিসেবে দেখতে চায়, যিনি সৎ, সাহসী, শিক্ষিত, অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী এবং নিবেদিতপ্রাণ জনদরদি। দক্ষতার বিষয়টিও বিবেচ্য। তবে সাধারণ মানুষ মনে করে, উপরোক্ত গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি দক্ষতার মাপেও খুব একটা পিছিয়ে থাকবেন না। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাস্তবকে তাদের এই প্রত্যাশা বা স্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। সেলিনা হায়াতের মধ্যে যেসব গুণের সমাবেশ ঘটেছিল, স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর মধ্যে সেই ধরনের গুণাবলির সমাহার ঘটা সত্যিই বিরল ব্যাপার।
ভোটের আগে বিভিন্ন বিতর্কে এবং প্রচারণায় তিনি তাঁর শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীর মোকাবিলায় যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা সাধারণ প্রত্যাশার অনেক ওপরে। যখন তিনি তাঁর দলের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা যখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালালেন, তখন তিনি বিন্দুমাত্র মুষড়ে পড়েননি। একই ধরনের সাহস ও বলিষ্ঠতা নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। নারায়ণগঞ্জবাসী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনেছে, ভোটাররা ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে দলে দলে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়েছে। ভোট দিয়ে তাঁকে বিপুলভাবে জয়যুক্ত করেছে। তাঁর এই বিজয় দেশে নির্বাচন তথা গণমুখী রাজনীতির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল। অন্যান্য নির্বাচনেও শিক্ষিত, দুর্নীতিমুক্ত, সাহসী, সন্ত্রাসবিরোধী এবং নিবেদিতপ্রাণ জনদরদি প্রার্থীর সমাবেশ ঘটবে_এই প্রত্যাশায় তারা বুক বেঁধে জেগে উঠেছিল।
মাত্র দুই-তিন মাসের ব্যবধানেই এলো কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) নির্বাচন। গুরুত্বের বিবেচনায় কুমিল্লা নারায়ণগঞ্জের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। দেশের মানুষের দৃষ্টি তাই মেয়র পদপ্রার্থীদের দিকে প্রসারিত। এখানে মানুষ কিছুটা হতাশ হলো। সেলিনা হায়াতের সমরূপ বা কাছাকাছি গুণাবলিমণ্ডিত, গণজোয়ার সৃষ্টিকারী কোনো মেয়র পদপ্রার্থী দেখা গেল না। নতুন কোনো ঝরনাধারা বা নতুন কোনো সম্ভাবনার ইশারায় তারা চমকিত হলো না। ডাক দিয়ে গেল না কোনো নতুন সুর, নতুন গান, একটি কবিতার শ্লোক কিংবা একটি প্রাণকাড়া স্লোগান। বরং বুকের মধ্যে গুমরে কাঁদল একটি উচ্চারণ : মন্দের ভালোকে পছন্দ করার নামই নির্বাচন। তবে ভোটাররা নারায়ণগঞ্জের মতোই সচেতন, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দই সবার ওপরে। কোনো রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিতে নারাজ। তাদের অধিকারবোধ এখন অনেক প্রখর, নিজেদের শক্তিতে তারা অনেক বেশি আস্থাবান।
এ কথা সত্য যে, নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদ বাদ দিলে, বিশেষ করে মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎকে বাদ দিলে যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা কুসিক নির্বাচনের চেয়ে খুব একটা ভিন্নতর নয়। জাতীয় দৈনিকগুলোতে মেয়র এবং বিশেষ করে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রাক-প্রার্থীজীবনের তথ্যাবলি, কর্মবৃত্তান্ত এবং জীবনধারা সম্পর্কে যেসব প্রতিবেদন বেরিয়েছে, তা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তা হলো_লাখকয়েক লোকের নগরীতে বা এত হাজার লোকের ওয়ার্ডে আরো শিক্ষিত, অতিসুনামধারী, উচ্চমানের, দুর্নীতিমুক্ত এবং প্রকৃত অর্থে জনদরদি প্রার্থীর এত অভাব কেন? এ ধরনের লোক বোধ হয় নির্বাচন করতে চান না। তার অর্থ হতে পারে, আমাদের নির্বাচন-পদ্ধতিতে, আমাদের সামগ্রিক প্রশাসনে এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সামাজিক পরিকাঠামোতে এমন কিছু রয়েছে, যা শিক্ষিত, সৎ, দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ এবং জনদরদি ব্যক্তিকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কুমিল্লায় একজন প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন, নির্বাচন করতে যে পরিমাণ অর্থ দরকার, তা তাঁর নেই। অতএব তাঁর পক্ষে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর এই বক্তব্য হয়তো বা সর্বাংশে সত্য নয়। তাঁর হয়তো প্রয়োজনীয় গুণাবলিরও অভাব ছিল। গণদৃষ্টি আকর্ষণ করতে তিনি সক্ষম হননি। নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনীও বোধ হয় তাঁর ছিল না। সিলেট সদর উপজেলা নির্বাচনে ছয়ফুর রহমান (ডাব মার্কা) জনদৃষ্টি আকর্ষণ করে অতি অল্প খরচে নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতীয় নির্বাচনে এ ধরনের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে, যাঁরা অবিশ্বাস্য কম খরচে নির্বাচন করেছেন। তবে সেখানে দল বা মার্কার একটি বড় ভূমিকা ছিল।
এখানে বড় কথা হচ্ছে, সামগ্রিক নির্বাচনী-প্রক্রিয়া এখনো সম্পূর্ণ কলুষমুক্ত হয়নি। মনে রাখতে হবে, নির্বাচনী-প্রক্রিয়ায় ভোটার একটি চলক বা ভেরিয়েব্ল মাত্র। এখানে আরো নানাবিধ শক্তি চলক হিসেবে কাজ করে থাকে। তবে কোনো কারণে গণজোয়ার সৃষ্টি হলে ভোটার চলকটি বিরাট শক্তির রূপ পরিগ্রহ করে। অন্যথায় এখনো ধনবল, জনবল, সন্ত্রাসী চাপ, প্রশাসনিক সমর্থন এবং সব চলকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ভোটের ফলাফলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রেই সত্য। আজকাল অনেক দেশেই নির্বাচনের ফল দৃষ্টিকটুুুভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ফল নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বহু লোক প্রাণ হারাচ্ছে। নির্বাচনকে সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করাটা দুরূহ ব্যাপার। দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশই প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনকে নিরপেক্ষ, নিরাপদ এবং গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলক।
নাসিক ও কুসিক_উভয় নির্বাচনই সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্তত নির্বাচনের দিন কিংবা তার অব্যবহিত আগে-পরে কোনো গুরুতর অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নানা রকম নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ছাড়াই নাসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কুসিক নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে সেনাবাহিনী চাওয়ার ঝুঁকি নেয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত রেখেছে। যেহেতু একটি মাত্র এলাকার নির্বাচন হয়েছে, সেহেতু প্রতিটি কেন্দ্রে এবং সামগ্রিকভাবে নগর এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা সম্ভব হয়েছে। প্রতীয়মান হয়েছে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক এ ধরনের শক্তির মহড়া প্রদর্শন করা গেলে সন্ত্রাসী তৎপরতা সন্তোষজনক পর্যায়ে দূরীকরণ সম্ভব হয়। এ ধরনের শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ভবিষ্যতের জন্য আশার বার্তা বহন করে।
নাসিকের কাউন্সিলর এবং কুসিকের মেয়র-কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের যোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন দীর্ঘায়িত করে অনেকে এসব পদ নির্বাচনের পরিবর্তে অন্য কোনো বাছাই-পদ্ধতিতে পূরণ করার জন্য পরামর্শ দিতে উৎসাহ বোধ করেন। নির্বাচন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের 'সিলেকশন'-পদ্ধতির মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পদ পূরণ করা যায়। আমাদের দেশেও এ ধরনের দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে যে পদের জনসম্পৃক্তি অত্যধিক, সেই পদ নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করাই শ্রেয়। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই স্থানীয় প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচনের মাধ্যমে শীর্ষ পদগুলো পূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে প্রশাসনে গণ-অংশীদারির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে যোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে আনার জন্য নির্বাচনকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কলুষমুক্ত করতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়ম কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সুনির্বাচনের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচনী-প্রক্রিয়ায় জনমনে আস্থা সৃষ্টি করতে পারলে দেখা যাবে, প্রথমদিকে যোগ্য লোক নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও ধীরে ধীরে তাঁরা এগিয়ে আসবেন। নির্বাচিত হওয়া কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রশাসন চালানো যেমন কষ্টকর ব্যাপার, তেমনি নির্বাচিত প্রশাসক হওয়ার একটি বিরাট আনন্দ রয়েছে। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তি যে আস্থা-সম্পদ অর্জন করেন, তার একটি বিরাট শক্তি রয়েছে। নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন প্রশাসন উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে 'ব্যাড ক্যান্ডিডেট' নির্বাচনী মঞ্চ থেকে 'গুড ক্যান্ডিডেট'কে তাড়িয়ে দিতে পারবে না। বরং যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, 'ব্যাড ক্যান্ডিডেট' জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে ধীরে ধীরে ভোটমঞ্চ ত্যাগ করবে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি
ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
ভোটের আগে বিভিন্ন বিতর্কে এবং প্রচারণায় তিনি তাঁর শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীর মোকাবিলায় যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা সাধারণ প্রত্যাশার অনেক ওপরে। যখন তিনি তাঁর দলের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা যখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালালেন, তখন তিনি বিন্দুমাত্র মুষড়ে পড়েননি। একই ধরনের সাহস ও বলিষ্ঠতা নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। নারায়ণগঞ্জবাসী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনেছে, ভোটাররা ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে দলে দলে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়েছে। ভোট দিয়ে তাঁকে বিপুলভাবে জয়যুক্ত করেছে। তাঁর এই বিজয় দেশে নির্বাচন তথা গণমুখী রাজনীতির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল। অন্যান্য নির্বাচনেও শিক্ষিত, দুর্নীতিমুক্ত, সাহসী, সন্ত্রাসবিরোধী এবং নিবেদিতপ্রাণ জনদরদি প্রার্থীর সমাবেশ ঘটবে_এই প্রত্যাশায় তারা বুক বেঁধে জেগে উঠেছিল।
মাত্র দুই-তিন মাসের ব্যবধানেই এলো কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) নির্বাচন। গুরুত্বের বিবেচনায় কুমিল্লা নারায়ণগঞ্জের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। দেশের মানুষের দৃষ্টি তাই মেয়র পদপ্রার্থীদের দিকে প্রসারিত। এখানে মানুষ কিছুটা হতাশ হলো। সেলিনা হায়াতের সমরূপ বা কাছাকাছি গুণাবলিমণ্ডিত, গণজোয়ার সৃষ্টিকারী কোনো মেয়র পদপ্রার্থী দেখা গেল না। নতুন কোনো ঝরনাধারা বা নতুন কোনো সম্ভাবনার ইশারায় তারা চমকিত হলো না। ডাক দিয়ে গেল না কোনো নতুন সুর, নতুন গান, একটি কবিতার শ্লোক কিংবা একটি প্রাণকাড়া স্লোগান। বরং বুকের মধ্যে গুমরে কাঁদল একটি উচ্চারণ : মন্দের ভালোকে পছন্দ করার নামই নির্বাচন। তবে ভোটাররা নারায়ণগঞ্জের মতোই সচেতন, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দই সবার ওপরে। কোনো রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিতে নারাজ। তাদের অধিকারবোধ এখন অনেক প্রখর, নিজেদের শক্তিতে তারা অনেক বেশি আস্থাবান।
এ কথা সত্য যে, নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদ বাদ দিলে, বিশেষ করে মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎকে বাদ দিলে যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা কুসিক নির্বাচনের চেয়ে খুব একটা ভিন্নতর নয়। জাতীয় দৈনিকগুলোতে মেয়র এবং বিশেষ করে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রাক-প্রার্থীজীবনের তথ্যাবলি, কর্মবৃত্তান্ত এবং জীবনধারা সম্পর্কে যেসব প্রতিবেদন বেরিয়েছে, তা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তা হলো_লাখকয়েক লোকের নগরীতে বা এত হাজার লোকের ওয়ার্ডে আরো শিক্ষিত, অতিসুনামধারী, উচ্চমানের, দুর্নীতিমুক্ত এবং প্রকৃত অর্থে জনদরদি প্রার্থীর এত অভাব কেন? এ ধরনের লোক বোধ হয় নির্বাচন করতে চান না। তার অর্থ হতে পারে, আমাদের নির্বাচন-পদ্ধতিতে, আমাদের সামগ্রিক প্রশাসনে এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সামাজিক পরিকাঠামোতে এমন কিছু রয়েছে, যা শিক্ষিত, সৎ, দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ এবং জনদরদি ব্যক্তিকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কুমিল্লায় একজন প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন, নির্বাচন করতে যে পরিমাণ অর্থ দরকার, তা তাঁর নেই। অতএব তাঁর পক্ষে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর এই বক্তব্য হয়তো বা সর্বাংশে সত্য নয়। তাঁর হয়তো প্রয়োজনীয় গুণাবলিরও অভাব ছিল। গণদৃষ্টি আকর্ষণ করতে তিনি সক্ষম হননি। নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনীও বোধ হয় তাঁর ছিল না। সিলেট সদর উপজেলা নির্বাচনে ছয়ফুর রহমান (ডাব মার্কা) জনদৃষ্টি আকর্ষণ করে অতি অল্প খরচে নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতীয় নির্বাচনে এ ধরনের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে, যাঁরা অবিশ্বাস্য কম খরচে নির্বাচন করেছেন। তবে সেখানে দল বা মার্কার একটি বড় ভূমিকা ছিল।
এখানে বড় কথা হচ্ছে, সামগ্রিক নির্বাচনী-প্রক্রিয়া এখনো সম্পূর্ণ কলুষমুক্ত হয়নি। মনে রাখতে হবে, নির্বাচনী-প্রক্রিয়ায় ভোটার একটি চলক বা ভেরিয়েব্ল মাত্র। এখানে আরো নানাবিধ শক্তি চলক হিসেবে কাজ করে থাকে। তবে কোনো কারণে গণজোয়ার সৃষ্টি হলে ভোটার চলকটি বিরাট শক্তির রূপ পরিগ্রহ করে। অন্যথায় এখনো ধনবল, জনবল, সন্ত্রাসী চাপ, প্রশাসনিক সমর্থন এবং সব চলকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ভোটের ফলাফলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রেই সত্য। আজকাল অনেক দেশেই নির্বাচনের ফল দৃষ্টিকটুুুভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ফল নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বহু লোক প্রাণ হারাচ্ছে। নির্বাচনকে সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করাটা দুরূহ ব্যাপার। দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশই প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনকে নিরপেক্ষ, নিরাপদ এবং গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলক।
নাসিক ও কুসিক_উভয় নির্বাচনই সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্তত নির্বাচনের দিন কিংবা তার অব্যবহিত আগে-পরে কোনো গুরুতর অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নানা রকম নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ছাড়াই নাসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কুসিক নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে সেনাবাহিনী চাওয়ার ঝুঁকি নেয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত রেখেছে। যেহেতু একটি মাত্র এলাকার নির্বাচন হয়েছে, সেহেতু প্রতিটি কেন্দ্রে এবং সামগ্রিকভাবে নগর এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা সম্ভব হয়েছে। প্রতীয়মান হয়েছে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক এ ধরনের শক্তির মহড়া প্রদর্শন করা গেলে সন্ত্রাসী তৎপরতা সন্তোষজনক পর্যায়ে দূরীকরণ সম্ভব হয়। এ ধরনের শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ভবিষ্যতের জন্য আশার বার্তা বহন করে।
নাসিকের কাউন্সিলর এবং কুসিকের মেয়র-কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের যোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন দীর্ঘায়িত করে অনেকে এসব পদ নির্বাচনের পরিবর্তে অন্য কোনো বাছাই-পদ্ধতিতে পূরণ করার জন্য পরামর্শ দিতে উৎসাহ বোধ করেন। নির্বাচন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের 'সিলেকশন'-পদ্ধতির মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পদ পূরণ করা যায়। আমাদের দেশেও এ ধরনের দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে যে পদের জনসম্পৃক্তি অত্যধিক, সেই পদ নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করাই শ্রেয়। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই স্থানীয় প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচনের মাধ্যমে শীর্ষ পদগুলো পূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে প্রশাসনে গণ-অংশীদারির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে যোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে আনার জন্য নির্বাচনকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কলুষমুক্ত করতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়ম কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সুনির্বাচনের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচনী-প্রক্রিয়ায় জনমনে আস্থা সৃষ্টি করতে পারলে দেখা যাবে, প্রথমদিকে যোগ্য লোক নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও ধীরে ধীরে তাঁরা এগিয়ে আসবেন। নির্বাচিত হওয়া কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রশাসন চালানো যেমন কষ্টকর ব্যাপার, তেমনি নির্বাচিত প্রশাসক হওয়ার একটি বিরাট আনন্দ রয়েছে। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তি যে আস্থা-সম্পদ অর্জন করেন, তার একটি বিরাট শক্তি রয়েছে। নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন প্রশাসন উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে 'ব্যাড ক্যান্ডিডেট' নির্বাচনী মঞ্চ থেকে 'গুড ক্যান্ডিডেট'কে তাড়িয়ে দিতে পারবে না। বরং যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, 'ব্যাড ক্যান্ডিডেট' জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে ধীরে ধীরে ভোটমঞ্চ ত্যাগ করবে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি
ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
No comments