আওয়ামী লীগ : গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা-উঁকি দিয়ে যায় কোন্দল by অমিতাভ দাশ হিমুন

লীয় এবং সরকারি কর্মসূচিতে 'ঐক্যবদ্ধ' থাকলেও ছাইচাপা আগুনের মতো লুকিয়ে রাখা গ্রুপিং বা বিভেদ মাঝেমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে গোবিন্দগঞ্জ আওয়ামী লীগে। কোনো কিছু মনঃপূত না হলেই একদল আরেক দলের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।


নেতা-কর্মীদের এক দলের মধ্যে জুয়া, চোরাচালান, জিনের বাদশা প্রতারক চক্রের রমরমা বাণিজ্যের বিরুদ্ধে মিছিল, এমনকি থানার সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করলেও সেসবের পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করার খেলা চলে। দলের এই লড়াইয়ে বিপাকে পড়েন সরকারি কর্মকর্তারা। বাধ্য হয়েই তাঁদের শরণাপন্ন হতে হয় কোনো না কোনো পক্ষের। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এরশাদ প্রীতির কারণে গাইবান্ধা-৪ গোবিন্দগঞ্জ আসন জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত হয়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির টিকিট নিয়ে বিজয়ী হন এম এ মোত্তালিব আকন্দ। আওয়ামী লীগের বিপুল ভোট ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও দলীয় কোন্দল ও মোত্তালিবের ব্যক্তিগত ইমেজ তাঁর বিজয়কে সহজ করে। মেয়াদের শেষ সময়ে এম এ মোত্তালিব মারা গেলে উপনির্বাচনে তাঁর ছেলে শামিম কায়সার লিংকন নির্বাচিত হন। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ২০০৮ সালে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আসনটি আবার আওয়ামী লীগের দখলে আনেন।
মনোয়ার হোসেন চৌধুরী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম দিকে দলীয় নেতা-কর্মীরা একত্রিত থাকলেও ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। বিশেষ করে গোবিন্দগঞ্জ আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক পৌর মেয়র অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই এমপির সঙ্গে তাঁর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কালাম সমর্থকদের অভিযোগ, মনোয়ার হোসেন চৌধুুরী দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করে নিজের পছন্দের লোকজনের মাধ্যমে টিআর, কাবিখাসহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজ করাতে শুরু করেন। তা ছাড়া তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই অপূর্ণ রাখার অভিযোগও ওঠে। আরো অভিযোগ করা হয়, দলের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে সংসদ সদস্য তাঁর ডিও লেটারে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সভাপতি পদে পছন্দের লোকজনকে বসিয়ে দেন। এ ছাড়া জেনারেল এবং স্পেশাল সব বরাদ্দেই তিনি হাত দেন। তবে এ ব্যাপারে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র আতাউর রহমান সরকার দলীয় বিভক্তির কথা স্বীকার না করে বলেন, বড় দলে দলীয় পদ-পদবি ও ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা থাকবেই। তবে সেই প্রতিযোগিতার কারণে অনর্থক কাউকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। তিনি বলেন, বর্তমান এমপির সময়ে ১৭টি ইউনিয়নে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ পৌরসভার উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিনি কোনো ধরনের দলীয়করণ করেছেন বলে তাঁর জানা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, 'এমপি তাঁর মতো করে এলাকার উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন। অপর দিকে আওয়ামী রাজনীতির আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা জুয়া, চোরাচালান এবং কথিত জিনের বাদশার পক্ষে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাঁরা পার পেয়ে যাক এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না। তাঁরা প্রশাসনকে জিম্মি করে এমপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।'
দলের একটি সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালে শেষবারের মতো দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্রায় ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে। সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার মাহমুদ খসরু মারা যাওয়ার পর প্রধান আতাউর রহমান বাবলু ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কাউন্সিল বা সম্মেলনের ব্যাপারে কখনোই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ কিংবা অন্য কোনো অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মূল দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাননি। গোবিন্দগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দরবস্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম জর্জ জানান, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব দানকারী কতিপয় নেতা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য কাউন্সিলের বিরোধিতা করছেন। এ কারণে নতুন নেতৃত্ব বা দল বিকশিত হচ্ছে না। অপর দিকে একটি পক্ষ দলের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে লাভবান হচ্ছে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃত্বকে অবহিত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক প্রধান আতাউর রহমান বাবলু জানান, থানা কাউন্সিল অনুষ্ঠানের জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমান নেতৃত্ব কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বকে এগিয়ে নিতে চায়। এমপি মনোয়ার হোসেন চৌধুরী ও উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের মধ্যে বিরোধ আছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, এমপি তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করেন এবং আবুল কালাম আজাদ মাঠপর্যায় থেকে ওঠে আসা একজন গুণী জননেতা। তাঁদের সমন্বয়ে গোবিন্দগঞ্জবাসী উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে চায়। এ ব্যাপারে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, কারো ভেতরে নেতৃত্বের বিকাশ না ঘটলে সেই নেতৃত্ব দল ও দেশকে গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে কিছু দিতে পারে না। অপর দিকে সংসদ সদস্য প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, 'আমার সঙ্গে কারো কোনো বিরোধ নেই। দলের ও সরকারি সব পর্যায়ের অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। কারো সঙ্গে বসতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে স্থানীয় সরকারের ধারণা এবং এ সংক্রান্ত সরকারি পরিপত্র যাঁরা বোঝেন না বা বিশ্বাস করেন না, তাঁরাই আমার সমালোচনা বা বিরোধিতা করেন।'

No comments

Powered by Blogger.