গোলাম আযমের জন্য চিকন চালের ভাত, সুগন্ধি কম্বল! by ফজলুল বারী
দৈনিক সংগ্রামের ওয়েবসাইটে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া অবস্থা! যুদ্ধাপরাধী নাম্বার ওয়ান গোলাম আযমের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে এত প্রতিবাদ হচ্ছে(!) কিন্তু দেশের মূলধারার কোন মিডিয়া সে খবরও পাচ্ছেনা! এ গ্রেফতারের প্রতিবাদে দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় চলছে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র সংগ্রামের পাতায়!
শুধু খুলনা থেকেই পাঁচ সহস্রাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি বিবৃতি দিয়েছেন। ‘লাখে খাখে সেনা মরে কাতারে কাতার’ এর মতো। গুনে দেখি কয়েকজন এবং প্রমুখ। বাংলায় অবশ্য এ ব্যাপারে এই ‘প্রমুখ’ শিরোনামের নিরাপদ একটি শব্দ আছে। শুক্রবার প্রিজন সেল ঘুরে এসে সংগ্রামের প্রতিবেদকের কাছে কিছু অভিযোগ করেছেন গোলাম আযমের ছেলে। অভিযোগের মধ্যে আছে দেশের টপ ওয়ান্টেড এই যুদ্ধাপরাধীকে প্রিজন সেলে মোটা চালের ভাত দেয়া হয়েছে। তরকারি যা দেয়া হচ্ছে তা মজাদার না। গোলাম আযম ভালো খেতে পারছেন না। কম্বল যেটি দেয়া হয়েছে তা নিম্নমানের। তার ছেলে বলেছেন, তাদের বাসার কাজের লোকের কম্বলও অনেক উন্নতমানের।
ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে একটি স্টেটাস দিতেই অনেক প্রতিক্রিয়া আসে। একাত্তরের এই আত্মস্বীকৃত বালাদেশ বিরোধী, যে একা লক্ষ লক্ষ নিরীহ দেশবাসীর হত্যা, ভোগান্তিসহ নানাকিছুর জন্য দায়ী, তার জন্য সোনারগাঁও-রূপসীবাংলার রূম ভাড়া, চিকন চালের ভাত এসবের ব্যবস্থা করতে হবে কিনা সে শ্লেষের সে প্রশ্নও আসে। মোটা চালের অভিযোগটি দেখে নিজের পরিবারের দুঃসহ শরণার্থী জীবনের গল্প বলেন আমাদের এক সাংবাদিক বোন সুপ্রীতি ধর। চোখে ভিজে আসে। একাত্তরের এমন গল্প আমাদের দেশের কোটি কোটি পরিবারের। যারা দেশান্তরী শরণার্থী হয়েছেন অথবা নিরুপায় অবরুদ্ধ দেশে ভীতসন্ত্রস্ত পড়েছিলেন সবার।
একাত্তরে সুপ্রীতি ধরের বাবাকে ধরে নিয়ে যাবার পর তার মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার শালীহর গ্রামের বাড়ি থেকে মোটামুটি এক কাপড়ে রওনা হয়েছিলেন অজানার পথে। পথে পথে চিড়া-গুড় খেয়ে কাটাতে হয়েছে। শনির হাওর পাড়ি দিতে তারা নৌকার পাটাতনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পথে রাজাকাররা নৌকার মাঝিকে ডেকে জিজ্ঞ্যেস করেছিল, কি নিয়ে যাও? মাঝির উত্তর ছিল, পাট নিয়ে যাই। আর আল্লাহ আল্লাহ বলে ডাকছিল মাঝি। এভাবে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নেত্রকোনার হাওর হয়ে, সুনামগঞ্জের পাশ দিয়ে তারা পৌঁছান আসাম সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে। সেখানে খবর এলো কাছাকাছি শরণার্থী শিবিরে কলেরা লেগেছে। লাশও আসতে দেখলেন তার মা-দিদিরা। তখন ঠিক হলো ওখানেই একজন হরিদাস বাবুর বাড়িতে রাত কাটানো হবে, শিবিরে যাওয়া ঠিক হবে না। ভিতরের অবস্থা দেখে আসতে সুপ্রীতির বড় দাদাকে আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাই মা পদে পদে শংকা আর ভয় নিয়ে যাচ্ছিল পুরোটা পথ। পরে শুনেছেন, মা একটি লাশ দেখে তখন আঁতকে উঠেছিলেন।
ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে একটি স্টেটাস দিতেই অনেক প্রতিক্রিয়া আসে। একাত্তরের এই আত্মস্বীকৃত বালাদেশ বিরোধী, যে একা লক্ষ লক্ষ নিরীহ দেশবাসীর হত্যা, ভোগান্তিসহ নানাকিছুর জন্য দায়ী, তার জন্য সোনারগাঁও-রূপসীবাংলার রূম ভাড়া, চিকন চালের ভাত এসবের ব্যবস্থা করতে হবে কিনা সে শ্লেষের সে প্রশ্নও আসে। মোটা চালের অভিযোগটি দেখে নিজের পরিবারের দুঃসহ শরণার্থী জীবনের গল্প বলেন আমাদের এক সাংবাদিক বোন সুপ্রীতি ধর। চোখে ভিজে আসে। একাত্তরের এমন গল্প আমাদের দেশের কোটি কোটি পরিবারের। যারা দেশান্তরী শরণার্থী হয়েছেন অথবা নিরুপায় অবরুদ্ধ দেশে ভীতসন্ত্রস্ত পড়েছিলেন সবার।
একাত্তরে সুপ্রীতি ধরের বাবাকে ধরে নিয়ে যাবার পর তার মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার শালীহর গ্রামের বাড়ি থেকে মোটামুটি এক কাপড়ে রওনা হয়েছিলেন অজানার পথে। পথে পথে চিড়া-গুড় খেয়ে কাটাতে হয়েছে। শনির হাওর পাড়ি দিতে তারা নৌকার পাটাতনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পথে রাজাকাররা নৌকার মাঝিকে ডেকে জিজ্ঞ্যেস করেছিল, কি নিয়ে যাও? মাঝির উত্তর ছিল, পাট নিয়ে যাই। আর আল্লাহ আল্লাহ বলে ডাকছিল মাঝি। এভাবে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নেত্রকোনার হাওর হয়ে, সুনামগঞ্জের পাশ দিয়ে তারা পৌঁছান আসাম সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে। সেখানে খবর এলো কাছাকাছি শরণার্থী শিবিরে কলেরা লেগেছে। লাশও আসতে দেখলেন তার মা-দিদিরা। তখন ঠিক হলো ওখানেই একজন হরিদাস বাবুর বাড়িতে রাত কাটানো হবে, শিবিরে যাওয়া ঠিক হবে না। ভিতরের অবস্থা দেখে আসতে সুপ্রীতির বড় দাদাকে আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাই মা পদে পদে শংকা আর ভয় নিয়ে যাচ্ছিল পুরোটা পথ। পরে শুনেছেন, মা একটি লাশ দেখে তখন আঁতকে উঠেছিলেন।
সুপ্রীতিকে নিয়ে হয়েছিল বিপদ। জন্মের পর যে দুধ ছাড়া অন্য কিছুই খায়নি, তাকে তখন দুধ খাওয়াবেন কি করে মা। একাত্তরের শুরুতে তাদের বাড়ি লুট হয়। দুধের বোতলটিও পর্যন্ত ভেঙ্গে দিয়ে যায় লুটেরার দল। তাই তারা দেশ ছেড়ে যাবার সময় পরিবারের শিশু সন্তানটির জন্যে দুধের নতুন একটি বোতলও জোগাড় করে নেয়া যায়নি। সুপ্রীতি বলেন, কতো কষ্টে সেই শরণার্থী দিনগুলো কাটিয়েছি আমরা, তা কি এই গোলাম আযম জানে? শরণার্থী শিবিরে তখন মোটা চাল দেয়া হতো। কী যে গন্ধ ছিল সেই চালে....। মা সে ভাত তাকে খাওয়ানোর অনেক চেষ্টা করতেন। আসামের বালাড ক্যাম্পের পাশেই ছিল একটা পোস্ট অফিস। একরাত শিবিরের তারা মাটির একটা ঘরে সবাই বসে কাটানোর পরদিন সেখানকার পোস্ট মাস্টারের চোখে পড়েন। একাত্তরেই চাকরি করতেন সুপ্রীতির মা। সে পোস্ট মাস্টারের মনে হলো, এই লাখো মানুষের দলে তারা একটু অন্যরকম। তাই তাদের জায়গা হয়ে গেল পোস্ট অফিসের বারান্দায়। লাগোয়া শরণার্থী শিবিরে গাদাগাদি থাকতেন অনেক মানুষ। বৃষ্টি শুরু হলেও সে বারান্দাতেও বৃষ্টি বাঁচিয়ে থাকতে অনেক কষ্ট হতো। মায়ের কাছে শুনেছেন সেই বারান্দায় একদিন খিচুড়ি রান্না হয়েছিল। শুধু সেদিনই তিনি ভাত খেতে শুরু করেছিলেন।
সুপ্রীতির বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ৭১ সালের ১৬ মে। এরপর থেকে তারা আর তার খোঁজ পাননি। নানা রকম খবর পেয়ে নানা জায়গায় ছুটে গেছে তার বড় ভাই। কিন্তু কেউ কোন সঠিক জবাব দিকে পারেনি। কেউ বলেছে, ওখানে গুলি করে মেরেছে, লাশ ভেসে গেছে। কেউ বলেছে, একটা লাশ পড়েছিল মসজিদের সিড়িতেঁ, সেটা নাকি তার বাবার। এরকম অনেক তথ্য। বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিনই তারা দেশে থেকে গিয়েছিলেন । সুপ্রীতির দাদার বয়স তখন সাড়ে ১৭, আর তার দিদির ১৯। দুজনকেই নিয়েই মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আরেক ভাই সুব্রত শংকর ধর (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মেধাবী ছাত্র ও শিক্ষক বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত) তখন ক্লাস সিক্সে আর সুপ্রীতি তিন বছরের। একসময় যখন তাদের মুসলমান হওয়ার ব্যাপারে বেশ চাপ আসতে লাগলো , দিদিকেও নিয়ে যাবে এমন হুমকির মুখে মা তাদের নিয়ে পাড়ি দিলেন অজানা পথে। তারপর বালাড পোষ্ট অফিসের বারান্দার শরণার্থী জীবন।
দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন আগে তার ঠাকুরমা (তারা তখন কলকাতায়) খবর পান যে তার বাবাকে গাজীপুরে একটা ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। ঠাকুরমা তখন ঠিক করেন যে, কাউকে সঙ্গে নিয়ে উনি আসবেন। ঠিক এসময়ই ব্রহ্মপুত্র ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়া হয়। সেটা ছিল ৬ই ডিসেম্বর। তাই আর আসা হয়নি ঠাকুরমার। সুপ্রীতি ধরের বাবাও আর কোনদিন ফিরে আসেননি। এমন বিপন্ন ভীত সন্ত্রস্ত জীবনের গল্প মুক্তিযুদ্ধে গোলাম আযমদের সৃষ্ট পরিস্থিতির শিকার বাংলাদেশের কোটি কোটি পরিবারের। এখন সে সব ঘটনার মাস্টার মাইন্ড গোলাম আযমকে চল্লিশ বছর অপেক্ষার পর বিচারের উদ্দেশে গ্রেফতারের পর তার আরাম-আয়েশ, চিকন চালের ভাত, সুগন্ধি মোলায়েম কম্বলের ব্যবস্থার আগে কি এসব শহীদ পরিবারের মতামত নেয়া লাগবে? কী বলে বাংলাদেশ?
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
No comments