সদরে অন্দরে-জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় রেফার্ডপ্রাপ্তদের কথা by মোস্তফা হোসেইন

পাবলিক পরীক্ষাসহ শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে সরকার। ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে পাবলিক পরীক্ষাগুলো উল্লেখ করার মতো। নতুন পদ্ধতিতে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ২০১০ সাল থেকে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে তারও আগের বছর থেকে। অষ্টম শ্রেণীর (জেএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা নবম শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে।


কিন্তু পদ্ধতি পরিবর্তন হওয়ার কারণে এবং শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার প্রথম বছর পরীক্ষা অনুষ্ঠানের পর এক থেকে তিন বিষয় পর্যন্ত অনুত্তীর্ণদেরও রেফার্ড পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। এতে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর ঝরেপড়ার সম্ভাবনা কমে যায়। সুযোগটি গ্রহণ করে দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। ফলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জীবনে অন্তত আশার আলো দেখা দেয়। যদিও রেফার্ড নামক আরেকটি পরীক্ষার প্রতিবন্ধকতা তাদের সামনে ঝুলে থাকে। তবে সরকার প্রদত্ত সুবিধা তারা যথাসময় গ্রহণ করার পরও হালে দেখা গেছে, ২৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বিপাকে পড়ে গেছে। কারণ তারা রেফার্ড পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পরও উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এটা অষ্টম শ্রেণীর কারিকুলামের ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হয়েছে। এদিকে এসব শিক্ষার্থী এক বছর নবম শ্রেণীতে লেখাপড়া করার পর স্কুলে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দশম শ্রেণীতেও ভর্তি হয়েছে। কিন্তু জেএসসি রেফার্ড পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ার কারণে তাদের অবস্থা এখন ত্রিশঙ্কু। একদিকে স্কুলের পরীক্ষায় পাস করে তারা দশম শ্রেণীতে পড়ছে, অন্যদিকে বোর্ড পরীক্ষায় এক থেকে তিন বিষয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পাওয়ায় তাদের অষ্টম শ্রেণীতে আবার ফেরত যেতে হতে পারে।
এটা গোলমেলে ব্যাপার হিসেবে চিহ্নিত। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে দুই ক্লাস নিচে নেমে যেতে হবে। এটা অমানবিকও। এটা শিক্ষার্থীর জীবনে ধস ডেকে আনতে পারে। শিক্ষার্থীর মনস্তাত্তি্বক যে বাধা তৈরি হবে, সেই বাধা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হবে। সাধারণত কোনো শিক্ষার্থীকে কোনো কারণে যদি একই শ্রেণীতে দুই বছর থাকতে হয়, তাহলে তার যে মানসিকতা তৈরি হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। প্রথম কথা হচ্ছে, শিক্ষার্থী তার সহপাঠীদের ছেড়ে দেবে। এতে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হবে তার মধ্যে। অন্যদিকে জুনিয়রদের সঙ্গে গিয়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো মানসিকতাও তার মধ্যে জন্ম নেয় না। এক ধরনের হীন মানসিকতা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে।
দশম শ্রেণীতে পাঠরত একজন শিক্ষার্থীকে যদি অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হতে বলা হয়, তাহলে সেই শিক্ষার্থীর পক্ষে কখনো আর ভালো ফল করা সম্ভব হবে না। এমন অভিমত প্রদান করেন কুমিল্লা বোর্ডের অধীন শশীদল হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন। তাঁর মতে, একই ক্লাসে একাধিক বছর অবস্থান করতে হলে শিক্ষার্থীর মেধাশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই মনস্তাত্তি্বক কারণে। মনস্তাত্তি্বক প্রতিবন্ধকতা তার জীবনে এতটাই স্থায়ী হয় যে সারা জীবন তাকে গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়। একজন শিক্ষার্থীর জন্য এই মনস্তাত্তি্বক আঘাত ক্ষতিকর জেনেও সেই আঘাতই তার জন্য অনিবার্য করে দেওয়া কি ঠিক? বর্তমান পরিস্থিতিতে রেফার্ড পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ কিন্তু নবম শ্রেণীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য এটা প্রযোজ্য।
শিক্ষার্থীর মনস্তাত্তি্বক অবস্থা মূল্যায়ন করার সুবিধার্থে একজন শিক্ষককে মনস্তত্ত্ববিদ্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে হয়। উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর জীবনে যাতে মনস্তাত্তি্বক প্রতিবন্ধকতা না আসতে পারে এবং শিক্ষক যাতে শিক্ষার্থীকে মনস্তাত্তি্বক দিক থেকে সব সময় চাঙ্গা রাখতে পারেন। কিন্তু উলি্লখিত পরীক্ষার্থীদের যে পরিবেশে পড়তে হচ্ছে, তা কিন্তু মোটেও গ্রহণীয় নয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাদের বিষয়ে যে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে, তারও পরিবর্তন প্রয়োজন। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর ১২ ধারা মোতাবেক 'মাধ্যমিক পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষায় কোনো ছাত্রছাত্রী এক বা দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হলে তাকে সে বিষয়ে বা বিষয় দুটিতে দুইবার অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি পরিবর্তিত হলে পুরনো শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুযায়ী ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।' ২০১০ সালে যেসব পরীক্ষার্থী সর্বোচ্চ তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার পরও এখনো রেফার্ড পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি, তাদের জন্য শিক্ষানীতিমালার এই অধ্যায়টি শিথিল করা যেতে পারে। যদিও দুই বিষয়ের পরিবর্তে তিন বিষয় পর্যন্ত পরীক্ষার্থীদের জন্য শিথিল করা হয়েছে আগেই। অন্তত পদ্ধতিটি নতুন হওয়ার কারণে অন্তত পাঁচ বছর পর্যন্ত শিথিল করা হোক। আর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগ পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দিয়ে সেসব পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগও করা যেতে পারে। এমনটা করা হলে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী কিংবা রেওয়াজের বাইরে কিছু করা হবে না।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সেই ধারা এখনো বহাল আছে। যেমন দূরশিক্ষণ মাধ্যমে যারা বিএড পরীক্ষা দেয় তারা সেই সুযোগটি পেয়ে থাকে। প্রথম সেমিস্টারে কোনো বিষয়ে অকৃতকার্য হলে দ্বিতীয় সেমিস্টারের আগে সেই পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়। সেবারও যদি অকৃতকার্য হয়, তাহলে তৃতীয় সেমিস্টারের সময় সে প্রথম সেমিস্টারের বিষয়টি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পায়। এখানেও সেই পদ্ধতি অন্তত পাঁচ বছরের পরীক্ষার্থীদের জন্য বহাল করা যেতে পারে। হয়তো সেই সময়টিকে এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত বহাল রাখা যেতে পারে। দরকার হলে বছরের যেকোনো সময় এই রেফার্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে যাদের রেজিস্ট্রেশন হয়নি, তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ তৈরি করতে হবে। যাতে তাদের এসএসসি পরীক্ষা দিতে কোনো অসুবিধার সম্মুখীন না হতে হয়।
এখন শিক্ষানীতির দোহাই দিয়ে কেউ কেউ এ বিষয়ে আপত্তি করতেই পারেন। তাঁদের জন্যই বলা যায়_শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর প্রতিটি অধ্যায় কিন্তু একবারে কার্যকর করা সম্ভব নয়_এমনটা কেউ প্রত্যাশাও করে না।
এদিকে এ বছরও যারা জেএসসি পরীক্ষায় এক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের নবম শ্রেণীতে ভর্তির সুপারিশ করে বোর্ড চেয়ারম্যানরা মন্ত্রণালয়ে নির্দেশের জন্য প্রেরণ করেছেন। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়, যদি শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেওয়াই হয় তাহলে অন্তত তারা যাতে সর্বাঙ্গীণ সুবিধা পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এবার এক বিষয়ে পরীক্ষার্থীদের জন্য রেফার্ডের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। তাকে দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া হিসেবে চালু করতে হবে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.