সাম্রাজ্যবাদ ও কিছু অভিজ্ঞতা by হায়দার আকবর খান রনো
সাম্রাজ্যবাদ যে কী ভয়ঙ্কর রকমের মানবতার শত্রু তা আমরা যারা দুইশত বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে কলোনি হিসেবে ছিলাম, তারা হাড়ে হাড়ে জানি। এখন সরাসরি সাম্রাজ্যবাদ আর নেই। পুরনো আমলের সরাসরি ঔপনিবেশিক যুগ আর নেই।
তাই অনেক তথাকথিত পণ্ডিত এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশের রাষ্ট্রনায়করা সাম্রাজ্যবাদ কথাটি ব্যবহার করতে চান না। অথচ আমরা দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বিভিন্ন দেশে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে, গণতন্ত্র হত্যাই শুধু করেনি, গণহত্যাও করেছে। একেবারে সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ইরাক ও আফগানিস্তান। এছাড়াও অর্থনৈতিকভাবেও শোষণ করছে যে কর্পোরেট পুঁজি, তাদের শোষণের মাত্রা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের চেয়ে কম নয়, বরং অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিম ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সরকার ও প্রশাসন বস্তুত নিজ নিজ দেশের কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করে এবং প্রয়োজনে যুদ্ধ করে। একথা কারোর অজানা নয় যে, ইরাকের তেল সম্পদ লুণ্ঠন করার স্বার্থেই মার্কিন প্রশাসন জাতিসংঘের সিদ্ধান্তকে অমান্য করে পুরোপুরি মিথ্যা অজুহাতে ইরাক দখল করেছিল। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই। মধ্য এশিয়ার গ্যাস সম্পদ পাইপ লাইন দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কিনের তেল কোম্পানিগুলোর দরকার ছিল আফগানিস্তান। মার্কিন প্রশাসনের দ্বারা তৈরি তালেবানদের সঙ্গে মার্কিনের ভালোই সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আফগানিস্তানের উত্তরে অবস্থিত নর্দার্ন অ্যালেয়ান্সের সঙ্গে তালেবানদের বিরোধের কারণে যে অবস্থাটা তৈরি হয়েছিল তাতে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে পাইপ লাইন বসানো সম্ভব হচ্ছিল না, ঠিক এই পর্যায়ে মার্কিনি শাসকরা ও গ্যাস কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিল তালেবানদের সরাতে হবে। তাই ন্যাটোর নামে আফগানিস্তান দখল করে তাদের পুতুল কারজাইকে ক্ষমতায় বসাল। এগুলো কি সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্য নয়?
অথচ পশ্চিমা বিজ্ঞজনেরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি উচ্চারণ করতে চান না। এসব বিদগ্ধজন সম্পর্কে বামপন্থী চিন্তাবিদ ও সাম্রাজ্যবাদের কঠোর সমালোচক হ্যারি ম্যাগডফ ১৯৭১ সালেই বলেছিলেন (যখন ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছিল) ‘সচরাচর মার্জিত বিজ্ঞজনেরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটির ব্যবহার পছন্দ করতেন না। তারা এটিকে অরুচিকর ও অবৈজ্ঞানিক বিবেচনা করতেন।’ এমনকি কিছু কিছু মার্কসবাদী বলে দাবিদার বুদ্ধিজীবীও সরাসরি সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি এড়িয়ে যান। ভারতের মার্কসবাদী পণ্ডিত প্রভাত পট্টনায়ক ১৯৯০ সালে পল সুইজী সম্পাদিত 'Monthly Review' পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদের কি হলো?’ তিনি লিখেছিলেন ‘আজকের তরুণ মার্কসবাদীরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি উল্লেখ করতে যেন কেমন সঙ্কোচ বোধ করেন। আজকের দিনের জ্বলন্ত বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের উল্লেখ ছাড়াই।’ ইদানীংকালে মার্কসবাদী পত্রপত্রিকা থেকে সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি প্রায় উধাও হয়ে গেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন।
অন্যদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইসলামিক সংগঠন আজকাল সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে যথেষ্ট সোচ্চার। কোনো কোনো সংগঠন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামও অব্যাহত রেখেছে। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস অথবা লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরাইল ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ করছে। তবে এসব সংগঠনের পক্ষ থেকেও সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা উপস্থিত করা হয় না। অথচ অর্থনৈতিক দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত কর্পোরেট পুঁজির অর্থনৈতিক শোষণ এবং সেজন্য নানা ধরনের কৌশল হচ্ছে আজকের সাম্রাজ্যবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং এটা করতে পারে অধীনস্থ দেশের শাসকশ্রেণীর সাহায্যে, যে শাসকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্ট লাভেই সন্তুষ্ট থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমেরিকার যুদ্ধ করার দরকার হয় না, কারণ শাসকবর্গ স্বেচ্ছায় মার্কিন স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু যখনই তৃতীয় বিশ্বের কোনো শাসককে পোষ মানাতে পারে না, তখনই তারা করে সামরিক আগ্রাসন, হত্যা, ক্যুদেতা, এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করতে তারা কুণ্ঠাবোধ করবে।
তবে স্বাভাবিক সময় তারা তৃতীয় বিশ্বের নতজানু শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলই অবলম্বন করে। আর এ ব্যাপারে তাদের হাতে আছে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের এই নয়া ঔপনিবেশিক কৌশল এবং বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে আমরা বিশ্ব রাজনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতিও বুঝতে পারব না এবং বাংলাদেশ কীভাবে ঠকছে তাও বুঝতে পারব না। এ ব্যাপারে কর্পোরেট সাম্রাজ্যের এজেন্ট অথবা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র সাবেক কর্মচারীদের দ্বারা বর্ণিত বিবরণ ও কনফেনশন থেকে অনেক কিছুই জানতে পারি। এভাবে কর্পোরেট সাম্রাজ্যের অন্দরমহলের কিছু ছিটেফোঁটা যেসব খবর আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়, তাতে আমরা আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। এখানে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির Confessional statement তুলে ধরব।
প্রথমে ধরা যাক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিেসর নিজস্ব ভাষায় তার অভিজ্ঞতার কথা। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ এবং বরিষ্ঠ সহ-সভাপতি। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মণ্ডলীর চেয়ারম্যান। ২০০১ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার লেখা Globalization and its Discontents বহুল সমাদৃত গ্রন্থ। তিনি ভেতর থেকে দেখেছেন মার্কিন প্রশাসনকে এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-কে। উপরোক্ত গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকে কাজ করে আমার চোখ খুলে গেছে।... আমি বুঝতে পারছি বর্তমান বিশ্বায়নের বিধ্বংসী লুটেরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করবে এবং প্রধানত এর বলি হবে গরিব মানুষরা।’ আরেক প্রবন্ধে (অন্দরমহলের অভিজ্ঞতা) তিনি লিখেছেন, ‘আমি প্রত্যক্ষ করেছি, কীভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মার্কিন সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করে।... এই সংস্থার কাজকর্ম গোপনে পরিচালিত হয় এবং সেই কারণে এই সংস্থা গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।... তারা উন্নয়নের জন্য যে দাওয়াইয়ের কথা মুখে বলে তাতে প্রতিকার তো হয়ই না, উপরন্তু ক্ষতিই হয়।’ তিনি প্রসঙ্গক্রমে ‘ওগঋ-এর ক্ষেত্রে সন্ত্রাস’ শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন।
গত ২১ নভেম্বর আমার দেশ’র পাতায় ফাহমিদ-উর রহমানের এক লেখা ছাপা হয়েছে। শিরোনাম ‘কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ’। এই রচনায় তিনি বহুজাতিক কর্পোরেশনের এককালীন এজেন্ট জন পারকিনসের Confessional statement থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ওই রচনায় তিনি কর্পোরেট সাম্রাজ্যের তৃতীয় বিশ্ববিরোধী, মানবতাবিরোধী ভয়ঙ্কর কাজকর্মের চেহারা তুলে ধরেছেন।
জন পারকিনসের লেখা Confessions of Economic Hit Man গ্রন্থ থেকে যেসব উদ্ধৃতি আছে তা কর্পোরেট সাম্রাজ্যের ভয়ঙ্কর কুকীর্তি সম্পর্কে ধারণা করতে সাহায্য করবে। বিবেকের তাড়নায় আরও কেউ কেউ অপকর্মের স্বীকারোক্তি তুলে ধরেছেন। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন সিআইএ’র এজেন্ট, কেউ বা বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ-এর সাবেক কর্মচারী, কেউবা সাম্রাজ্যবাদের অন্দরমহলের সাক্ষী।
আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ সরাসরি দেশ দখল খুব বেশি না করলেও, বিভিন্ন জায়গায় সামরিক যে অভিযান চালিয়েছে মার্কিনের বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে, তারও সাক্ষী পাওয়া যাবে একদা আমেরিকার মেরিন কোরের এক অফিসারের অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি হচ্ছেন মেজর জেনারেল স্মেডলে বাটলার। ১৯৩০ সালেই (যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজকের মতো এত ভয়ঙ্কর রূপে আত্মপ্রকাশ করেনি) তিনি কী বলেছিলেন :
‘আমাদের দেশের সবচেয়ে তত্পর সামরিক বাহিনী মেরিন কোরের সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমি তেত্রিশ বছর চার মাস চাকরি করেছি। সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট থেকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত সব রকম কমিশন্ড পদে আমি ছিলাম। এই সমগ্রকাল আমি বড় ব্যবসায়ীদের, ওয়াল স্ট্রিটের এবং ব্যাংকের উঁচু ধরনের মাস্তান হিসেবেই কাজ করেছি। সংক্ষেপে আমি পুঁজিবাদের জন্য র্যাকেটিয়ার হিসেবেই কাজ করেছি।’ তিনি বলেছেন যে, আমেরিকান তেল কোম্পানির পক্ষ হয়েই মেক্সিকো, বিশেষ করে ট্যামপিকো, (১৯১৪ সালে), ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকের পক্ষ হয়ে হাইতি ও কিউবায়, ব্রাউন ব্রাদার্সের পক্ষ হয়ে নিকারাগুয়ায় (১৯০২-১৯১২ সাল), আমেরিকান চিনি কোম্পানির স্বার্থে ডোমিনিকান রিপাবলিকে (১৯১৬ সালে), আমেরিকান ফ্রুট (ফল) কোম্পানির স্বার্থে হন্ডুরাসে এবং স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল কোম্পানির স্বার্থে চীনে (১৯২৭ সালে) সামরিক অভিযানে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এখনও একইভাবে বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হামলা চালাচ্ছে আমেরিকান বহুজাতিক কর্পোরেশনের স্বার্থে ও প্রয়োজনে।
এরকম দৃষ্টান্ত আরও অনেক দেয়া যেতে পারে। সংক্ষিপ্ত রচনায় তা সম্ভব হচ্ছে না। রচনা শেষ করার আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আরেকটি অন্দরমহলের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে চাই। গত ২৬ নভেম্বর আমার দেশ’র প্রথম পাতায় পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তিনিও অন্দরমহলের এক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। মার্কিন বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির সুবিধা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘বিগত চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে পাকে-চক্রে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে জেমস মরিয়ার্টির অন্তত দুই পূর্বসূরির কাছে একই বিষয় নিয়ে দেনদরবার করার অভিজ্ঞতা আমার ঝুলিতে রয়েছে।’ সে অভিজ্ঞতা ভালো নয়। প্রসঙ্গটি তিনি রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস এবং পেট্রিসিয়া বিউটিনেসের কাছে উত্থাপন করলে তারা সম্মত হননি। তিনি আরও লিখেছেন, ‘পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলি এবং সিনেটর ম্যাককেইনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তাদের কাছেও একই যুক্তি পেশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এবং সিনেটে বাংলাদেশী পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের যথাযথ আইন প্রণয়নের অনুরোধ করেছিলাম। বলাই বাহুল্য, এসব অনুরোধ কোনো কাজে আসেনি।’ আসবেও না। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আদায় করে নেবে তাদের ষোলআনা স্বার্থ। রাজনৈতিক চাপ দিয়েই হোক, তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল শাসকদের কিনে নিয়েই হোক অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমেই হোক, সাম্রাজ্যবাদ তার মুনাফা ও লাভটুকু পুরো মাত্রায় নিয়েই ছাড়বে।
এখনও তাই হতে চলেছে। বর্তমান সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস ক্ষেত্রই কেবল তুলে দিচ্ছে তাই-ই নয়। বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে টিফা চুক্তি করতে চলেছে তাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। যেসব বিষয়ে চুক্তি হবে, সেগুলো ডঞঙ-এর অধীনে বহুপাক্ষিক বিষয় হিসেবে গণ্য। তারপরও কেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে হবে? বিনিময়ে তারা কিন্তু কোনো বাণিজ্য সুবিধা আমাদের দেবে না। তবু আমাদের কেন এমন চুক্তি করতে হবে? আসলে কি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার জন্য আগেই এমন কোনো গোপন চুক্তি করে এসেছে যে এখন তাকে টিফা গিলতে হচ্ছে এবং সাগরের গ্যাস তুলে দিতে হচ্ছে? এমন সন্দেহ অমূলক নয়।
কোনোকিছুই দীর্ঘকাল চাপা থাকে না। সত্য প্রকাশিত হবেই। সরকার যদি তেমন কোনোকিছু করে থাকে, তবে তাও প্রকাশিত হবে এবং এজন্য তাদের খেসারত দিতে হবে। তবে তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, দেশ ও জাতিকে খেসারত দিতে হবে। সে হবে বড় দুর্ভাগ্যের কথা। তাই সময় থাকতে এখনই সরকারের এমন জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজকে প্রতিহত করতে হবে।
অথচ পশ্চিমা বিজ্ঞজনেরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি উচ্চারণ করতে চান না। এসব বিদগ্ধজন সম্পর্কে বামপন্থী চিন্তাবিদ ও সাম্রাজ্যবাদের কঠোর সমালোচক হ্যারি ম্যাগডফ ১৯৭১ সালেই বলেছিলেন (যখন ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছিল) ‘সচরাচর মার্জিত বিজ্ঞজনেরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটির ব্যবহার পছন্দ করতেন না। তারা এটিকে অরুচিকর ও অবৈজ্ঞানিক বিবেচনা করতেন।’ এমনকি কিছু কিছু মার্কসবাদী বলে দাবিদার বুদ্ধিজীবীও সরাসরি সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি এড়িয়ে যান। ভারতের মার্কসবাদী পণ্ডিত প্রভাত পট্টনায়ক ১৯৯০ সালে পল সুইজী সম্পাদিত 'Monthly Review' পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদের কি হলো?’ তিনি লিখেছিলেন ‘আজকের তরুণ মার্কসবাদীরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি উল্লেখ করতে যেন কেমন সঙ্কোচ বোধ করেন। আজকের দিনের জ্বলন্ত বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের উল্লেখ ছাড়াই।’ ইদানীংকালে মার্কসবাদী পত্রপত্রিকা থেকে সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি প্রায় উধাও হয়ে গেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন।
অন্যদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইসলামিক সংগঠন আজকাল সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে যথেষ্ট সোচ্চার। কোনো কোনো সংগঠন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামও অব্যাহত রেখেছে। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস অথবা লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরাইল ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ করছে। তবে এসব সংগঠনের পক্ষ থেকেও সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা উপস্থিত করা হয় না। অথচ অর্থনৈতিক দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত কর্পোরেট পুঁজির অর্থনৈতিক শোষণ এবং সেজন্য নানা ধরনের কৌশল হচ্ছে আজকের সাম্রাজ্যবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং এটা করতে পারে অধীনস্থ দেশের শাসকশ্রেণীর সাহায্যে, যে শাসকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্ট লাভেই সন্তুষ্ট থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমেরিকার যুদ্ধ করার দরকার হয় না, কারণ শাসকবর্গ স্বেচ্ছায় মার্কিন স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু যখনই তৃতীয় বিশ্বের কোনো শাসককে পোষ মানাতে পারে না, তখনই তারা করে সামরিক আগ্রাসন, হত্যা, ক্যুদেতা, এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করতে তারা কুণ্ঠাবোধ করবে।
তবে স্বাভাবিক সময় তারা তৃতীয় বিশ্বের নতজানু শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলই অবলম্বন করে। আর এ ব্যাপারে তাদের হাতে আছে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের এই নয়া ঔপনিবেশিক কৌশল এবং বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে আমরা বিশ্ব রাজনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতিও বুঝতে পারব না এবং বাংলাদেশ কীভাবে ঠকছে তাও বুঝতে পারব না। এ ব্যাপারে কর্পোরেট সাম্রাজ্যের এজেন্ট অথবা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র সাবেক কর্মচারীদের দ্বারা বর্ণিত বিবরণ ও কনফেনশন থেকে অনেক কিছুই জানতে পারি। এভাবে কর্পোরেট সাম্রাজ্যের অন্দরমহলের কিছু ছিটেফোঁটা যেসব খবর আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়, তাতে আমরা আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। এখানে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির Confessional statement তুলে ধরব।
প্রথমে ধরা যাক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিেসর নিজস্ব ভাষায় তার অভিজ্ঞতার কথা। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ এবং বরিষ্ঠ সহ-সভাপতি। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মণ্ডলীর চেয়ারম্যান। ২০০১ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার লেখা Globalization and its Discontents বহুল সমাদৃত গ্রন্থ। তিনি ভেতর থেকে দেখেছেন মার্কিন প্রশাসনকে এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-কে। উপরোক্ত গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকে কাজ করে আমার চোখ খুলে গেছে।... আমি বুঝতে পারছি বর্তমান বিশ্বায়নের বিধ্বংসী লুটেরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করবে এবং প্রধানত এর বলি হবে গরিব মানুষরা।’ আরেক প্রবন্ধে (অন্দরমহলের অভিজ্ঞতা) তিনি লিখেছেন, ‘আমি প্রত্যক্ষ করেছি, কীভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মার্কিন সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করে।... এই সংস্থার কাজকর্ম গোপনে পরিচালিত হয় এবং সেই কারণে এই সংস্থা গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।... তারা উন্নয়নের জন্য যে দাওয়াইয়ের কথা মুখে বলে তাতে প্রতিকার তো হয়ই না, উপরন্তু ক্ষতিই হয়।’ তিনি প্রসঙ্গক্রমে ‘ওগঋ-এর ক্ষেত্রে সন্ত্রাস’ শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন।
গত ২১ নভেম্বর আমার দেশ’র পাতায় ফাহমিদ-উর রহমানের এক লেখা ছাপা হয়েছে। শিরোনাম ‘কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ’। এই রচনায় তিনি বহুজাতিক কর্পোরেশনের এককালীন এজেন্ট জন পারকিনসের Confessional statement থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ওই রচনায় তিনি কর্পোরেট সাম্রাজ্যের তৃতীয় বিশ্ববিরোধী, মানবতাবিরোধী ভয়ঙ্কর কাজকর্মের চেহারা তুলে ধরেছেন।
জন পারকিনসের লেখা Confessions of Economic Hit Man গ্রন্থ থেকে যেসব উদ্ধৃতি আছে তা কর্পোরেট সাম্রাজ্যের ভয়ঙ্কর কুকীর্তি সম্পর্কে ধারণা করতে সাহায্য করবে। বিবেকের তাড়নায় আরও কেউ কেউ অপকর্মের স্বীকারোক্তি তুলে ধরেছেন। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন সিআইএ’র এজেন্ট, কেউ বা বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ-এর সাবেক কর্মচারী, কেউবা সাম্রাজ্যবাদের অন্দরমহলের সাক্ষী।
আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ সরাসরি দেশ দখল খুব বেশি না করলেও, বিভিন্ন জায়গায় সামরিক যে অভিযান চালিয়েছে মার্কিনের বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে, তারও সাক্ষী পাওয়া যাবে একদা আমেরিকার মেরিন কোরের এক অফিসারের অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি হচ্ছেন মেজর জেনারেল স্মেডলে বাটলার। ১৯৩০ সালেই (যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজকের মতো এত ভয়ঙ্কর রূপে আত্মপ্রকাশ করেনি) তিনি কী বলেছিলেন :
‘আমাদের দেশের সবচেয়ে তত্পর সামরিক বাহিনী মেরিন কোরের সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমি তেত্রিশ বছর চার মাস চাকরি করেছি। সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট থেকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত সব রকম কমিশন্ড পদে আমি ছিলাম। এই সমগ্রকাল আমি বড় ব্যবসায়ীদের, ওয়াল স্ট্রিটের এবং ব্যাংকের উঁচু ধরনের মাস্তান হিসেবেই কাজ করেছি। সংক্ষেপে আমি পুঁজিবাদের জন্য র্যাকেটিয়ার হিসেবেই কাজ করেছি।’ তিনি বলেছেন যে, আমেরিকান তেল কোম্পানির পক্ষ হয়েই মেক্সিকো, বিশেষ করে ট্যামপিকো, (১৯১৪ সালে), ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকের পক্ষ হয়ে হাইতি ও কিউবায়, ব্রাউন ব্রাদার্সের পক্ষ হয়ে নিকারাগুয়ায় (১৯০২-১৯১২ সাল), আমেরিকান চিনি কোম্পানির স্বার্থে ডোমিনিকান রিপাবলিকে (১৯১৬ সালে), আমেরিকান ফ্রুট (ফল) কোম্পানির স্বার্থে হন্ডুরাসে এবং স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল কোম্পানির স্বার্থে চীনে (১৯২৭ সালে) সামরিক অভিযানে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এখনও একইভাবে বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হামলা চালাচ্ছে আমেরিকান বহুজাতিক কর্পোরেশনের স্বার্থে ও প্রয়োজনে।
এরকম দৃষ্টান্ত আরও অনেক দেয়া যেতে পারে। সংক্ষিপ্ত রচনায় তা সম্ভব হচ্ছে না। রচনা শেষ করার আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আরেকটি অন্দরমহলের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে চাই। গত ২৬ নভেম্বর আমার দেশ’র প্রথম পাতায় পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তিনিও অন্দরমহলের এক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। মার্কিন বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির সুবিধা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘বিগত চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে পাকে-চক্রে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে জেমস মরিয়ার্টির অন্তত দুই পূর্বসূরির কাছে একই বিষয় নিয়ে দেনদরবার করার অভিজ্ঞতা আমার ঝুলিতে রয়েছে।’ সে অভিজ্ঞতা ভালো নয়। প্রসঙ্গটি তিনি রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস এবং পেট্রিসিয়া বিউটিনেসের কাছে উত্থাপন করলে তারা সম্মত হননি। তিনি আরও লিখেছেন, ‘পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলি এবং সিনেটর ম্যাককেইনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তাদের কাছেও একই যুক্তি পেশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এবং সিনেটে বাংলাদেশী পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের যথাযথ আইন প্রণয়নের অনুরোধ করেছিলাম। বলাই বাহুল্য, এসব অনুরোধ কোনো কাজে আসেনি।’ আসবেও না। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আদায় করে নেবে তাদের ষোলআনা স্বার্থ। রাজনৈতিক চাপ দিয়েই হোক, তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল শাসকদের কিনে নিয়েই হোক অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমেই হোক, সাম্রাজ্যবাদ তার মুনাফা ও লাভটুকু পুরো মাত্রায় নিয়েই ছাড়বে।
এখনও তাই হতে চলেছে। বর্তমান সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস ক্ষেত্রই কেবল তুলে দিচ্ছে তাই-ই নয়। বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে টিফা চুক্তি করতে চলেছে তাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। যেসব বিষয়ে চুক্তি হবে, সেগুলো ডঞঙ-এর অধীনে বহুপাক্ষিক বিষয় হিসেবে গণ্য। তারপরও কেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে হবে? বিনিময়ে তারা কিন্তু কোনো বাণিজ্য সুবিধা আমাদের দেবে না। তবু আমাদের কেন এমন চুক্তি করতে হবে? আসলে কি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার জন্য আগেই এমন কোনো গোপন চুক্তি করে এসেছে যে এখন তাকে টিফা গিলতে হচ্ছে এবং সাগরের গ্যাস তুলে দিতে হচ্ছে? এমন সন্দেহ অমূলক নয়।
কোনোকিছুই দীর্ঘকাল চাপা থাকে না। সত্য প্রকাশিত হবেই। সরকার যদি তেমন কোনোকিছু করে থাকে, তবে তাও প্রকাশিত হবে এবং এজন্য তাদের খেসারত দিতে হবে। তবে তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, দেশ ও জাতিকে খেসারত দিতে হবে। সে হবে বড় দুর্ভাগ্যের কথা। তাই সময় থাকতে এখনই সরকারের এমন জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজকে প্রতিহত করতে হবে।
No comments