ফল-পাহাড়ের রক্তিম আমিলা by পলাশ বড়ুয়া

চাকমারা বলেন ‘আমিলা’, মগরা চেনেন ‘পুং’ ও ত্রিপুরারা ‘উতমুখরই’ নামে। আবার কেউ কেউ বলেন ‘হুগ্নিমুখুই’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একে বলা হয় ‘খড়গুলা’। সবগুলো শব্দের সরল বাংলা অর্থ ‘টক’। ফলটির স্বাদ তার এই নামের মধ্যেই প্রকাশিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষে ফলটির বাণিজ্যিক উৎপাদন হয়। পাহাড়ি আদিবাসীদের কাছে তো আমিলা খুবই জনপ্রিয়, সমতলের বাসিন্দাদের কাছেও আমিলার কদর কম নয়।


পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের প্রায় প্রত্যেকের ঘরের আঙিনা বা আশপাশে আমিলার গাছ দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমে বাণিজ্যিকভাবেও এর চাষ করা হয়। এ ছাড়া এখানে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিরাও ইদানীং তাঁদের বাড়িতে গাছটি রোপণ করেন। গাছটির কাণ্ড সরু ও লাল রঙের। গাঁটযুক্ত। প্রতি গাঁট থেকে খাঁজকাটা পাতা গজায় এবং এর সঙ্গে লাল টুকটুকে ফল ধরে। আমিলা ফলটি অন্যান্য মৌসুমি ফলের মতো খাওয়া হয় না। এটি ব্যবহূত হয় সবজি হিসেবে।
অন্যান্য সবজির সঙ্গে আমিলা মাছ-মাংস রান্না ও টক তৈরিতে ব্যবহূত হয়। অনেক সময় ফলের সঙ্গে এর পাতাও সবজি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। স্থানীয় বাজারগুলোতে আমিলার ফল ও পাতার চাহিদা বেশ। সারা বছরই বিক্রি হয়। পাতার দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি। ফলের দাম প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাজহারুল করিম জানান, ফলটির বৈজ্ঞানিক নাম Hibiscus Sabdariffa, ইংরেজি নাম Rozelle, পরিবার Malvace, বাংলা নাম হচ্ছে ‘চুকুর’। পাহাড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিকদের মতে, ফলটি পার্বত্যাঞ্চল ছাড়া দেশের অন্যত্র তেমন বিশেষ দেখা যায় না।
ভারত-প্রত্যাগত শরণার্থী নেতা লোচন দেওয়ান জানান, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরার শীলছড়ি ও গন্ধাছড়া এবং উত্তর ত্রিপুরার মনু ও সামনু এলাকায় আমিলার চাষ হয়। আমিলা ফলের খোলস ছাড়িয়ে সেগুলো টক ঝোল করা হয়। আর বীজটি শুকিয়ে পরে জুমে ও ঘরের আঙিনায় লাগানো হয়। খাগড়াছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মংগ্রী মগ ফলটি সম্পর্কে বলেন, ‘মগ ভাষায় আমরা এটিকে “পুং” বলি। এর অর্থ টক।’ রাঙামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান গরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, ‘এটিকে ত্রিপুরা ভাষায় বলে “উতমুখরই”, আবার অনেকে বলেন “হুগ্নিমুখুই”। সবগুলোর অর্থ হচ্ছে টক। এটি আমাদেরও প্রিয় খাবারের মধ্যে একটি।’ চট্টগ্রামের ভাষাভাষী সুনয়ন বড়ুয়া বলেন, ‘আদিবাসীদের পাশাপাশি আমাদের কাছেও আমিলা খুবই প্রিয়। এটিকে আমরা “খড়গুলা” বলি।’ স্থানীয় বাবুর্চি শাহ আলম বলেন, ‘গরুর পায়ার ঝোল রান্নায় আমিলার পাতা ব্যবহার করলে স্বাদটা অন্য রকম হয়। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও মেজবানে আমিলা দিয়ে গরুর পায়া ও মাংস রান্না করে থাকি। এ ছাড়া চিকেন স্যুপেও আমিলা ব্যবহার করা হয়।’ সারা বছরই কম-বেশি আমিলার ফলন হয়। তবে শীতের সময় ফলন হয় বেশি। পাহাড়ে এখন আমিলার গাছগুলো ভরে আছে রক্তিম ফলে ফলে।

No comments

Powered by Blogger.