ব্যাংকে পরিচালক পদ-বছরের পর বছর পরিচালক by মনজুর আহমেদ
বেসরকারি ব্যাংকের ৯৪ জন উদ্যোক্তা বছরের পর বছর পরিচালকের পদ দখল করে রেখেছেন। তাঁদের বড় অংশই বড় ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাব খাটিয়ে তাঁরা পরিচালক পদে রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ১৫কক ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি একাদিক্রমে দুই মেয়াদে ছয় বছরের বেশি কোনো ব্যাংকে পরিচালক থাকতে পারেন না।
অথচ দীর্ঘ ২৮ বছর ধরেও কেউ কেউ একই ব্যাংকের পরিচালক পদ দখল করে আছেন। মূলত আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিমত দেখিয়েই ব্যাংকের পরিচালকেরা বছরের পর বছর পরিচালক হয়ে আছেন। এ নিয়ে নতুন আইন করেও তা কার্যকর না করে চুপচাপ আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পাশের দেশ ভারতে ব্যাংকের পরিচালকের মেয়াদ আট বছর। পাকিস্তানে এই মেয়াদ একটানা ছয় বছর।
বেসরকারি ব্যাংক এসআইবিএলের এক শেয়ারহোল্ডারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ প্রাথমিক শুনানি শেষে গত সোমবার ১১ পরিচালকের দায়িত্ব পালনে তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেন।
আদালতের এই আদেশটি অবশ্য গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ স্থগিত করে দিয়েছেন। তবে বিষয়টি আদালতে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে পরিচালকদের মেয়াদ নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে।
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, আইন অনুসারে সবকিছু করা হবে। এর বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একটি ব্যাংকে পরিচালকের সংখ্যা সীমিত রাখা এবং দুই মেয়াদে সর্বোচ্চ ছয় বছর পরিচালক থাকার আইনি বিধানটি ব্যাংকের সুশাসনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে শৈথিল্য দেখাবে না।’
ছয় বছরের বেশি পরিচালক: ব্যাংক খাতের একটি সূত্র জানায়, ছয় বছরের বেশি সময় ধরে যে ৯৪ জন উদ্যোক্তা ব্যাংকে পরিচালক রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনই আছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। যেমন, বেসরকারি ইউসিবিএলের পরিচালক এম এ সবুর, হাজি ইউনুস আহমেদ ও এম এ কালাম—প্রত্যেকেই ২৮ বছর ধরে একনাগাড়ে ব্যাংকটির পরিচালক। একই ব্যাংকে ২৫ বছর ধরে পরিচালক হয়ে আছেন জাহাঙ্গীর আলম খান, ১৭ বছর সাব্বির আহমেদ, ১৬ বছর শওকত আজিজ ও কাজী এনামুল হক এবং রিয়াদ জাফর আহমেদ পরিচালক রয়েছেন ১৪ বছর।
যোগাযোগ করা হলে এম এ সবুর বলেন, এর আগে আদালতে এ নিয়ে মামলা হয়েছিল। সেই মামলার আদেশ সম্পর্কে তাঁদের আইনজীবীর দেওয়া ব্যাখ্যা অনুসারে তিনি অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকের মতো ইউসিবিএলের পরিচালক রয়েছেন।
পূবালী ব্যাংকে ২৬ বছর একনাগাড়ে পরিচালক রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ হাফিজ আহমেদ মজুমদার, হাবিবুর রহমান, মনিরুদ্দিন আহমেদ, শেখ ওহিদুর রহমান ও মনজুরুর রহমান। একই ব্যাংকে ২২ বছর ধরে আছেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, ১৯ বছর ধরে আছেন আহমেদ শফি চৌধুরী এবং ১৫ বছর ধরে আছেন ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী।
১৬ বছর ধরে পরিচালক রয়েছেন আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের বদিউর রহমান, হারুনুর রশীদ খান, নাজমুল হাসান, আবদুল মালেক মোল্লা, হাফেজ মো. এনায়েতুল্লাহ ও আবদুল মোক্তাদির।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার পরিচালক রয়েছেন ১২ বছর ধরে। একই সময় ধরে রয়েছেন ব্যাংকটির পরিচালক জুবায়ের কবীর, রিজওয়ানা কে রিজা ও অঞ্জন কুমার সাহা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ১২ বছর ধরে পরিচালক রয়েছেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, মো. হেদায়েতুল্লাহ, মোহাম্মদ আবদুর রউফ, আবদুল মালেক ও ইয়াসমিন হক। জহুর উল্লাহ ও অশোক দাসগুপ্ত ১২ বছর ধরে ওয়ান ব্যাংকের পরিচালক।
সাউথইস্ট ব্যাংকে ১৬ বছর ধরে পরিচালক আছেন সৈয়দ শহীদ আলী, ১৩ বছর ধরে জোসনা আরা কাশেম ও দুলুমা আহমেদ। দি সিটি ব্যাংকে ১৪ বছর ধরে পরিচালক আছেন রুবেল আজিজ।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ এইচ বি এম ইকবাল ১২ বছর ধরে প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক। বিগত তত্ত্ববধায়ক সরকারের সময় বিশেষ আদালত কর ফাঁকির মামলায় এইচ বি এম ইকবাল ও তাঁর কন্যা নওরিন ইকবালকে দোষী সাব্যস্ত করলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁদের ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলে যাওয়ার পর তাঁরা হাইকোর্টে আবেদন করলে বিশেষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ পান। এই স্থগিতাদেশ নিয়েই তিনি আবার ব্যাংকটির পরিচালক। প্রিমিয়ার ব্যাংকে ১২ বছর ধরে আরও পরিচালক রয়েছেন—বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, শফিকুর রহমান, ইয়ে চ্যাং মিন ও শায়লা শেলী খান। নওরিন ইকবালও ১২ বছর ধরে পরিচালক।
এসআইবিএলে ১৬ বছর ধরে পরিচালক রয়েছেন আনিসুল হক, মোহাম্মদ আযম, রেজাউল হক, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আওয়াল পাটোয়ারী, নাসিরউদ্দিন ও শেখ মোহাম্মদ রাব্বান আলী এবং ১২ বছর ধরে পরিচালক রয়েছেন সায়েদুর রহমান ও নুর-এ-আলম চৌধুরী।
আইনি বিতর্ক: ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০০৩ সালে সংশোধনের আগে)-এর মূল আইনের ১৬ ধারায় ব্যাংকে কোনো ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে পরিচালক পদে ছয় বছরের বেশি সময় থাকতে পারবেন না বলে বিধান ছিল। উল্লেখ ছিল, ছয় বছর শেষ হওয়ার পর তিন বছর পর্যন্ত আর পরিচালক হওয়া যাবে না। ’৯৩ সালে ব্যাংকের উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত প্রভাব খাটিয়ে এই ধারাটি বিলুপ্ত করান।
নব্বইয়ের দশকের একেবারে শেষদিকে বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতে সংস্কার কার্যক্রম জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশে সে সময় ব্যাংক খাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ সৃষ্টিসহ নানা ধরনের অনিয়ম দেখা দেয়। ১৯৯৯ সালে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত ব্যাংক সংস্কার কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে পরিচালকের মেয়াদ ও সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়। এরপর খেলাপি ঋণসংক্রান্ত ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠিত হলে তারাও একই সুপারিশ করে। এরই আলোকে ২০০৩ সালে জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-তে সংশোধনী আনা হয়। এ সময় ১৫কক ধারা যুক্ত করে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি একাদিক্রমে দুই মেয়াদে ছয় বছরের বেশি পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না।
এর পরই পরিচালকেরা এর বিরুদ্ধে একজোট হন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন বলেছিল, যেদিন থেকে পরিচালক হয়েছেন, সেদিন থেকে এটা কার্যকর হবে। কিন্তু উদ্যোক্তা পরিচালকদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, আইন সংশোধনের দিন থেকে এটি কার্যকর হবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকের পরিচালকের সংখ্যা ১৩ জনে সীমিত করে আরেকটি নির্দেশনা জারি করে। এ দুটি বিষয় নিয়েই হাইকোর্টে মামলা করেন পরিচালকেরা। তাতে পরিচালকের সংখ্যার বিষয়ে উদ্যোক্তাদের পক্ষে রায় আসে এবং মেয়াদকাল ছয় বছরের পক্ষে আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদালত এ সময় মেয়াদকালের কার্যকারিতার বিষয়টি বিধি তৈরি করে সুস্পষ্ট করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশনা দেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিতের আদেশ দেন।
স্থগিতাদেশ থাকাকালেই ২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদকাল স্পষ্ট করাসহ ব্যাংকে পরিচালকের সংখ্যা ১৩ জনে নির্ধারণ করে আইন সংশোধনের প্রস্তাব করে। সংশোধনী প্রস্তাবটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ দিয়ে আইনে পরিণত করা হয়। কিন্তু, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই অধ্যাদেশটি আর জাতীয় সংসদে অনুমোদন করা হয়নি।
এ সুযোগে প্রথম মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালকের সংখ্যা বাড়ানো হয়। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আব্দুল জলিল। এরপর বেসরকারি অন্য ব্যাংকগুলোতেও পরিচালকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন প্রায় সবগুলো ব্যাংকের পরিচালকের সংখ্যাই অনেক বেশি।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে কয়েক দফা আইনটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর করা যায়নি। বর্তমান সরকারের আমলে এটা আর বাস্তবায়িত হবে না বলে জানা গেছে।
No comments