বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-কারা প্রশাসন : পতনের শুরুটা জানা, কিন্তু শেষটা? by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাষ্ট্রের অন্যতম সুরক্ষিত স্থান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মানবতা-সভ্যতা কাঁপানো যে মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছিল, তা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একদল বিপথগামী সেনা সদস্য ওই দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চার অগ্রনায়ক তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করেছিল।
স্বঘোষিত, আত্মস্বীকৃত খুনিদের পরবর্তী সময়ে কিভাবে পুরস্কৃত করা হলো, ইনডেমনিটি দেওয়া হলো, সে ইতিহাসও সচেতন মহলের অজানা নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ওই ইনডেমনিটি বাতিল করে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করলেও তা আজ পর্যন্ত চূড়ান্ত রূপ পায়নি। কোনো অপরাধ বা হত্যাকাণ্ড যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়, তখন এর সুদূরপ্রসারী পরিণাম কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, বাংলাদেশ হলো এরই দৃষ্টান্ত। কারা প্রশাসনের পতনের শুরুটা সেখান থেকেই। এরপর ক্রমেই কারা প্রশাসনে অনাচার, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের আস্ফালন যেভাবে বেড়ে চলে, তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ এত বড় অনাচার যেখানে দীর্ঘদিন থেকে যায় প্রতিকারহীন, সেখানে তো সব ঘটনাই নস্যি।
বিগত এক দশকে নেতিবাচক অর্থে কারা প্রশাসন অনেকবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। ১ ও ১৫ অক্টোবর ২০১১ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ভিন্ন দুটি প্রতিবেদনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৭টি কারাগারের যে বিবর্ণ চিত্র পুনর্বার চিত্রিত হয়েছে, তাতে সব কিছু ছাপিয়ে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, কারা প্রশাসন কি অভিভাবকহীন অথবা নিয়ন্ত্রণহীন? স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-অনাচারই কি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে? কিছুসংখ্যক ক্ষমতাবান কি সব কিছুর প্রতিই বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে কারা প্রশাসন চালাচ্ছেন আর নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন? রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি বিভাগের এমন নাজেহাল অবস্থার দায় কার ওপর বর্তায়? স্বাধীন বাংলাদেশে কারা প্রশাসন ও অধিদপ্তরের ইতিহাস একদিকে খুব মলিন, অন্যদিকে চরম উদ্বেগজনক। 'তারে আমি পারি না এড়াতে আমি চলি সেও চলে সাথে'_কবি জীবনানন্দ দাশের 'বোধ' কবিতায় যে অব্যক্ত ভাব মূর্ত হয়েছে, আমাদের কারা অধিদপ্তর ও প্রশাসন প্রসঙ্গেও সম্ভবত তা পুনর্ব্যক্ত করা চলে। নিকট-অতীতে সিলেট কারাগারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এরপর আইজি প্রিজনস যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা প্রশ্নবোধক। এসব বিষয় কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী কেউই জানেন না? এত স্পর্শকাতর একটি বিভাগ সম্পর্কে এত উদাসীনতা?
২১ অক্টোবর ২০১১ একটি দৈনিকে প্রকাশ, কারা মহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকে ২০ অক্টোবর দুপুরে দুটি তাজা ককটেল উদ্ধার করা হয়। হয়তো কাজটি দুষ্কৃতকারীদের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই চিত্রটি কি নিরাপত্তাব্যবস্থার গলদ নয়? একটু পেছনে ফিরে যাই। ২০০৫ সালের সম্ভবত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে র্যাব-পুলিশ-বিডিআরের যৌথ অভিযান চালানোর প্রয়োজন পড়েছিল। কারা অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চালানোর বিষয়টি কোনোভাবেই স্বাভাবিক ছিল না। কারা অভ্যন্তরে আর্জেস গ্রেনেড ঢুকে গিয়েছিল কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী ও সুউচ্চ দেয়াল ডিঙিয়ে! তারপর চারদলীয় জোট সরকারের তৎকালীন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বহু হৈচৈ করলেন এবং এমন ভাব প্রকাশ করলেন যে অপরাধীদের শনাক্ত তো করা হবেই, অপরাধের উৎসমূলও সন্ধান করে বিনাশ করা হবে। কিন্তু কতটা কী শেষ পর্যন্ত হয়েছিল, তাও সচেতন মহলের অজানা নয়। অভিযোগ আছে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা ওই সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন, তাঁরাই এ সরকারেরও কারো কারো আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন তাঁদের অপকৌশল অবলম্বন করে। তাঁদের মত, কর্মকর্তারা শুধু সময় সময় খোলস পাল্টান এবং এ অপধারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে গণমানুষের জন্য। যৌথ বাহিনীর ওই অভিযান নিষ্ফল হয়েছিল, কারণ অভিযানের খবরটি নাকি আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। সন্দেহ নেই, এর পেছনেও ছিল ওই সব ক্ষমতাবান ও স্বেচ্ছাচারীদেরই নানা রকম কেরামতি। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ এত ঘুণপোকার আক্রমণের পরও এখন পর্যন্ত কিভাবে এতটুকুই টিকে আছে, তা ভাবতে গেলে বিস্ময় লাগে। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সবচেয়ে সুরক্ষিত, প্রহরাবেষ্টিত এই 'লৌহকপাট'-এর ভেতরেও মাদকাসক্ত এবং সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যসহ সব ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড এতটা বেগবান হয় কিভাবে_এ প্রশ্নের জবাব অন্তহীন নয়। আমরা বিশ্বাস করি, কারা প্রশাসন কিংবা অধিদপ্তরে এখনো অনেক নীতিনিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। কিন্তু তাঁরা কোণঠাসা_এ রকম প্রতিবেদনও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা অনিয়ম-অনাচারের প্রতিবাদ জানালে ফল হয় উল্টো। তাঁদের হেনস্তা হতে হয় ক্ষমতাবানদের হাতে, বদলির খৰ নেমে আসে কিংবা অন্য কৌশলে চলে পীড়ন। আসছে কারাগারের জন্য পণ্য কেনার প্রসঙ্গ। এখানেও নানা রকম তুঘলকি কাণ্ড ঘটে_এমন সংবাদও পত্রপত্রিকায় বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি ক্রয়কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পিপিআর ২০০৩ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা লঙ্ঘিত হচ্ছে সংকোচহীনভাবে। এখনো এমন ধারা অব্যাহত_এ অভিযোগও আছে। অথচ ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা জোর গলায়ই বলেছেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। আর ক্রয়কৃত পণ্যদ্রব্যের মান নিয়ে তো অসংখ্য প্রশ্ন আছেই। এককথায় লুটপাটের মহোৎসব কারা প্রশাসন বা অধিদপ্তরে চলছে এবং এমন কর্মকাণ্ড নিশ্চয়ই 'ম্যানেজ'-এর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। ম্যানেজ ছাড়া এত দুষ্কর্ম চলতে পারেই বা কী করে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ম্যানেজ বড় বিষময় ফ্যাক্টর হয়ে যাচ্ছে এবং এর বিরূপ প্রভাব বহুমুখী।
সিলেট কারাগারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার এখতিয়ার কারা কর্তৃপক্ষের আছে কি না, তা কোনো বিতর্কের বিষয় নয়। কারণ মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯-এর ১২ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব স্থানে সাধারণ মানুষকে আটকে রাখা হয়, যেমন_কারাগার, সেসব স্থান জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পরিদর্শন করতে পারবে। সিলেট কারাগার পরিদর্শনের আগে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রাজশাহী, যশোর, গাইবান্ধা, জয়দেবপুরসহ কয়েকটি কারাগার পরিদর্শন করেন। কিন্তু সিলেট কারাগারের ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের বাধা এল কেন? এর পেছনের রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি এবং রহস্য উন্মোচিত হয় না বিধায়ই অনিয়ম, অনাচার, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনার ক্রমবিস্তার এ দেশে ঘটছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে কী হচ্ছে_এ প্রশ্ন না করে বরং উল্টো প্রশ্ন দাঁড় করানো যেতে পারে_কী হচ্ছে না? 'অপরাধীরা নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার', 'মাদক ব্যবসার জমজমাট কেন্দ্র', 'তারকা সন্ত্রাসীদের দাপটে সাধারণ বন্দিরা অসহায়', 'খাবার ও সেলকে ঘিরে রমরমা বাণিজ্য', 'কারা হাসপাতালকে ঘিরে হাতবদল হয় লাখ লাখ টাকা', 'দুর্নীতি আর মাদকে ছেয়ে গেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার' ইত্যাদি শিরোনামে বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোনো প্রতিকার হয়েছে কি? কারা অভ্যন্তরে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরাই কি শুধু দুর্নীতিগ্রস্ত? নাকি এর শিকড় অনেক গভীরে বিস্তৃত? এসব প্রশ্ন উপেক্ষার নয়। উত্থাপিত সব অভিযোগের তদন্তক্রমে অপকর্মের মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আশু প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বছরের পর বছর এমন উন্মত্ততা চলতেই থাকবে, কোনো প্রতিকার হবে না, সৎ আর নিষ্ঠাবান ব্যক্তিরা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে পারবেন না, তা তো হতে পারে না। কারা অধিদপ্তর ও প্রশাসনের দুর্নীতির শিকড় উৎপাটন করতে হলে সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে আগাছা পরিষ্কার করতেই হবে। জেলখানায় যাদের বন্দি করা হয়, তাদের সবাই যে অপরাধী, তা নয়। মামলার রায়ের অপেক্ষায় কারাবাস করতে হচ্ছে এমন হাজতি বা বন্দির সংখ্যাও অনেক। রাজনৈতিক নানা কারণেও সেখানে যেতে হয় অনেককে। কিন্তু দেশের কারাগারগুলোতে আইনি পদক্ষেপ ও মানবিক আচরণের বিষয়টি নৈরাশ্যজনক। কোনো কোনো কারা কর্মকর্তার অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা সীমাহীন পর্যায়ে পেঁৗছেছে। অথচ এর বিপরীতে দেওয়া হচ্ছে টোটকা দাওয়াই! কারা সংস্কারের মতো জরুরি বিষয়টি দিনের পর দিন পড়ে আছে ফাইলবন্দি হয়ে। কয়েদি, হাজতি বা তাদের আত্মীয়স্বজন ছাড়া বিশেষ কাউকে জেলখানাপাড়ায় যেতে হয় না বলে এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তেমন কিছু জানে না। দুর্মুখেরা বলেন, আইজি প্রিজনস কিংবা ডিআইজি যদি স্বেচ্ছাচারিতায় মত্ত থাকেন, তাহলে তাঁদের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো বিপথে যাবেনই।
'লৌহকপাট'। জরাসন্ধের 'লৌহকপাট' অনেকেই পড়েছেন। কিন্তু জরাসন্ধের জেল-জীবনের অভিজ্ঞতা ও চিত্র এ যুগে অনেক পাল্টে গেছে। বর্তমান বাংলাদেশে তো বটেই। এ যুগে অপরাধের ধরন-ধারণ এবং আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধ্যান-ধারণাও পাল্টেছে। বেড়েছে অপরাধীর সংখ্যা। বেড়েছে প্রতিহিংসা এবং নানা কারণে বন্দির সংখ্যাও। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই 'দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন'_এই মৌলনীতি অনুসৃত হয়ে আসছে। দুষ্টের দমনে প্রয়োজনে কারাগার শুধু আটক রাখার প্রতিষ্ঠান নয়, বরং কারাবাসকালে দুষ্টের নিয়ন্ত্রিত জীবনচর্চার চারিত্রিক সংশোধন করে তাদের সমাজে পুনর্বাসন করাও কারা প্রশাসনের মৌলিক দায়িত্ব। এ জন্যই কারাগারকে সম্ভবত বলা হয় সংশোধনাগার। কিন্তু বাংলাদেশের কারাগার? এ তো দেখা যাচ্ছে অনিয়ম, অনাচার আর স্বেচ্ছাচারীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে! এ থেকে পরিত্রাণ জরুরি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ দেশে কারা প্রশাসনের দায়িত্ববান ব্যক্তিদেরই গলদের অন্ত নেই। দেশের কারাব্যবস্থায় এখনো আধুনিকতার ছাপ তো পড়েইনি, বরং স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিবাজদের উন্মত্ততায় ভবিষ্যৎ ক্রমেই কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ছে। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে, কারাভ্যন্তরের বিষফোড়াগুলো কাটাছেঁড়া করে সুস্থ ও গতিশীল কারা প্রশাসন গড়ে তোলার অতি জরুরি কাজটি কি সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে সরকার সম্পন্ন করতে পারবে?
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
বিগত এক দশকে নেতিবাচক অর্থে কারা প্রশাসন অনেকবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। ১ ও ১৫ অক্টোবর ২০১১ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ভিন্ন দুটি প্রতিবেদনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৭টি কারাগারের যে বিবর্ণ চিত্র পুনর্বার চিত্রিত হয়েছে, তাতে সব কিছু ছাপিয়ে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, কারা প্রশাসন কি অভিভাবকহীন অথবা নিয়ন্ত্রণহীন? স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-অনাচারই কি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে? কিছুসংখ্যক ক্ষমতাবান কি সব কিছুর প্রতিই বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে কারা প্রশাসন চালাচ্ছেন আর নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন? রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি বিভাগের এমন নাজেহাল অবস্থার দায় কার ওপর বর্তায়? স্বাধীন বাংলাদেশে কারা প্রশাসন ও অধিদপ্তরের ইতিহাস একদিকে খুব মলিন, অন্যদিকে চরম উদ্বেগজনক। 'তারে আমি পারি না এড়াতে আমি চলি সেও চলে সাথে'_কবি জীবনানন্দ দাশের 'বোধ' কবিতায় যে অব্যক্ত ভাব মূর্ত হয়েছে, আমাদের কারা অধিদপ্তর ও প্রশাসন প্রসঙ্গেও সম্ভবত তা পুনর্ব্যক্ত করা চলে। নিকট-অতীতে সিলেট কারাগারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এরপর আইজি প্রিজনস যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা প্রশ্নবোধক। এসব বিষয় কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী কেউই জানেন না? এত স্পর্শকাতর একটি বিভাগ সম্পর্কে এত উদাসীনতা?
২১ অক্টোবর ২০১১ একটি দৈনিকে প্রকাশ, কারা মহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকে ২০ অক্টোবর দুপুরে দুটি তাজা ককটেল উদ্ধার করা হয়। হয়তো কাজটি দুষ্কৃতকারীদের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই চিত্রটি কি নিরাপত্তাব্যবস্থার গলদ নয়? একটু পেছনে ফিরে যাই। ২০০৫ সালের সম্ভবত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে র্যাব-পুলিশ-বিডিআরের যৌথ অভিযান চালানোর প্রয়োজন পড়েছিল। কারা অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চালানোর বিষয়টি কোনোভাবেই স্বাভাবিক ছিল না। কারা অভ্যন্তরে আর্জেস গ্রেনেড ঢুকে গিয়েছিল কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী ও সুউচ্চ দেয়াল ডিঙিয়ে! তারপর চারদলীয় জোট সরকারের তৎকালীন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বহু হৈচৈ করলেন এবং এমন ভাব প্রকাশ করলেন যে অপরাধীদের শনাক্ত তো করা হবেই, অপরাধের উৎসমূলও সন্ধান করে বিনাশ করা হবে। কিন্তু কতটা কী শেষ পর্যন্ত হয়েছিল, তাও সচেতন মহলের অজানা নয়। অভিযোগ আছে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা ওই সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন, তাঁরাই এ সরকারেরও কারো কারো আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন তাঁদের অপকৌশল অবলম্বন করে। তাঁদের মত, কর্মকর্তারা শুধু সময় সময় খোলস পাল্টান এবং এ অপধারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে গণমানুষের জন্য। যৌথ বাহিনীর ওই অভিযান নিষ্ফল হয়েছিল, কারণ অভিযানের খবরটি নাকি আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। সন্দেহ নেই, এর পেছনেও ছিল ওই সব ক্ষমতাবান ও স্বেচ্ছাচারীদেরই নানা রকম কেরামতি। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ এত ঘুণপোকার আক্রমণের পরও এখন পর্যন্ত কিভাবে এতটুকুই টিকে আছে, তা ভাবতে গেলে বিস্ময় লাগে। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সবচেয়ে সুরক্ষিত, প্রহরাবেষ্টিত এই 'লৌহকপাট'-এর ভেতরেও মাদকাসক্ত এবং সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যসহ সব ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড এতটা বেগবান হয় কিভাবে_এ প্রশ্নের জবাব অন্তহীন নয়। আমরা বিশ্বাস করি, কারা প্রশাসন কিংবা অধিদপ্তরে এখনো অনেক নীতিনিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। কিন্তু তাঁরা কোণঠাসা_এ রকম প্রতিবেদনও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা অনিয়ম-অনাচারের প্রতিবাদ জানালে ফল হয় উল্টো। তাঁদের হেনস্তা হতে হয় ক্ষমতাবানদের হাতে, বদলির খৰ নেমে আসে কিংবা অন্য কৌশলে চলে পীড়ন। আসছে কারাগারের জন্য পণ্য কেনার প্রসঙ্গ। এখানেও নানা রকম তুঘলকি কাণ্ড ঘটে_এমন সংবাদও পত্রপত্রিকায় বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি ক্রয়কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পিপিআর ২০০৩ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা লঙ্ঘিত হচ্ছে সংকোচহীনভাবে। এখনো এমন ধারা অব্যাহত_এ অভিযোগও আছে। অথচ ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা জোর গলায়ই বলেছেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। আর ক্রয়কৃত পণ্যদ্রব্যের মান নিয়ে তো অসংখ্য প্রশ্ন আছেই। এককথায় লুটপাটের মহোৎসব কারা প্রশাসন বা অধিদপ্তরে চলছে এবং এমন কর্মকাণ্ড নিশ্চয়ই 'ম্যানেজ'-এর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। ম্যানেজ ছাড়া এত দুষ্কর্ম চলতে পারেই বা কী করে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ম্যানেজ বড় বিষময় ফ্যাক্টর হয়ে যাচ্ছে এবং এর বিরূপ প্রভাব বহুমুখী।
সিলেট কারাগারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার এখতিয়ার কারা কর্তৃপক্ষের আছে কি না, তা কোনো বিতর্কের বিষয় নয়। কারণ মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯-এর ১২ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব স্থানে সাধারণ মানুষকে আটকে রাখা হয়, যেমন_কারাগার, সেসব স্থান জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পরিদর্শন করতে পারবে। সিলেট কারাগার পরিদর্শনের আগে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রাজশাহী, যশোর, গাইবান্ধা, জয়দেবপুরসহ কয়েকটি কারাগার পরিদর্শন করেন। কিন্তু সিলেট কারাগারের ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের বাধা এল কেন? এর পেছনের রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি এবং রহস্য উন্মোচিত হয় না বিধায়ই অনিয়ম, অনাচার, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনার ক্রমবিস্তার এ দেশে ঘটছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে কী হচ্ছে_এ প্রশ্ন না করে বরং উল্টো প্রশ্ন দাঁড় করানো যেতে পারে_কী হচ্ছে না? 'অপরাধীরা নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার', 'মাদক ব্যবসার জমজমাট কেন্দ্র', 'তারকা সন্ত্রাসীদের দাপটে সাধারণ বন্দিরা অসহায়', 'খাবার ও সেলকে ঘিরে রমরমা বাণিজ্য', 'কারা হাসপাতালকে ঘিরে হাতবদল হয় লাখ লাখ টাকা', 'দুর্নীতি আর মাদকে ছেয়ে গেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার' ইত্যাদি শিরোনামে বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোনো প্রতিকার হয়েছে কি? কারা অভ্যন্তরে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরাই কি শুধু দুর্নীতিগ্রস্ত? নাকি এর শিকড় অনেক গভীরে বিস্তৃত? এসব প্রশ্ন উপেক্ষার নয়। উত্থাপিত সব অভিযোগের তদন্তক্রমে অপকর্মের মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আশু প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বছরের পর বছর এমন উন্মত্ততা চলতেই থাকবে, কোনো প্রতিকার হবে না, সৎ আর নিষ্ঠাবান ব্যক্তিরা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে পারবেন না, তা তো হতে পারে না। কারা অধিদপ্তর ও প্রশাসনের দুর্নীতির শিকড় উৎপাটন করতে হলে সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে আগাছা পরিষ্কার করতেই হবে। জেলখানায় যাদের বন্দি করা হয়, তাদের সবাই যে অপরাধী, তা নয়। মামলার রায়ের অপেক্ষায় কারাবাস করতে হচ্ছে এমন হাজতি বা বন্দির সংখ্যাও অনেক। রাজনৈতিক নানা কারণেও সেখানে যেতে হয় অনেককে। কিন্তু দেশের কারাগারগুলোতে আইনি পদক্ষেপ ও মানবিক আচরণের বিষয়টি নৈরাশ্যজনক। কোনো কোনো কারা কর্মকর্তার অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা সীমাহীন পর্যায়ে পেঁৗছেছে। অথচ এর বিপরীতে দেওয়া হচ্ছে টোটকা দাওয়াই! কারা সংস্কারের মতো জরুরি বিষয়টি দিনের পর দিন পড়ে আছে ফাইলবন্দি হয়ে। কয়েদি, হাজতি বা তাদের আত্মীয়স্বজন ছাড়া বিশেষ কাউকে জেলখানাপাড়ায় যেতে হয় না বলে এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তেমন কিছু জানে না। দুর্মুখেরা বলেন, আইজি প্রিজনস কিংবা ডিআইজি যদি স্বেচ্ছাচারিতায় মত্ত থাকেন, তাহলে তাঁদের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো বিপথে যাবেনই।
'লৌহকপাট'। জরাসন্ধের 'লৌহকপাট' অনেকেই পড়েছেন। কিন্তু জরাসন্ধের জেল-জীবনের অভিজ্ঞতা ও চিত্র এ যুগে অনেক পাল্টে গেছে। বর্তমান বাংলাদেশে তো বটেই। এ যুগে অপরাধের ধরন-ধারণ এবং আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধ্যান-ধারণাও পাল্টেছে। বেড়েছে অপরাধীর সংখ্যা। বেড়েছে প্রতিহিংসা এবং নানা কারণে বন্দির সংখ্যাও। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই 'দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন'_এই মৌলনীতি অনুসৃত হয়ে আসছে। দুষ্টের দমনে প্রয়োজনে কারাগার শুধু আটক রাখার প্রতিষ্ঠান নয়, বরং কারাবাসকালে দুষ্টের নিয়ন্ত্রিত জীবনচর্চার চারিত্রিক সংশোধন করে তাদের সমাজে পুনর্বাসন করাও কারা প্রশাসনের মৌলিক দায়িত্ব। এ জন্যই কারাগারকে সম্ভবত বলা হয় সংশোধনাগার। কিন্তু বাংলাদেশের কারাগার? এ তো দেখা যাচ্ছে অনিয়ম, অনাচার আর স্বেচ্ছাচারীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে! এ থেকে পরিত্রাণ জরুরি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ দেশে কারা প্রশাসনের দায়িত্ববান ব্যক্তিদেরই গলদের অন্ত নেই। দেশের কারাব্যবস্থায় এখনো আধুনিকতার ছাপ তো পড়েইনি, বরং স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিবাজদের উন্মত্ততায় ভবিষ্যৎ ক্রমেই কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ছে। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে, কারাভ্যন্তরের বিষফোড়াগুলো কাটাছেঁড়া করে সুস্থ ও গতিশীল কারা প্রশাসন গড়ে তোলার অতি জরুরি কাজটি কি সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে সরকার সম্পন্ন করতে পারবে?
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments