প্রতিক্রিয়া-টিপাইমুখ ড্যামের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিতর্ক by ম. ইনামুল হক
সমপ্রতি বাংলাদেশের প্রধান দুটি পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে লেখা নিবন্ধ প্রকাশের পর বাংলাদেশের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে তুমুল বিতর্ক জমে উঠেছে। আমার লেখাও প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এখন টিপাইমুখ ড্যামের পক্ষে অন্য প্রবন্ধকারীদের উত্থাপিত যুক্তিগুলোর ব্যাপারে কিছু লেখা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছি।
প্রথম আলো ২৯-১২-২০১১ সংখ্যায় মহিউদ্দিন আহমদ টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ করতে বাধা দেওয়া বাঙালির আত্মঘাতী প্রবণতা বলে উল্লেখ করেছেন। আমি বাঙালিকে আত্মঘাতী বলি না, বলি হঠকারী। বাঙালি হঠকারী জেনে ও না জেনে। বাঙালি দল বেঁধে আত্মহত্যা করে না, তবে ইদানীং সুযোগ পেলে এক বাঙালিকে অন্য বাঙালিরা দলবদ্ধভাবে ধাওয়া করে হত্যা করে। পক্ষের লোকেরাও করে, বিপক্ষের লোকেরাও করে। এমনই ঘটনা ঘটতে চলেছে টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে। এই ড্যাম নির্মাণের পক্ষের বাঙালিরা দলবদ্ধভাবে একটি বাস্তব পরিস্থিতিকে গায়ের জোরে আড়াল করছেন, এর বিপক্ষের বাঙালিরা দলবদ্ধভাবে অকারণ যুক্তির শোরগোল রটিয়ে বাস্তবতাকে গৌণ করে ফেলছেন। এর ফলে বিশেষজ্ঞদের কথার অর্থ সবাই ধরতে পারছে না।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদের ওপর নির্মিত ড্যামের নির্দিষ্ট পরিচালন-ব্যবস্থাপনা থাকে, যার ফলে ড্যামের উজান ও ভাটিতে ওই নদীর প্রবাহে ব্যাপক তারতম্য আসে। ড্যাম একটি নদীর ওপর আড়াআড়ি কংক্রিট বা মাটির বাঁধ, যা নদীর পানি আটকে রেখে উজানে পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ড্যামের উজান থেকে ভাটিতে পানির যে পতন সৃষ্টি হয়, তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। ড্যাম নির্মাণের পর উজানের আটকানো পানি কেবল দুটি পথে প্রবাহ করানো যায়, যথা, ১. একটি বা কয়েকটি সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে (পেনস্টক) ওই পানি টারবাইনের ওপর ফেলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়, ২. জলাধারের অতিরিক্ত পানি যাতে জমে ড্যামকে ছাপিয়ে না যায়, তাই একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার পর ওই পানি স্পিলওয়ের মাধ্যমে ভাটিতে গড়িয়ে দেওয়া হয়।
টিপাইমুখ ড্যামে জলাধার সৃষ্টির জন্য যে পানি প্রয়োজন, তা আসবে বর্ষা ও শরৎকালের বৃষ্টি থেকে। মণিপুর ও মিজোরাম রাজ্যে এর সংগ্রহ এলাকা ১২ হাজার বর্গ কিলোমিটার, বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাত এক হাজার ৫০০ মিলিমিটার। এই এলাকার গাছপালার বার্ষিক পানি শোষণ এক হাজার ২০০ মিলিমিটার। বলা হচ্ছে, জলাধারে ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি জমানো হবে। বরাক নদকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হলে বছরে মোট জল জমবে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ঘনমিটার। এভাবে জলাধার ভরতে চার থেকে পাঁচ বছর লাগবে। জলাধার পূর্ণ না করে আংশিক উৎপাদন করলে জলাধার পূর্ণ করতে ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যাবে।
টিপাইমুখ ড্যাম মাটির গভীর থেকে উঠে ১৬৭ মিটার উঁচু হবে। ধরা যাক, ড্যামের স্থায়ী আধারের উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ২০ মিটার উঁচুতে হবে, যার নিচে পানি নেমে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে না এবং ৫০ মিটার উঁচুর বেশি পানি বাড়লে স্পিলওয়ে দিয়ে জলপ্রপাতের মতো পানি গড়িয়ে যাবে। ড্যামটি ভরে গেলে আংশিক বা পুরো ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও বছরে মোট ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ঘনমিটার জল নেমে আসবে। এর পরিমাণ দাঁড়ায় গড়ে ১৪১০ কিউসেক। সারা বছর বিদ্যুৎ সম্ভব না হলেও বর্ষাকালে ১৪ হাজার ১০০ কিউসেক উচ্চ প্রবাহ ধরলে ওই সময় সর্বোচ্চ ২৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে।
(দেখুন http://new.wvic. com/index.php?option=com_content&task=view&id=8&Itemid=45)।
বাংলাদেশের কাপ্তাই ড্যামের প্রায় একই পরিমাণ জল সংগ্রহ এলাকা, কিন্তু দ্বিগুণ বৃষ্টিপাত (বছরে তিন হাজার মিমি), তাই জলসংগ্রহ দ্বিগুণ এবং প্লাবিত এলাকাও দ্বিগুণ (কাপ্তাই ৬৪ হাজার হেক্টর, টিপাইমুখ ৩১ হাজার হেক্টর)। কাপ্তাইয়ে বর্ষাকালে ২৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না, শীতে জলাধারের পানি নেমে গেলে উৎপাদন কমে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে টিপাইমুখে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন একটা গল্প। বাংলাদেশ ওই বিদ্যুতের একটা অংশ পেতে চাইলে কতটুকুই বা পেতে পারে? মণিপুরকে পাঁচ শতাংশ স্বার্থ দেওয়া হয়েছে, যা ১৫ মেগাওয়াটের বেশি হয় না। মণিপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী ড. আর কে রঞ্জন সিং আমাকে বলেছিলেন, ‘মাত্র ১০ থেকে ১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলে রাজ্যের ওপর একটি ধ্বংসাত্মক প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ বাংলাদেশের একদল হঠকারী রাজনীতিবিদ ও পরামর্শকেরাও এখান থেকে সামান্য বিদ্যুৎ পাওয়ার লোভে পড়েছেন।
টিপাইমুখ ড্যামের ফলে জলাধার এলাকার জনগণ উদ্বাস্তু হবে, পরিবেশের ক্ষতি হবে, এবং সেজন্য ওই এলাকার জনগণ আন্দোলন করছেন। আমরা মানবিক ও পরিবেশের কারণে অবশ্যই তাঁদের সঙ্গে আছি। আমরা বিরোধিতা করছি এ কারণে যে বর্ষার পানি আটকে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত জল ছাড়া হবে, যার ফলে সিলেট বিভাগের হাওর এলাকায় নদীগুলোতে অধিক উচ্চতায় পানি থাকবে (মহিউদ্দিন আহমদের দেওয়া সিডা স্টাডির তথ্যমতে, অমলশিদে ৩ দশমিক ৫ মিটার)। এর ফলে হাওর এলাকার এক ফসলি জমি জাগতে পারবে না। ২০০৪ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে সুনামগঞ্জের হাওরে ৭০০ কোটি টাকার বোরো ধান হতো। বাংলাদেশে এখন বছরে ১৮০ লাখ টন বোরো ধান হয়, যার ১০ শতাংশ বা ১৮ লাখ টন হাওরে হয়। এর মধ্যে পাঁচ লাখ টন ক্ষতি হলেও দুই হাজার কোটি টাকা হয়। আমার এক প্রবাসী বন্ধু লিখেছেন, এই ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন ডলারও হতে পারে (দি নিউ এজ, ২২.১২.২০১২)।
উজানে পাহাড়ি এলাকায় জলাধার নির্মাণ করে ভাটিতে নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি করা বা বন্যা হ্রাস করা অবশ্যই সম্ভব। তখন ড্যামটি কেবল বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য হতে হবে, যেখানে পেনস্টক বা স্পিলওয়ের মাধ্যমে নয়, পানি প্রয়োজনমতো রেগুলেটর দিয়ে ছাড়া হবে। ড্যাম বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হলে বর্ষা ও শরৎসহ হেমন্ত ও শীতে পানি ছাড়া হবে; আবার বসন্তের শেষ থেকেই জলাধারে পানি আটকে রাখা হবে, যাতে নদীর পানি কমে যাবে। তিস্তার বেলায় সিকিমে এই কাজ করা হচ্ছে, তাই তিস্তা নদে পানি নেই। তাই টিপাইমুখ ড্যাম এপ্রিল-মে মাসের আগাম বন্যা রোধ করে ওই পানি দিয়ে জলাধার পূর্ণ করবে। এই ড্যাম বর্ষার পানিও আটকে রাখবে, তাই নদীর স্বাভাবিক উচ্চ প্রবাহ কমে যাবে। কিন্তু বন্যার সময় পূর্ণ জলাধার থেকে পানি ছাড়তেই হবে বিধায় বর্ষার বন্যা ঠেকাতে পারবে না। এবার (জুন ও আগস্ট ২০১১) দামোদর ভ্যালিতে বর্ষার বন্যায় পাঞ্চেত, মাইথন, বরাকর ও তিলাইয়া ড্যাম ছাপিয়ে বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি ও বাঁকুড়ায় বন্যা হয়েছে। টিপাইমুখ ড্যাম শুকনো মৌসুমে হাওর এলাকার নদীগুলোতে বেশি পানি দেবে, যে কারনে আমাদের আপত্তি। বাংলাদেশের শুকনো মৌসুম কার্তিক মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত আট মাস। আমি বলি, অগ্রহায়ণ পৌষ, মাঘ, ফাল্গুনের পানি রংপুর বিভাগের নদীগুলোতে এলে আমরা অবশ্যই উপকৃত হতাম।
সিলেট বিভাগের অধিবাসীরা ইতিমধ্যে এক ফসলি বোরো ধানের অর্থনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তাই তারা টিপাইমুখ ড্যামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। টিপাইমুখ ড্যাম থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে পানি ছাড়া হলে হাওরও উপকৃত হবে। টিপাইমুখ ড্যামের পক্ষে সোচ্চার প্রকৌশলী ও পরামর্শকেরা প্রায়ই এই বিষয়ে ফ্যাপ-৬ সমীক্ষা এবং আইডব্লিউএমের মডেল স্টাডির কথা উল্লেখ করেন। উভয় সমীক্ষা ও স্টাডিতে শুকনো মৌসুমে পানি বাড়ার কথা বলা হয়েছে। নদীতে পানি বাড়লে নৌপথ ও সেচের জন্য ভালো হয়, কিন্তু হাওর এলাকায় শীতকালে পানি বৃদ্ধির অর্থ এলাকাটি ডুবে থাকা। হাওর এলাকায় যে বোরো ধান হয়, তা ভেজা মাটি ও অগভীর নলকূপ থেকে সেচ পায়, তাই নদীতে বেশি পানি এসে সেচের উপকার করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
সবশেষে বলছি, বাংলাদেশের মোট জলসম্পদের ১২ শতাংশের উৎস মেঘনা অববাহিকা। টিপাইমুখ এলাকা মেঘনা অববাহিকার ১/১২ অংশ মাত্র। টিপাইমুখের প্রভাব বাংলাদেশের মোহনা অঞ্চলে মাত্র এক শতাংশ। তাই মোহনা অঞ্চলের লবণাক্ততার ওপর এর কোনো প্রভাবই পড়বে না বলা যায়। টিপাইমুখ ড্যাম উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে বলাটাও অবান্তর। ভূমিকম্পের বিষয়টিও বড় নয়। কারণ, এর সম্ভাবনা ১০০ বছরে একবার মাত্র। টিপাইমুখ ড্যামবিরোধী হঠকারী রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞরা এই তিনটি ভয়ের কথা জোরেশোরে বলে প্রতিবছর এক হাজার থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ফসল ক্ষতির বিপদটি গৌণ করে দিচ্ছেন।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক: চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট।
minamul@gmail.com
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদের ওপর নির্মিত ড্যামের নির্দিষ্ট পরিচালন-ব্যবস্থাপনা থাকে, যার ফলে ড্যামের উজান ও ভাটিতে ওই নদীর প্রবাহে ব্যাপক তারতম্য আসে। ড্যাম একটি নদীর ওপর আড়াআড়ি কংক্রিট বা মাটির বাঁধ, যা নদীর পানি আটকে রেখে উজানে পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ড্যামের উজান থেকে ভাটিতে পানির যে পতন সৃষ্টি হয়, তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। ড্যাম নির্মাণের পর উজানের আটকানো পানি কেবল দুটি পথে প্রবাহ করানো যায়, যথা, ১. একটি বা কয়েকটি সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে (পেনস্টক) ওই পানি টারবাইনের ওপর ফেলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়, ২. জলাধারের অতিরিক্ত পানি যাতে জমে ড্যামকে ছাপিয়ে না যায়, তাই একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার পর ওই পানি স্পিলওয়ের মাধ্যমে ভাটিতে গড়িয়ে দেওয়া হয়।
টিপাইমুখ ড্যামে জলাধার সৃষ্টির জন্য যে পানি প্রয়োজন, তা আসবে বর্ষা ও শরৎকালের বৃষ্টি থেকে। মণিপুর ও মিজোরাম রাজ্যে এর সংগ্রহ এলাকা ১২ হাজার বর্গ কিলোমিটার, বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাত এক হাজার ৫০০ মিলিমিটার। এই এলাকার গাছপালার বার্ষিক পানি শোষণ এক হাজার ২০০ মিলিমিটার। বলা হচ্ছে, জলাধারে ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি জমানো হবে। বরাক নদকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হলে বছরে মোট জল জমবে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ঘনমিটার। এভাবে জলাধার ভরতে চার থেকে পাঁচ বছর লাগবে। জলাধার পূর্ণ না করে আংশিক উৎপাদন করলে জলাধার পূর্ণ করতে ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যাবে।
টিপাইমুখ ড্যাম মাটির গভীর থেকে উঠে ১৬৭ মিটার উঁচু হবে। ধরা যাক, ড্যামের স্থায়ী আধারের উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ২০ মিটার উঁচুতে হবে, যার নিচে পানি নেমে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে না এবং ৫০ মিটার উঁচুর বেশি পানি বাড়লে স্পিলওয়ে দিয়ে জলপ্রপাতের মতো পানি গড়িয়ে যাবে। ড্যামটি ভরে গেলে আংশিক বা পুরো ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও বছরে মোট ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ঘনমিটার জল নেমে আসবে। এর পরিমাণ দাঁড়ায় গড়ে ১৪১০ কিউসেক। সারা বছর বিদ্যুৎ সম্ভব না হলেও বর্ষাকালে ১৪ হাজার ১০০ কিউসেক উচ্চ প্রবাহ ধরলে ওই সময় সর্বোচ্চ ২৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে।
(দেখুন http://new.wvic. com/index.php?option=com_content&task=view&id=8&Itemid=45)।
বাংলাদেশের কাপ্তাই ড্যামের প্রায় একই পরিমাণ জল সংগ্রহ এলাকা, কিন্তু দ্বিগুণ বৃষ্টিপাত (বছরে তিন হাজার মিমি), তাই জলসংগ্রহ দ্বিগুণ এবং প্লাবিত এলাকাও দ্বিগুণ (কাপ্তাই ৬৪ হাজার হেক্টর, টিপাইমুখ ৩১ হাজার হেক্টর)। কাপ্তাইয়ে বর্ষাকালে ২৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না, শীতে জলাধারের পানি নেমে গেলে উৎপাদন কমে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে টিপাইমুখে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন একটা গল্প। বাংলাদেশ ওই বিদ্যুতের একটা অংশ পেতে চাইলে কতটুকুই বা পেতে পারে? মণিপুরকে পাঁচ শতাংশ স্বার্থ দেওয়া হয়েছে, যা ১৫ মেগাওয়াটের বেশি হয় না। মণিপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী ড. আর কে রঞ্জন সিং আমাকে বলেছিলেন, ‘মাত্র ১০ থেকে ১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলে রাজ্যের ওপর একটি ধ্বংসাত্মক প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ বাংলাদেশের একদল হঠকারী রাজনীতিবিদ ও পরামর্শকেরাও এখান থেকে সামান্য বিদ্যুৎ পাওয়ার লোভে পড়েছেন।
টিপাইমুখ ড্যামের ফলে জলাধার এলাকার জনগণ উদ্বাস্তু হবে, পরিবেশের ক্ষতি হবে, এবং সেজন্য ওই এলাকার জনগণ আন্দোলন করছেন। আমরা মানবিক ও পরিবেশের কারণে অবশ্যই তাঁদের সঙ্গে আছি। আমরা বিরোধিতা করছি এ কারণে যে বর্ষার পানি আটকে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত জল ছাড়া হবে, যার ফলে সিলেট বিভাগের হাওর এলাকায় নদীগুলোতে অধিক উচ্চতায় পানি থাকবে (মহিউদ্দিন আহমদের দেওয়া সিডা স্টাডির তথ্যমতে, অমলশিদে ৩ দশমিক ৫ মিটার)। এর ফলে হাওর এলাকার এক ফসলি জমি জাগতে পারবে না। ২০০৪ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে সুনামগঞ্জের হাওরে ৭০০ কোটি টাকার বোরো ধান হতো। বাংলাদেশে এখন বছরে ১৮০ লাখ টন বোরো ধান হয়, যার ১০ শতাংশ বা ১৮ লাখ টন হাওরে হয়। এর মধ্যে পাঁচ লাখ টন ক্ষতি হলেও দুই হাজার কোটি টাকা হয়। আমার এক প্রবাসী বন্ধু লিখেছেন, এই ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন ডলারও হতে পারে (দি নিউ এজ, ২২.১২.২০১২)।
উজানে পাহাড়ি এলাকায় জলাধার নির্মাণ করে ভাটিতে নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি করা বা বন্যা হ্রাস করা অবশ্যই সম্ভব। তখন ড্যামটি কেবল বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য হতে হবে, যেখানে পেনস্টক বা স্পিলওয়ের মাধ্যমে নয়, পানি প্রয়োজনমতো রেগুলেটর দিয়ে ছাড়া হবে। ড্যাম বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হলে বর্ষা ও শরৎসহ হেমন্ত ও শীতে পানি ছাড়া হবে; আবার বসন্তের শেষ থেকেই জলাধারে পানি আটকে রাখা হবে, যাতে নদীর পানি কমে যাবে। তিস্তার বেলায় সিকিমে এই কাজ করা হচ্ছে, তাই তিস্তা নদে পানি নেই। তাই টিপাইমুখ ড্যাম এপ্রিল-মে মাসের আগাম বন্যা রোধ করে ওই পানি দিয়ে জলাধার পূর্ণ করবে। এই ড্যাম বর্ষার পানিও আটকে রাখবে, তাই নদীর স্বাভাবিক উচ্চ প্রবাহ কমে যাবে। কিন্তু বন্যার সময় পূর্ণ জলাধার থেকে পানি ছাড়তেই হবে বিধায় বর্ষার বন্যা ঠেকাতে পারবে না। এবার (জুন ও আগস্ট ২০১১) দামোদর ভ্যালিতে বর্ষার বন্যায় পাঞ্চেত, মাইথন, বরাকর ও তিলাইয়া ড্যাম ছাপিয়ে বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি ও বাঁকুড়ায় বন্যা হয়েছে। টিপাইমুখ ড্যাম শুকনো মৌসুমে হাওর এলাকার নদীগুলোতে বেশি পানি দেবে, যে কারনে আমাদের আপত্তি। বাংলাদেশের শুকনো মৌসুম কার্তিক মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত আট মাস। আমি বলি, অগ্রহায়ণ পৌষ, মাঘ, ফাল্গুনের পানি রংপুর বিভাগের নদীগুলোতে এলে আমরা অবশ্যই উপকৃত হতাম।
সিলেট বিভাগের অধিবাসীরা ইতিমধ্যে এক ফসলি বোরো ধানের অর্থনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তাই তারা টিপাইমুখ ড্যামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। টিপাইমুখ ড্যাম থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে পানি ছাড়া হলে হাওরও উপকৃত হবে। টিপাইমুখ ড্যামের পক্ষে সোচ্চার প্রকৌশলী ও পরামর্শকেরা প্রায়ই এই বিষয়ে ফ্যাপ-৬ সমীক্ষা এবং আইডব্লিউএমের মডেল স্টাডির কথা উল্লেখ করেন। উভয় সমীক্ষা ও স্টাডিতে শুকনো মৌসুমে পানি বাড়ার কথা বলা হয়েছে। নদীতে পানি বাড়লে নৌপথ ও সেচের জন্য ভালো হয়, কিন্তু হাওর এলাকায় শীতকালে পানি বৃদ্ধির অর্থ এলাকাটি ডুবে থাকা। হাওর এলাকায় যে বোরো ধান হয়, তা ভেজা মাটি ও অগভীর নলকূপ থেকে সেচ পায়, তাই নদীতে বেশি পানি এসে সেচের উপকার করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
সবশেষে বলছি, বাংলাদেশের মোট জলসম্পদের ১২ শতাংশের উৎস মেঘনা অববাহিকা। টিপাইমুখ এলাকা মেঘনা অববাহিকার ১/১২ অংশ মাত্র। টিপাইমুখের প্রভাব বাংলাদেশের মোহনা অঞ্চলে মাত্র এক শতাংশ। তাই মোহনা অঞ্চলের লবণাক্ততার ওপর এর কোনো প্রভাবই পড়বে না বলা যায়। টিপাইমুখ ড্যাম উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে বলাটাও অবান্তর। ভূমিকম্পের বিষয়টিও বড় নয়। কারণ, এর সম্ভাবনা ১০০ বছরে একবার মাত্র। টিপাইমুখ ড্যামবিরোধী হঠকারী রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞরা এই তিনটি ভয়ের কথা জোরেশোরে বলে প্রতিবছর এক হাজার থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ফসল ক্ষতির বিপদটি গৌণ করে দিচ্ছেন।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক: চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট।
minamul@gmail.com
No comments