ফেনসিডিলের আদলে কোমল পানীয়ঃ আফিম থেকে এনার্জি ড্রিংক by মাসুদুল আলম তুষার
কোমল পানীয়র আড়ালে ভয়াবহ মাদকের বিস্তার ঘটছে সারা দেশে। জীবনী শক্তিবিনাশী এ মাদক শুধু সহজলভ্যই নয়, সস্তা দরে বিকোচ্ছে বিশেষ চক্র। ঠিকানাবিহীন কারখানায় চলছে অনুমোদনহীন 'এনার্জি ড্রিংক' উৎপাদন। নানা উদ্দীপক নামের এ পানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে।
চিকিৎসক ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, হট ফিলিংস, ট্রিপল এক্স, ফাস্ট ফিলিংস, পাওয়ার, এনার্জি, হর্স পাওয়ার, হর্স ফিলিংস, সুপার পাওয়ার, ফাস্ট হর্স, ম্যান পাওয়ারসহ নানা নামের 'এনার্জি ড্রিংক' শরীরে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। আফিম থেকে উদ্ভূত উপাদানের মিশ্রণে তৈরি পানীয়গুলো দীর্ঘ মেয়াদে গ্রহণে স্নায়বিক দুর্বলতার পাশাপাশি চূড়ান্ত স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা রয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মুদি দোকান, জেনারেল স্টোরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত অন্যান্য পানীয়র সঙ্গে থরে থরে সাজানো কথিত এসব এনার্জি ড্রিংকস। বিএসটিআইয়ের অনুমোদনবিহীন এসব পানীয় বাজারজাতকরণে কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই বলে বোতলে সাঁটা লেবেলেই ঘোষণা থাকছে। মহাখালী ও আদাবর এলাকার দুজন বিক্রেতা জানালেন, বয়সে তরুণরাই এনার্জি ড্রিংকসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। প্রচার ছাড়াই এগুলো ভালো চলছে। দাম কম থাকায় নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীরাও এগুলো কিনছে। কারো অনুমোদন না থাকায় ব্যবসায়ীরা এগুলো বিভিন্ন সময়ে একটু আড়ালে রেখেই বিক্রি করেন বলে জানান। মাত্র ৪৫ টাকা মূল্যের এনার্জি ড্রিংকস সেবনের পর শরীরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সাময়িক এ উত্তেজনার জন্যই পানীয়গুলো দেদার বিক্রি হচ্ছে বলে বিক্রেতাদের মত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি না থাকায় অলিগলিসহ অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে এ মাদক সেবন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের উপপরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন, এনার্জি ড্রিংকের নামে বাজারে প্রচলিত এ জাতীয় পানীয় বিক্রি বন্ধ করার জন্য নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। তার পরও লোকবলের অভাবে উৎপাদকদের সমূলে নির্মূল করা যাচ্ছে না। অনেককে গ্রেপ্তার করা হলেও আইনের ফাঁক গলে তারা বেরিয়ে আসছে। বাজারে প্রচলিত বেশ কয়েকটি এনার্জি ড্রিংকে নেশার ভয়ংকর উপকরণ পাওয়া গেছে, যা তরুণ প্রজন্মকে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কথিত এনার্জি ড্রিংকে 'অপিয়েটস' এবং 'সিলডেনাফিল সাইট্রেট' রয়েছে, যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় ভয়ংকর মাদকের উপাদান হিসেবে চিহ্নিত।
র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা এ প্রসঙ্গে বলেন, অনেক এনার্জি ড্রিংক নিষিদ্ধ নেশার উপকরণ হিসেবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে জেনে গত এক বছরে বড় ধরনের বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। কারখানা সিলগালা করে দেওয়ার পাশাপাশি মালিককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কঠোর নজরদারির পরও এরা চোখ ফাঁকি দিয়ে বাজারে মাদক ছড়াচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান দিয়ে তৈরি এসব কোমল পানীয় কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের মাদক কারখানা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে র্যাবের অনুসন্ধান ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এনার্জি ড্রিংকের নামে বাজারজাত করা পানীয়গুলোতে যে 'অপিয়েটস' মিলছে, তা আফিম থেকে উদ্ভূত। অপিয়েটস হেরোইন, নেশার ইনজেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ংকর মাদকের মতোই ক্ষতিকর। আরেক উপাদান 'সিলডেনাফিল সাইট্রেট' যৌন উত্তেজক হিসেবে কাজ করে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে তাদের ব্র্যান্ডের এনার্জি ড্রিংকে আকৃষ্ট করতেই ভয়ংকর মাদকের উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। বাজার তৈরি করতেই প্রথম পর্যায়ে কম দামে তা বিক্রি করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০-এর ১৯/৩ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কারো কাছে আফিম ও আফিম উদ্ভূত পণ্য পাওয়া যায় এবং তা যদি দুই কেজির বেশি হয় তবে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আইনের এত কঠোর বিধান থাকার পরও একটি অসাধু চক্র এনার্জি ড্রিংকের নামে আফিম মেশানো পণ্য উৎপাদন করছে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, মাদকের এ অভিনব ব্যবসার বিস্তার ঘটেছে মূলত গত বছরের গোড়ার দিকে। বিশেষ চক্র দেশের বিভিন্ন স্থানে কারখানা খুলে কথিত এনার্জি ড্রিংক উৎপাদনের পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জে বাজারজাত করেছে। পরে তা রাজধানীতে ঢুকে পড়লে কিছুটা নজরদারিতে পড়ে যায়। পাবনার আফুরিয়ায় কারখানা বসিয়ে উৎপাদন করা 'ফাস্ট ফিলিংস' নামের এনার্জি ড্রিংক কর্তৃপক্ষ গত বছর বিএসটিআই রাজশাহীর আঞ্চলিক অফিসে আবেদন করেছিল অনুমোদনের জন্য। মান উত্তীর্ণ না হওয়ায় তাদের লাইসেন্স মেলেনি। তার পরও অব্যাহত এ পানীয়ের উৎপাদন।
বিসিক শিল্পনগরী চাঁদপুর থেকে এশিয়া অ্যাগ্রো ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন 'হর্স ফিলিংস' নামের এনার্জি ড্রিংক উৎপাদন করে। এর লেবেলে সায়েন্স ল্যাবরেটরি কর্তৃক পরীক্ষিত বলা হয়েছে। এতে উপাদান হিসেবে রেড মাশরুম, স্যাফন, প্রসেসড ন্যাচারাল মিঙ্ ফ্রুট নির্যাস, সুগার, লিকুইড গ্লুকোজ, ভিটামিন ই, পারমিটেড ফুড কালারের ব্যবহার করা হয়েছে বলে বোতলের লেবেলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য সব এনার্জি ড্রিংকেও একই ধরনের লেখা দেখা গেছে। সেখানে অ্যালকোহল ও কার্বোনেটের ব্যবহার নেই বলে বোতলে লেখা থাকছে। একই সঙ্গে উৎপাদনকারীরা লিখে দিচ্ছে 'বিএসটিআইয়ের আওতামুক্ত পানীয়', 'ইহা ওষুধ নয়, সম্পূরক খাদ্য মাত্র' এবং 'শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য'। লেবেলের গায়ে ব্যাচ নং, মেয়াদকাল ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ কিছুই নেই। কেবল আছে খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা, যদিও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চাঁদপুর বিসিক শিল্পনগরীর মাহবুব পাটোয়ারীর মালিকানাধীন অ্যাগ্রো ফুড নামের কম্পানি দীর্ঘদিন ধরে 'হর্স ফিলিংস' ও 'জিন্টার' নামের এনার্জি ড্রিংক তৈরি ও বাজারজাত করছিল। গত বছর ২ জুলাই ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের টিম সেখানে অভিযান চালিয়ে সিলগালা করে দেয়। জব্দ করা হয় প্রায় ২০ হাজার বোতল পানীয়। ঢাকার মহাখালীতেও একই সময়ে অভিযান চালানো হয়। কারখানার মূল মালিক শাহেদ হোসেন পাটওয়ারী, তাঁর ছোট ভাই মাহবুব পাটওয়ারী ও কারখানার ম্যানেজার ইমরান হোসেনকে আটক করে ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩ (খ) ধারায় পুথক দুটি মামলা হয়। এর আগে ২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর চাঁদপুর মডেল থানার পুলিশ তিন দফা অভিযান চালিয়ে পুরান বাজারে এশিয়া ফুড অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজে অবৈধভাবে তৈরি যৌন উত্তেজক সিরাপ 'হর্স পাওয়ার' ও 'হর্স ফিলিংস' জব্দ করেছিল। সে সময় এশিয়া ফুড অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক হাকিম এন এম শাহদাত হোসেন পাটওয়ারীকে আটক করা হয়েছিল। এভাবে দফায় দফায় অভিযানে শাস্তির মুখোমুখি হলেও বিশেষ চক্র ছাড়ছে না অবৈধ মাদক কারবার।
রাজধানীর পুরানা পল্টন, পল্লবী, আদাবর, ডেমরা, কেরানীগঞ্জ, বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মির্জাপুর নতুনপাড়া, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরসহ বিভিন্ন স্থানে কোমল পানীয়র আরো কারখানার সন্ধান পেয়েছে র্যাব। এসব স্থানে অভিযানের পর কিছু পানীয় উদ্ধার হলেও পরে দেখা গেছে, একই নামে অন্য স্থান থেকে উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে তা। মূলত প্রত্যন্ত এলাকায় উৎপাদনের পর শহরসংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া নিয়ে বোতলজাত করা হচ্ছে এ ধরনের পানীয়। পরে তা বিশেষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
No comments