স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি-যুদ্ধাপরাধ ও আমাদের বিচিত্র ইতিহাস by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দীর্ঘ ৪০ বছর পরে হলেও আমরা যে জাতি হিসেবে ১৯৭১ সালের ঘাতকদের বিচারের ব্যবস্থা করতে পেরেছি, এতে এক ধরনের সন্তুষ্টিও রয়েছে আমাদের মনে। শুধু ভাবতে অবাক লাগে, যেসব ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল এ দেশের মানুষকেই হত্যা করেছে এবং হত্যা করতে সাহায্য করেছে, তারা আশ্চর্যজনকভাবে আবার এ দেশেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
যেই গোলাম আযম ১৯৭২ সালের পর পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষদগার করে ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেই গোলাম আযমই আবার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে এই দেশে রাজনীতির কলকাঠি নেড়েছেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এ দেশের প্রতি তাঁর কখনো আনুগত্য ও ভালোবাসা হয়নি। তাঁর আত্মজীবনী থেকেই তাঁর মনমানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।
গোলাম আযমের মতো মানুষেরা কী করে এ দেশে আবার রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছেন, সে বিষয়টির ব্যাপারে আমরা সবাই অবগত আছি। এই কিছুদিন আগে যখন বেগম খালেদা জিয়া দাবি করে বসলেন যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হোক, তখন আমাদের সেই পুরোনো ব্যথা-বেদনাকেই তিনি আবার জাগিয়ে দিলেন। তাঁরই স্বামী জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি এত গর্বিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং যিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা কী জঘন্যভাবে বাঙালি হত্যা করেছে, সেই তিনিই আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে ওই পাকিস্তানি দোসরদের সহায়তায় দেশ পরিচালনার চেষ্টা করলেন। তাঁর মন্ত্রী ছিলেন আবদুল আলীম, যাঁর বিরুদ্ধে সেই ১৯৭১ সাল থেকে আমরা গুরুতর অভিযোগের কথা শুনে এসেছি। জিয়া যখন দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছিলেন, তখন শাহ আজিজুর রহমান জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলে যাচ্ছিলেন। অথচ এমন একজন মনেপ্রাণে পাকিস্তানিকেই জিয়া তাঁর সরকারে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আর যেই নিজামী ও মুজাহিদকে আমরা নিজ চোখে এই ঢাকা শহরে দেখেছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে রাজাকারদের মহড়া পরিচালনা করছেন, তাঁরাই আবার খালেদা জিয়ার সরকারের মন্ত্রীরূপে আবির্ভূত হন।
আমরা বাঙালিরা আমাদের ইতিহাস নিয়ে গর্ববোধ করি এবং সেটা যথার্থই করি। তার পরেও অনেক কথা থেকে যায়। আমি, আপনি, আমরা যারা সেই ভয়াবহ নভেম্বর ১৯৭৫-এর দৃশ্যগুলো দেখেছি—অবাক হয়েছি, যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জওয়ানদের মুখে সেই পাকিস্তানি কায়দায় স্লোগান তুলতে। খালেদ মোশাররফের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে এল তারা। জিয়াকে মুক্ত করে আনল এবং রাজপথে ট্যাংক নিয়ে নামল, অনেক বাঙালি আবার করতালির মধ্যদিয়ে এই খুনিদের স্বাগত জানাল এবং সেটা করল বলেই কয়েক বছর পরে মাওলানা মান্নানের মতো কুখ্যাত এক রাজাকার জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারের মন্ত্রী হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি একা নন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো মানুষও ওই সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। আর আমরা বাঙালিরা এসব দৃশ্য দেখেছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বেমালুম ভুলে গিয়ে এই পরিস্থিতি মেনে নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের চার বিশিষ্ট জাতীয় নেতাকে কারাগারে হত্যা করা হলো এবং সেই জঘন্য অপরাধের সুষ্ঠু বিচার আজ পর্যন্ত হলো না। ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত একে একে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক বাহিনীর অফিসারদের হত্যা করা হয়। সেই বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত, কোনো বিচার হলো না।
সেই পুরোনো কথাটা মনে পড়ে যায়—বড় বিচিত্র এই দেশ! বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় সৈয়দ নাজিমদ্দিন হাশিম তাঁর রোজনামচা ‘বন্দিশালা পাকিস্তান’ প্রকাশ করেছিলেন। সেই গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে এমন সব বাঙালি ভদ্রলোকের কথা, যাঁরা সবাই পাকিস্তান সরকারের চাকরি করতেন। কিন্তু ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পর পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক ছিলেন। হাশিম সাহেব কারও নাম উল্লেখ করেননি, তবে বলে দিয়েছেন যে এসব বাঙালি কী পরিমাণে বাংলাদেশকে ঘৃণা করতেন, কী ভাষায় বলতেন যে পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়াটাকে তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। সবাই বাঙালি এবং বন্দী, কিন্তু এর পরও পাকিস্তানপ্রীতি তাঁদের যায়নি। আমি হাশিম ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তিনি এঁদের নাম প্রকাশ করেননি। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এঁরা সবাই জীবিত এবং যেই স্বাধীন বাংলাদেশকে তাঁরা পাকিস্তানের বন্দিশালায় এত ছোট নজরে দেখেছেন, সেই বাংলাদেশেই তাঁরা সরকারের উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এ কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, ১৯৭৩-এর জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের বিষয়টি। সে সময় আলজিয়ারসে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো একেবারে পুলকিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিলিত হন এবং তাঁর কাছে জানতে চান, বাংলাদেশের প্রশাসন ও নিরাপত্তা কীভাবে তিনি পরিচালনা করছেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে নাকি বলেছিলেন, পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের কথা। কিউবার নেতা কিছুটা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন, ওই কর্মকর্তাদের বিষয়ে কি কোনো যাচাই-বাছাই করা হয়েছিল কি না। যখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ওরা তো আমারই বাঙালি এবং বাংলাদেশের জন্যই কাজ করছেন; তখন ফিদেল কাস্ত্রো নাকি উত্তরে বলেছিলেন, এটা ঠিক হয়নি এবং এই ভুলের কারণেই আপনি বিপদে পড়বেন। আপনাকে শেষ করে দেবে ওরা। ওই কথার দুবছর পরই বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। আজ একটু ভেবে দেখুন। যুদ্ধের পর যেসব সামরিক অফিসার বিভিন্ন সময়ে নিহত হয়েছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সবাই বহাল তবিয়তে রয়ে গেলেন।
এই কথাগুলো আমরা কেউ সচরাচর বলি না, কিন্তু বলা দরকার। সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কারণেই আজ আমাদের এই দুর্গতি। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে মিথ্যা রটিয়েছেন। তিনি এ দেশে ফিরেই মারা গেলেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরে যেসব বাঙালি একাত্তরের পরও কর্মরত ছিলেন এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তাঁরা আবার এ দেশে ফিরে আমাদের পররাষ্ট্রসচিব ও রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। একজন বাঙালি ১৯৭৭ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হয়ে কাজ করেছেন। অথচ সেই ব্যক্তিই বাংলাদেশে ফিরে এসে জেনারেল এরশাদের আমলে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন। কেন হয়েছিলেন, কীভাবে হয়েছিলেন, সে বিষয়ে কোনো দিন কোনো প্রশ্ন আমরা করিনি। এক ধরনের অনীহা আমাদের মধ্যে এসে গেছে। জিয়াউর রহমান পাঁচ বছর আমাদের ইতিহাসকে কুয়াশায় ঢেকে রেখেছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই একই কাজ করেছেন। বেগম জিয়াও খুব একটা পরিবর্তন আনেননি বরং তিনি তাঁর সরকারে যুদ্ধাপরাধীদের একেবারে উচ্চস্থান দিয়েছেন।
অদ্ভুত আমাদের ইতিহাস! বঙ্গবন্ধুকে আমরা হত্যা করেছি। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছি। খুনিদের বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময়ে সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে। রাজাকারদের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখেছি।
আর যেসব মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন দেশে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের কথা আমরা কজনই বা স্মরণ করে থাকি? সেদিন কি আসবে, যেদিন সরকার, আমাদের সেনাবাহিনী, আমরা সবাই খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর মতো যেসব বীর বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদেরকে সরকারিভাবে, আনুষ্ঠানিকভাবে আবার উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হবে?
হতে পারে। হবেও। কিন্তু এসবই নির্ভর করছে আমরা কত দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করতে পারি।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
গোলাম আযমের মতো মানুষেরা কী করে এ দেশে আবার রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছেন, সে বিষয়টির ব্যাপারে আমরা সবাই অবগত আছি। এই কিছুদিন আগে যখন বেগম খালেদা জিয়া দাবি করে বসলেন যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হোক, তখন আমাদের সেই পুরোনো ব্যথা-বেদনাকেই তিনি আবার জাগিয়ে দিলেন। তাঁরই স্বামী জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি এত গর্বিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং যিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা কী জঘন্যভাবে বাঙালি হত্যা করেছে, সেই তিনিই আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে ওই পাকিস্তানি দোসরদের সহায়তায় দেশ পরিচালনার চেষ্টা করলেন। তাঁর মন্ত্রী ছিলেন আবদুল আলীম, যাঁর বিরুদ্ধে সেই ১৯৭১ সাল থেকে আমরা গুরুতর অভিযোগের কথা শুনে এসেছি। জিয়া যখন দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছিলেন, তখন শাহ আজিজুর রহমান জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলে যাচ্ছিলেন। অথচ এমন একজন মনেপ্রাণে পাকিস্তানিকেই জিয়া তাঁর সরকারে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আর যেই নিজামী ও মুজাহিদকে আমরা নিজ চোখে এই ঢাকা শহরে দেখেছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে রাজাকারদের মহড়া পরিচালনা করছেন, তাঁরাই আবার খালেদা জিয়ার সরকারের মন্ত্রীরূপে আবির্ভূত হন।
আমরা বাঙালিরা আমাদের ইতিহাস নিয়ে গর্ববোধ করি এবং সেটা যথার্থই করি। তার পরেও অনেক কথা থেকে যায়। আমি, আপনি, আমরা যারা সেই ভয়াবহ নভেম্বর ১৯৭৫-এর দৃশ্যগুলো দেখেছি—অবাক হয়েছি, যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জওয়ানদের মুখে সেই পাকিস্তানি কায়দায় স্লোগান তুলতে। খালেদ মোশাররফের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে এল তারা। জিয়াকে মুক্ত করে আনল এবং রাজপথে ট্যাংক নিয়ে নামল, অনেক বাঙালি আবার করতালির মধ্যদিয়ে এই খুনিদের স্বাগত জানাল এবং সেটা করল বলেই কয়েক বছর পরে মাওলানা মান্নানের মতো কুখ্যাত এক রাজাকার জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারের মন্ত্রী হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি একা নন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো মানুষও ওই সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। আর আমরা বাঙালিরা এসব দৃশ্য দেখেছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বেমালুম ভুলে গিয়ে এই পরিস্থিতি মেনে নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের চার বিশিষ্ট জাতীয় নেতাকে কারাগারে হত্যা করা হলো এবং সেই জঘন্য অপরাধের সুষ্ঠু বিচার আজ পর্যন্ত হলো না। ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত একে একে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক বাহিনীর অফিসারদের হত্যা করা হয়। সেই বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত, কোনো বিচার হলো না।
সেই পুরোনো কথাটা মনে পড়ে যায়—বড় বিচিত্র এই দেশ! বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় সৈয়দ নাজিমদ্দিন হাশিম তাঁর রোজনামচা ‘বন্দিশালা পাকিস্তান’ প্রকাশ করেছিলেন। সেই গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে এমন সব বাঙালি ভদ্রলোকের কথা, যাঁরা সবাই পাকিস্তান সরকারের চাকরি করতেন। কিন্তু ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পর পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক ছিলেন। হাশিম সাহেব কারও নাম উল্লেখ করেননি, তবে বলে দিয়েছেন যে এসব বাঙালি কী পরিমাণে বাংলাদেশকে ঘৃণা করতেন, কী ভাষায় বলতেন যে পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়াটাকে তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। সবাই বাঙালি এবং বন্দী, কিন্তু এর পরও পাকিস্তানপ্রীতি তাঁদের যায়নি। আমি হাশিম ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তিনি এঁদের নাম প্রকাশ করেননি। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এঁরা সবাই জীবিত এবং যেই স্বাধীন বাংলাদেশকে তাঁরা পাকিস্তানের বন্দিশালায় এত ছোট নজরে দেখেছেন, সেই বাংলাদেশেই তাঁরা সরকারের উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এ কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, ১৯৭৩-এর জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের বিষয়টি। সে সময় আলজিয়ারসে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো একেবারে পুলকিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিলিত হন এবং তাঁর কাছে জানতে চান, বাংলাদেশের প্রশাসন ও নিরাপত্তা কীভাবে তিনি পরিচালনা করছেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে নাকি বলেছিলেন, পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের কথা। কিউবার নেতা কিছুটা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন, ওই কর্মকর্তাদের বিষয়ে কি কোনো যাচাই-বাছাই করা হয়েছিল কি না। যখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ওরা তো আমারই বাঙালি এবং বাংলাদেশের জন্যই কাজ করছেন; তখন ফিদেল কাস্ত্রো নাকি উত্তরে বলেছিলেন, এটা ঠিক হয়নি এবং এই ভুলের কারণেই আপনি বিপদে পড়বেন। আপনাকে শেষ করে দেবে ওরা। ওই কথার দুবছর পরই বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। আজ একটু ভেবে দেখুন। যুদ্ধের পর যেসব সামরিক অফিসার বিভিন্ন সময়ে নিহত হয়েছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সবাই বহাল তবিয়তে রয়ে গেলেন।
এই কথাগুলো আমরা কেউ সচরাচর বলি না, কিন্তু বলা দরকার। সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কারণেই আজ আমাদের এই দুর্গতি। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে মিথ্যা রটিয়েছেন। তিনি এ দেশে ফিরেই মারা গেলেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরে যেসব বাঙালি একাত্তরের পরও কর্মরত ছিলেন এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তাঁরা আবার এ দেশে ফিরে আমাদের পররাষ্ট্রসচিব ও রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। একজন বাঙালি ১৯৭৭ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হয়ে কাজ করেছেন। অথচ সেই ব্যক্তিই বাংলাদেশে ফিরে এসে জেনারেল এরশাদের আমলে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন। কেন হয়েছিলেন, কীভাবে হয়েছিলেন, সে বিষয়ে কোনো দিন কোনো প্রশ্ন আমরা করিনি। এক ধরনের অনীহা আমাদের মধ্যে এসে গেছে। জিয়াউর রহমান পাঁচ বছর আমাদের ইতিহাসকে কুয়াশায় ঢেকে রেখেছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই একই কাজ করেছেন। বেগম জিয়াও খুব একটা পরিবর্তন আনেননি বরং তিনি তাঁর সরকারে যুদ্ধাপরাধীদের একেবারে উচ্চস্থান দিয়েছেন।
অদ্ভুত আমাদের ইতিহাস! বঙ্গবন্ধুকে আমরা হত্যা করেছি। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছি। খুনিদের বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময়ে সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে। রাজাকারদের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখেছি।
আর যেসব মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন দেশে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের কথা আমরা কজনই বা স্মরণ করে থাকি? সেদিন কি আসবে, যেদিন সরকার, আমাদের সেনাবাহিনী, আমরা সবাই খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর মতো যেসব বীর বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদেরকে সরকারিভাবে, আনুষ্ঠানিকভাবে আবার উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হবে?
হতে পারে। হবেও। কিন্তু এসবই নির্ভর করছে আমরা কত দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করতে পারি।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments