কৃষি-প্রযুক্তির আধুনিকায়ন by আসাদউল্লাহ খান
দেশে কৃষিপণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাজারজাতের বিষয়টি অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে এখনো পর্যন্ত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এবং বিদ্যুৎ, সেচ, সার ও কীটনাশকের ঘাটতি, শস্য উৎপাদনে উপযুক্ত পরিকল্পনা, উৎপাদনব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে না বলে জনসংখ্যার নিরিখে খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন হচ্ছে না। ইতিমধ্যে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে।
অন্যদিকে নদীভাঙন, বন্যা, শিল্পায়ন, আবাসন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদি বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষি জমির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। শুধু যে জমির পরিমাণ কমে গেছে তা নয়, বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে খরা, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়, ফসলহানি ঘটে থাকে। বিভিন্ন কারণে খাদ্যঘাটতি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। নিতান্ত দুঃখজনক, বাংলাদেশে বিগত দিনের সরকার কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন গুটিয়ে নেওয়ার পর কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি তথা খাদ্য উৎপাদন জনসংখ্যার নিরিখে এগিয়ে যাচ্ছে কি না এরূপ কোনো জরিপ করেনি। একদিকে আবাদযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি বছর দেশের জনসংখ্যা ২০ লাখ করে বাড়ছে। কিন্তু কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়াই লাগেনি। এভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই সংকটের মুখোমুখি হবে।
কৃষি উৎপাদনে গতিশীলতা সৃষ্টি ও কৃষিপণ্য বাজারজাতের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো কৃষি উন্নয়নের দিকে নজর না দেওয়ায় আমাদের দেশ আজ খাদ্যঘাটতির মতো অবস্থার মুখোমুখি। গ্রাম ও শহরের মধ্যে উপার্জনের বিশাল ফারাক আছে এবং এই বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর অন্যতম কারণ, আমাদের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব কমেছে। ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া-২০০৩’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে ১৯৯৬-২০০০ সালে জাতীয় উৎপাদনের মোট ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ এসেছে কৃষি খাত থেকে। কিন্তু ওই সময় শ্রমিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা ছিল ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ ১৯৮০-৮৫ সালে জাতীয় আয়ের ৪২ দশমিক ২ শতাংশ এসেছে কৃষি থেকে এবং সে সময় কৃষিতে শ্রমিক বিনিয়োগ ছিল ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থনীতিতে গ্রামের গুরুত্ব কমেছে, কিন্তু গ্রামনির্ভর মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বাজারভিত্তিক যে উদার অর্থনীতির ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি, তাতে আমাদের তাবৎ মনোযোগ শহর ও শহুরে মানুষদের ঘিরে। গ্রামে উৎপাদনের চাকা ঘুরছে না, তাই কর্মসংস্থানের সুযোগও নেই। গ্রামীণ মানুষের শিক্ষার সুযোগ ও মান বাড়ানোর চেষ্টা নেই, গ্রামে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সীমিত এবং আরও দুঃখজনক, গ্রামীণ কুটিরশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এগুলোর বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
প্রতিবেশী ভারতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামকে ঘিরে যে সমৃদ্ধি ঘটেছে, তাতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে ইন্ডিয়ান টোব্যাকো কোম্পানি (আইটিসি)। ২০০০ সালে আইটিসির কৃষি ব্যবসায়ের প্রধান নির্বাহী শিবকুমার মধ্য প্রদেশের সয়া চাষিদের ভাগ্যোন্নয়ন এবং সঙ্গে সঙ্গে আইটিসিকে ভিন্ন আরেকটি লাভজনক ব্যবসায়ে যুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি আইটিসির চেয়ারম্যান যোগেশ চন্দর দেবেশ্বরের কাছে ৫০ লাখ রুপি মঞ্জুরি চাইলেন। দেবেশ্বর তাঁকে ১০ কোটি রুপি দিলেন। শিবকুমার ই-চৌপল নামে একটি সংগঠন তৈরি করে কাজে নেমে পড়লেন। ই-চৌপল হচ্ছে গ্রামের বয়স্ক এবং জ্ঞানবৃদ্ধদের একটি সংগঠন, যেখানে গ্রাম উন্নয়নভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচিত হয়। আইটিসি প্রথমে কৃষকদের সংখ্যার ভিত্তিতে গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট সংযোগসহ কম্পিউটার বসিয়ে দেয়। নির্বাচিত গ্রামগুলোতে কম্পিউটার চালানোর জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ থেকে এবং ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে ভি-সাট (V-SAT) থেকে। আইটিসির পক্ষ থেকে সপ্তাহ খানেকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় একজন সামান্য লেখাপড়া জানা কৃষক এই কম্পিউটার অপারেটর বা সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন শুধু কৃষকদের কৃষিবিষয়ক তথ্য-উপাত্তভিত্তিক পাঁচ ধরনের সেবা প্রদানের জন্য। যথা এক. তথ্য: দৈনিক আবহাওয়া বার্তা, বিভিন্ন কৃষিপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি, আইটিসি কর্মকর্তা ও চাষিদের উদ্দেশে পাঠানো ই-মেইল এবং দেশ-বিদেশের খবর। এসব তাদের সরবরাহ করা হবে বিনা খরচায়, স্থানীয় ভাষায়। দুই. জ্ঞান: প্রতিটি অঞ্চলের প্রত্যেক ফসলের জন্য চাষ-পদ্ধতির ব্যাপারে প্রশিক্ষণ, মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে কৃষকদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করা। কৃষকেরা কোনো অর্থ ব্যয় না করেই এ সাহায্য ও পরামর্শ পাবে। তিন. কেনাকাটা: কৃষকেরা ই-চৌপলের মাধ্যমে বীজ, সার এবং কীটনাশক ছাড়াও বাইসাইকেল, ট্রাক্টর এমনকি শস্যবিমা পর্যন্ত কিনতে পারবে। চার. বিপনন: ইন্টারনেটে দর যাচাই করে কৃষকেরা তাদের উৎপাদনসামগ্রী ই-চৌপল কিংবা বাজারে বিক্রি করতে পারে। পাঁচ. উন্নয়ন কর্মসূচি: ই-চৌপলের উদ্যোগে ও সহায়তায় গো প্রজনন উন্নয়ন, কৃষিকাজে সেচের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও মহিলাদের জন্য আত্মকর্মসংস্থানের পথ খুঁজে বের করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভিন্ন এনজিও কাজ করছে।
ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে ই-চৌপলের ইন্টারনেটের মাধ্যমে কৃষকেরা গ্রামে বসেই অনলাইনে তাদের জমির রেকর্ড যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছেন। গ্রামের কৃষকেরা গরিব। কোনো কৃষকেরই খবরের কাগজ কিনে পড়ার সামর্থ্য নেই। এখন তাঁরা অনলাইনে খবরের কাগজ পড়ছেন, দিনভর খাটুনির পর সন্ধ্যায় কাজ শেষে বিনোদনের সুযোগ পাচ্ছেন। সুস্থ বিনোদনমূলক ছবি ছাড়াও অত্যাধুনিক কৃষি-পদ্ধতির ওপর সিনেমা দেখছেন। প্রকল্প এলাকায় কৃষি উৎপাদন তিন গুণ বেড়ে গেছে। কৃষকেরা যাতে উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পান, সে জন্য ই-চৌপল ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনে নেয়। আইটিসির এই উদ্যোগের সাফল্য অভাবিত। আইটিসির এই উদ্যোগ দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ইকোনমিস্ট, হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল এবং জাতিসংঘের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে।
আসাদ উল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।
aukhandk@gmail.com
No comments