গঙ্গা পানিচুক্তির ১৫ বছরপূর্তি আজঃ বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যা পায়নি পদ্মা মরা খালে পরিণত by ইলিয়াস খান
আজ ১২ ডিসেম্বর। ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি চুক্তির ১৫ বছর পূর্তি। ১৯৯৬ সালের এ দিনে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেব গৌড়া এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ নিজ দেশের পক্ষে ৩০ বছর মেয়াদি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। পানি চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো বছরেই বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। ফলে পদ্মা নদী বেষ্টিত ৬টি জেলায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
প্রমত্তা পদ্মা এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় সম্পাদিত পাঁচবছর মেয়াদি গঙ্গা পানি চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ ও মধ্যস্থতার সুযোগ থাকলেও ৯৬-এর কালো চুক্তিতে এর কোনোটিই নেই। ফলে চুক্তির পর থেকেই বাংলাদেশ পানি বঞ্চিত হলেও আন্তর্জাতিক ফোরামে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ পাচ্ছে না। দিল্লির প্রতি নতজানু বর্তমান সরকার ফারাক্কার পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলেও ‘জাতির আগামীকে বন্ধক দিয়ে’ নতুন করে ভারতে করিডোর প্রদান করেছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাপক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। এদিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবের পর ভারত এবার বাংলাদেশের অদূরে মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করছে। এ বাঁধ নির্মিত হলে বৃহত্তর সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নয়াদিল্লি এ বিষয়ে ঢাকার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। বরং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও মসিউর রহমান সম্প্রতি নয়া দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে এসে ঢাকায় বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হবে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন; কিন্তু পদ্মা নদীবেষ্টিত ৬টি জেলার অন্তত ২ কোটি মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, পানাসি প্রকল্প, বরেন্দ্র প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের হাজার হাজার একর জমিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পাম্প ব্যবহার করেও সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন; কিন্তু পদ্মা নদীবেষ্টিত ৬টি জেলার অন্তত ২ কোটি মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, পানাসি প্রকল্প, বরেন্দ্র প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের হাজার হাজার একর জমিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পাম্প ব্যবহার করেও সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পাবনা থেকে স্টাফ রিপোর্টার জহুরুল ইসলাম জানান, পদ্মার অবস্থা খুবই করুণ। পানি নেই। এমনকি ন্যূনতম পানির প্রবাহ নেই। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১৫টি পিলারের মধ্যে ১১টি শুকনো চরে দাঁড়িয়ে আছে। যে ৪টি পিলার পানিতে রয়েছে তার আশপাশে মানুষ চাষাবাদ করছে। ফারাক্কার প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের ৫৪টি নদী শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। গঙ্গা পানি চুক্তি প্রসঙ্গে সাবেক সচিব আসাফ্উদ্দৌলাহ্ আমার দেশ- কে বলেন, ‘এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে ভারতের কাছে দাসখত দেয়া হয়েছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কী আমার জানা নেই। আমি হতাশ।’ আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির মহাসচিব সৈয়দ টিপু সুলতান বলেন, ‘কোনো বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে এ ধরনের চুক্তি হতে পারে না। তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নয়াদিল্লি এই অসম, অস্বচ্ছ চুক্তি করতে সফল হয়েছে। বাংলাদেশের বঞ্চনার বিষয়টি জাতিসংঘের সিক্সথ কমিটিতে তুলতে হবে।’
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী জামানুর রহমান বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এত নিচে নেমে গেছে যে, ১০ বছর পর এ অঞ্চলে পানি পাওয়া কঠিন হবে।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কবিবুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর নদীগুলোর ভূগর্ভস্থ উচ্চতা বেড়েছে এবং পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তিনি আরও বলেন, পানি চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো বছরেও বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
ভেড়ামারা পাম্প স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, পানি না পাওয়ায় এরই মধ্যে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ পাম্প বন্ধ হয়েছিল। পদ্মার পশ্চিমপাড় ভেড়ামারাসহ আশপাশ এলাকার আবহাওয়া ও পরিবেশ আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে। মরুভূমির মতো দিনের বেলায় প্রচণ্ড গরম আর রাতে কনকনে শীত অনুভূত হচ্ছে।
গঙ্গা পানি চুক্তির ফলে সরাসরি যেসব ক্ষতি হচ্ছে :
১. সেচের পানির অভাবে কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশের কৃষি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। কোনো বড় সেচ প্রকল্প নেয়া বা এ ধরনের প্রকল্পে বিদেশি সাহায্য পাওয়া কঠিন হচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্প নামে খ্যাত গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জি-কে) প্রজেক্টের সম্প্রসারণই শুধু বন্ধ হয়নি, যতটুকু চালু রয়েছে পানির অভাবে তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
২. দুর্বল নদী প্রবাহের ফলে নদীতে বেশি পলি জমা হচ্ছে এবং নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ফারাক্কার সংযোগ খালের মাধ্যমে হুগলি নদীতে পলিমুক্ত পানি সরবরাহ করা হয়।
৩. পানির স্বল্পতা ও নদীর তলদেশের উচ্চতার কারণে নদীর নাব্য মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
৪. নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় তার ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে বর্ষাকালে বন্যার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫. পানির অভাবে নদী অববাহিকার মাটির উর্বরতা কমে গেছে।
৬. নিম্ন গঙ্গা অববাহিকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, যা অনেকাংশে নদীতে প্রাপ্ত বা প্রবাহিত পানির পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল, অনেক নিচে নেমে গেছে। এর ফলে শুকনো মৌসুমে সেচের জন্য অনেক সাধারণ নলকূপ ক্ষেত্র বিশেষে গভীর নলকূপও অকেজো হয়ে পড়েছে।
৭. নদীর দুর্বল পানি প্রবাহ নদী ও সাগরের সঙ্গমস্থলে সাগরের পানিকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ায় নোনা পানি অনেক ভেতরে প্রবেশ করতে সমর্থ হচ্ছে যা দক্ষিণের বনাঞ্চলের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, বিখ্যাত সুন্দরবনের অনেক অংশ এরই মধ্যে এ কারণে নষ্ট হয়ে গেছে।
৮. নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়া, পানি কমে যাওয়া, পানিতে পলির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি নদী ও তার পানির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থা বিনষ্ট হওয়ায়, মিঠা পানির মাছের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে গেছে।
৯. শুকনো মৌসুমে পানীয় জলের অভাব প্রকটতর হয়েছে।
১০. নিম্ম গঙ্গা অববাহিকার বৃক্ষরাজি, প্রাণিজগত এবং সাধারণভাবে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
১১. কৃত্রিমভাবে নদী প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ায় অববাহিকার পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে যা বিভিন্নভাবে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করছে।
উল্লেখ্য, নিম্ম গঙ্গা অববাহিকার জনজীবন ও সভ্যতা গঙ্গা নদীকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে। মানুষ, নদী ও প্রকৃতি এখানে একটি একক ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছে, যার একটি অন্তর্নিহিত ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ এ ঐক্যকে বিনষ্ট করেছে। গঙ্গা নদী ও তার পানির ওপর যুগ যুগ ধরে গঙ্গা অঞ্চলের মানুষের যে ঐতিহাসিক অধিকার সৃষ্টি হয়েছে তা নদীর উজানে ভারতের কার্যক্রম দ্বারা গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ : অন্য রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক নদীসহ রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের এমন যে কোনো ব্যবহারের নিষেধ সম্পর্কে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে। ১৯৭৩ সালে সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাব (টঘ উড়প.অ/৮৭৩০,১৯৭৩) অনুযায়ী, ‘কোনো রাষ্ট্র এমন কিছু করবে না যা তার এখতিয়ারের বাইরের কোনো অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।’ অনুরূপ একটি শর্ত জাতিসংঘের অর্থনৈতিক অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ক সনদেও যুক্ত করা হয়েছে (ধারা-৩০ UN. Doc.A/RES/3281/XXIX,1974)। ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সম্মেলন কতৃক গৃহীত মানব পরিবেশ সংক্রান্ত নীতিমালায়ও এ বিষয়টির ওপর জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, এক দেশের কার্যক্রম অন্য দেশের পরিবেশ বিপন্ন করতে পারবে না। (নীতি-২১)
উপরোল্লিখিত আন্তর্জাতিক আইনের বিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব আইন প্রতিনিয়ত ভঙ্গ করে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। যেমন ১. ভারত নদীর গতিপথ পরিবর্তন বা রুদ্ধ করার জন্য নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করছে। ২. ভারত ভাটির দেশে তার প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা অনুযায়ী তার কাজ করেছে। ৩. বাঁধ নির্মাণের পর ভারত শুকনো মৌসুমে একতরফাভাবে নদীর পানি অন্যদিকে প্রবাহিত করছে এবং তা ব্যবহার করছে। ৪. বর্তমানে দীর্ঘ মেয়াদি (৩০ বছর) চুক্তি সম্পাদিত হলেও ভারত নিজের ব্যবহারের জন্য পলিমুক্ত পানি সংযোগ খালে প্রবাহিত করে পলিযুক্ত পানি বাংলাদেশে ছেড়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চুক্তির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, যা মূলত ভারতের ওপর নির্ভরশীল, তা নিয়েও সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে, কারণ শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ অংশে এখনও চুক্তি অনুযায়ী পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী জামানুর রহমান বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এত নিচে নেমে গেছে যে, ১০ বছর পর এ অঞ্চলে পানি পাওয়া কঠিন হবে।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কবিবুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর নদীগুলোর ভূগর্ভস্থ উচ্চতা বেড়েছে এবং পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তিনি আরও বলেন, পানি চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো বছরেও বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
ভেড়ামারা পাম্প স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, পানি না পাওয়ায় এরই মধ্যে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ পাম্প বন্ধ হয়েছিল। পদ্মার পশ্চিমপাড় ভেড়ামারাসহ আশপাশ এলাকার আবহাওয়া ও পরিবেশ আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে। মরুভূমির মতো দিনের বেলায় প্রচণ্ড গরম আর রাতে কনকনে শীত অনুভূত হচ্ছে।
গঙ্গা পানি চুক্তির ফলে সরাসরি যেসব ক্ষতি হচ্ছে :
১. সেচের পানির অভাবে কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশের কৃষি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। কোনো বড় সেচ প্রকল্প নেয়া বা এ ধরনের প্রকল্পে বিদেশি সাহায্য পাওয়া কঠিন হচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্প নামে খ্যাত গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জি-কে) প্রজেক্টের সম্প্রসারণই শুধু বন্ধ হয়নি, যতটুকু চালু রয়েছে পানির অভাবে তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
২. দুর্বল নদী প্রবাহের ফলে নদীতে বেশি পলি জমা হচ্ছে এবং নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ফারাক্কার সংযোগ খালের মাধ্যমে হুগলি নদীতে পলিমুক্ত পানি সরবরাহ করা হয়।
৩. পানির স্বল্পতা ও নদীর তলদেশের উচ্চতার কারণে নদীর নাব্য মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
৪. নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় তার ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে বর্ষাকালে বন্যার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫. পানির অভাবে নদী অববাহিকার মাটির উর্বরতা কমে গেছে।
৬. নিম্ন গঙ্গা অববাহিকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, যা অনেকাংশে নদীতে প্রাপ্ত বা প্রবাহিত পানির পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল, অনেক নিচে নেমে গেছে। এর ফলে শুকনো মৌসুমে সেচের জন্য অনেক সাধারণ নলকূপ ক্ষেত্র বিশেষে গভীর নলকূপও অকেজো হয়ে পড়েছে।
৭. নদীর দুর্বল পানি প্রবাহ নদী ও সাগরের সঙ্গমস্থলে সাগরের পানিকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ায় নোনা পানি অনেক ভেতরে প্রবেশ করতে সমর্থ হচ্ছে যা দক্ষিণের বনাঞ্চলের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, বিখ্যাত সুন্দরবনের অনেক অংশ এরই মধ্যে এ কারণে নষ্ট হয়ে গেছে।
৮. নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়া, পানি কমে যাওয়া, পানিতে পলির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি নদী ও তার পানির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থা বিনষ্ট হওয়ায়, মিঠা পানির মাছের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে গেছে।
৯. শুকনো মৌসুমে পানীয় জলের অভাব প্রকটতর হয়েছে।
১০. নিম্ম গঙ্গা অববাহিকার বৃক্ষরাজি, প্রাণিজগত এবং সাধারণভাবে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
১১. কৃত্রিমভাবে নদী প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ায় অববাহিকার পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে যা বিভিন্নভাবে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করছে।
উল্লেখ্য, নিম্ম গঙ্গা অববাহিকার জনজীবন ও সভ্যতা গঙ্গা নদীকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে। মানুষ, নদী ও প্রকৃতি এখানে একটি একক ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছে, যার একটি অন্তর্নিহিত ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ এ ঐক্যকে বিনষ্ট করেছে। গঙ্গা নদী ও তার পানির ওপর যুগ যুগ ধরে গঙ্গা অঞ্চলের মানুষের যে ঐতিহাসিক অধিকার সৃষ্টি হয়েছে তা নদীর উজানে ভারতের কার্যক্রম দ্বারা গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ : অন্য রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক নদীসহ রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের এমন যে কোনো ব্যবহারের নিষেধ সম্পর্কে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে। ১৯৭৩ সালে সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাব (টঘ উড়প.অ/৮৭৩০,১৯৭৩) অনুযায়ী, ‘কোনো রাষ্ট্র এমন কিছু করবে না যা তার এখতিয়ারের বাইরের কোনো অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।’ অনুরূপ একটি শর্ত জাতিসংঘের অর্থনৈতিক অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ক সনদেও যুক্ত করা হয়েছে (ধারা-৩০ UN. Doc.A/RES/3281/XXIX,1974)। ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সম্মেলন কতৃক গৃহীত মানব পরিবেশ সংক্রান্ত নীতিমালায়ও এ বিষয়টির ওপর জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, এক দেশের কার্যক্রম অন্য দেশের পরিবেশ বিপন্ন করতে পারবে না। (নীতি-২১)
উপরোল্লিখিত আন্তর্জাতিক আইনের বিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব আইন প্রতিনিয়ত ভঙ্গ করে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। যেমন ১. ভারত নদীর গতিপথ পরিবর্তন বা রুদ্ধ করার জন্য নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করছে। ২. ভারত ভাটির দেশে তার প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা অনুযায়ী তার কাজ করেছে। ৩. বাঁধ নির্মাণের পর ভারত শুকনো মৌসুমে একতরফাভাবে নদীর পানি অন্যদিকে প্রবাহিত করছে এবং তা ব্যবহার করছে। ৪. বর্তমানে দীর্ঘ মেয়াদি (৩০ বছর) চুক্তি সম্পাদিত হলেও ভারত নিজের ব্যবহারের জন্য পলিমুক্ত পানি সংযোগ খালে প্রবাহিত করে পলিযুক্ত পানি বাংলাদেশে ছেড়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চুক্তির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, যা মূলত ভারতের ওপর নির্ভরশীল, তা নিয়েও সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে, কারণ শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ অংশে এখনও চুক্তি অনুযায়ী পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
No comments