নিত্যজাতম্-দারা পুত্র পরিবার/তুমি কার কে তোমার! by মহসীন হাবিব
বিজয়ের মাস। বারবার ইচ্ছে হচ্ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে। মুক্তিযুদ্ধের তো অনেক দিক আছে, আছে অনেক তাৎপর্য। কোনটা নিয়ে লিখব? প্রথমেই মনে এল, কিভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেকটা ছিনতাই হয়ে গেছে, তা নিয়ে লেখা দরকার। আমরা বহুকাল ধরে যাঁদের পাকিস্তান প্রশাসনের অনুগত ছিলেন বলে জেনেছি, তাঁদের অনেকেই খোলস ছেড়ে পরবর্তীকালে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের শাসনামলে কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন;
কিভাবে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিগৃহীত জীবন যাপন করছেন বা করেছেন_তা নিয়ে লেখা দরকার। আবার মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার অধিকার এখনো জন্মেনি। দেশের অনেক বীরসন্তান এখনো সুস্থ-সবল অবস্থায় বেঁচে আছেন, যাঁরা প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে এখন আমাদের অনেক তথ্য-অভিজ্ঞতা জানার আছে। ভবিষ্যতে তাঁরা যখন থাকবেন না, তখনই অনেকটা সাহাবিদের মতো আমাদের অধিকার জন্মাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মন্তব্য লেখার। কিন্তু তার পরও সব কিছু উপেক্ষা করা যায় না। অন্তত যেসব অসংগতি বর্তমান সময়ে আমরা দেখি সেগুলো, আর যেসব নিয়ে কথা বলতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দরকার হয় না। যেমন_ছোট্ট একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, ইন্টারনেটে ফরিদপুর জেলা তথ্য বাতায়নে সাবেক জেলা প্রশাসকদের একটি নামের তালিকা দেওয়া আছে, এই তালিকায় ১৯০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১০৪ বছরের ইতিহাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ৭৯ জন জেলা প্রশাসকের নাম রয়েছে। কেউ ছয় মাস, কেউ তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা কে কবে দায়িত্ব নিয়েছেন এবং কে কবে রিলিজ হয়েছেন সে তারিখ বাতায়নে রয়েছে। শুধু ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ৯ মাস ফরিদপুর জেলার জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে কে ছিলেন, তার কোনো হদিস তথ্য বাতায়নে নেই। অথচ এ সময়টিই জেলা প্রশাসনের তথ্যের জন্য এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কাউকে না কাউকে এ দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনি কে? জেলা তথ্য বাতায়নে এ নিয়ে কোনো মন্তব্যও করা হয়নি।
১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই থেকে ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন এ এন এম ইউসুফ। ফরিদপুরের স্থানীয় প্রবীণ দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ এন এম ইউসুফ ছিলেন একজন গভীর দেশপ্রেমিক। তিনি তাঁর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে গেছেন। সরকারের দায়িত্বে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেছেন গোপনে। বাংলাদেশের অনেক দেশপ্রেমিক গর্বিত সন্তানই সরকারি দায়িত্বে থেকে এমন ভূমিকা পালন করেছিলেন। একসময় পাকিস্তানের মিলিটারি কর্তৃপক্ষ এ এন এম ইউসুফের বিষয়টি জেনে যায়। এ এন এম ইউসুফ তখন জেলা প্রশাসকের চাকরি ফেলে পালিয়ে যান মুক্তিযুদ্ধে। অসমর্থিত সূত্র বলছে, তিনি পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়েছিলেন। পাকিস্তান আর্মি তাঁকে কোনো একটি গোপন স্থান থেকে ধরে ফরিদপুর নিয়ে এসেছিল।
স্থানীয় জনগণ বলছে, এরপর এ এন এম ইউসুফের পরিবর্তে যাঁকে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি এসেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নোটিশ দেন যে উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে। তিনি 'দুষ্কৃতকারী'দের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জেলা শহরে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করেন। তিনিও ছিলেন বাঙালি। প্রকাশ্য দিবালোকে মুক্তিযুদ্ধের মাত্র ৪০ বছর পর জেলা প্রশাসনের বাতায়ন থেকে তাঁর নামটা মুছে গেল কী করে, সেটা জানতে চাই। এ জন্য বোধকরি মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি দেখার প্রয়োজন নেই। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলেছেন, এ সময় যিনি জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেক সুবিধা আদায় করেছেন!
আরো কিছু অসংগতি দেখতে মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার প্রয়োজন পড়ে না। ঢাকার সদ্য বিদায়ী মেয়র সাদেক হোসেন খোকা একজন সুপরিচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। সর্বশেষ হরতালের দিন পুলিশ যখন তাঁকে আটক করে, তখন (পরিষ্কার টেলিভিশনের ছবিতে দেখা গেল) পুলিশের কাঁধের ওপর দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ এক অল্পবয়সী সমর্থক সাদেক হোসেন খোকার মাথায় চপেটাঘাত করল। মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনা, দীর্ঘ ৯ বছর ঢাকা মহানগরের মন্ত্রীর মর্যাদায় থাকা মেয়র অসহায়ভাবে পেছন ফিরে দেখতে চেষ্টা করলেন, কে এমন কাজ করতে পারে। পারে! সেটা দেখা গেছে সাদেক হোসেন খোকাকে পুলিশ ভ্যানে তোলার সময়ও। এ অন্যায়, এ ধৃষ্টতা দেখতে বোধকরি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার প্রয়োজন পড়ে না।
সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে চরম অসৌজন্যমূলক আচরণের ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে কোনো দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি। এই চরম অপমানজনক সহিংস আচরণের জন্য সরকার কাউকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করেনি। এটা ঠিক, বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর অনেক ক্রিয়াকর্ম অমার্জনীয়। কিন্তু সরকারকেও মনে রাখতে হবে, সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে ওই মধ্যযুগীয় আচরণও অমার্জনীয়। খোকা শুধু বিএনপি নেতা নন। খোকা ঢাকা শহরের সফল নগরপিতা, খোকা বাংলাদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিনা উসকানিতে গায়ে হাত তুলে সরকারি দলের সমর্থকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হয়েও মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করেছে। সাদেক হোসেন খোকা বিএনপির নেতা হতে পারেন, আমরা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বলে মনে করি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে একদলে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে_এমন কোনো কথা নেই। এখন আওয়ামী লীগের কাছে প্রশ্ন করার সময় ঘনিয়ে এসেছে: আগে সমর্থক-দলীয় কর্মী, নাকি আগে মুক্তযুদ্ধ? কোনটা আওয়ামী নেতাদের কাছে বেশি পছন্দের?
একসময় চরম আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পরিবারে নানা অশান্তি এবং পারিপার্শি্বক পরিস্থিতি দেখে আমার উচ্চমানের শিক্ষায় শিক্ষিত পিতা হতাশ হয়ে তাঁর সিথানের কাছে দেয়ালে একটি কাগজে লিখে রেখেছিলেন, 'দারা পুত্র পরিবার/তুমি কার, কে তোমার!' আজ অনেক দিন পর সাদেক হোসেন খোকাকে অপদস্থ করতে সে কথাই বারবার মনে পড়ছে। কেউ কারো নয়। ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি মানুষ এখন জনপ্রতিনিধিহীন। মেয়র নেই, কাউন্সিলর নেই। হাজার হাজার মানুষ পড়েছে চরম সংকটে। নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ চালানোর কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত নির্বাহী কর্মকর্তারা কাজ শুরু করেননি। এত বড় মহানগরীর বেশ কতগুলো কার্যদিবস সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু সরকার সাদেক হোসেন খোকাকে সরিয়ে দিতে পারার আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে। কোনটা সরকারের কাছে বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে_জনগণের সেবা, নাকি খোকাকে সরিয়ে দেওয়া? এ প্রশ্ন করতে মুক্তিযুদ্ধ দেখার প্রয়োজন নেই।
আরো আছে। দেখে মনে হয়, বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, আছে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহারের প্রতিযোগিতা। বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত নিয়ে যে নোংরামি দেখা গেছে, তাতে শুধু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই অপমানিত হয়েছেন। যেখানে ভুয়া মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট জমা দিয়ে সব ধরনের অভিজ্ঞতা, জ্যৈষ্ঠতা ডিঙিয়ে একশ্রেণীর সরকারি কর্মচারী সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করেছে সরকারের কাছ থেকে, সেই সরকারের অধীনেই আবার মুক্তিযোদ্ধাদের রিকশা চালিয়ে, দিনমজুর খেটে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এটি কি সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গৃহীত নীতির ত্রুটি নয়?
শুধু বাংলাদেশের কেন, যেকোনো দেশের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ একটি পবিত্র বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা_এসব শব্দ কোনো দল তাদের নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করলে দেশের মানুষ সেটা বুঝতে পারে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে কথায় কথায় এসব শব্দ ব্যবহার না করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করার পরামর্শ দিতে নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার প্রয়োজন নেই।
mohshinhabib@yahoo.com
১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই থেকে ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন এ এন এম ইউসুফ। ফরিদপুরের স্থানীয় প্রবীণ দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ এন এম ইউসুফ ছিলেন একজন গভীর দেশপ্রেমিক। তিনি তাঁর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে গেছেন। সরকারের দায়িত্বে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেছেন গোপনে। বাংলাদেশের অনেক দেশপ্রেমিক গর্বিত সন্তানই সরকারি দায়িত্বে থেকে এমন ভূমিকা পালন করেছিলেন। একসময় পাকিস্তানের মিলিটারি কর্তৃপক্ষ এ এন এম ইউসুফের বিষয়টি জেনে যায়। এ এন এম ইউসুফ তখন জেলা প্রশাসকের চাকরি ফেলে পালিয়ে যান মুক্তিযুদ্ধে। অসমর্থিত সূত্র বলছে, তিনি পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়েছিলেন। পাকিস্তান আর্মি তাঁকে কোনো একটি গোপন স্থান থেকে ধরে ফরিদপুর নিয়ে এসেছিল।
স্থানীয় জনগণ বলছে, এরপর এ এন এম ইউসুফের পরিবর্তে যাঁকে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি এসেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নোটিশ দেন যে উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে। তিনি 'দুষ্কৃতকারী'দের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জেলা শহরে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করেন। তিনিও ছিলেন বাঙালি। প্রকাশ্য দিবালোকে মুক্তিযুদ্ধের মাত্র ৪০ বছর পর জেলা প্রশাসনের বাতায়ন থেকে তাঁর নামটা মুছে গেল কী করে, সেটা জানতে চাই। এ জন্য বোধকরি মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি দেখার প্রয়োজন নেই। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলেছেন, এ সময় যিনি জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেক সুবিধা আদায় করেছেন!
আরো কিছু অসংগতি দেখতে মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার প্রয়োজন পড়ে না। ঢাকার সদ্য বিদায়ী মেয়র সাদেক হোসেন খোকা একজন সুপরিচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। সর্বশেষ হরতালের দিন পুলিশ যখন তাঁকে আটক করে, তখন (পরিষ্কার টেলিভিশনের ছবিতে দেখা গেল) পুলিশের কাঁধের ওপর দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ এক অল্পবয়সী সমর্থক সাদেক হোসেন খোকার মাথায় চপেটাঘাত করল। মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনা, দীর্ঘ ৯ বছর ঢাকা মহানগরের মন্ত্রীর মর্যাদায় থাকা মেয়র অসহায়ভাবে পেছন ফিরে দেখতে চেষ্টা করলেন, কে এমন কাজ করতে পারে। পারে! সেটা দেখা গেছে সাদেক হোসেন খোকাকে পুলিশ ভ্যানে তোলার সময়ও। এ অন্যায়, এ ধৃষ্টতা দেখতে বোধকরি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার প্রয়োজন পড়ে না।
সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে চরম অসৌজন্যমূলক আচরণের ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে কোনো দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি। এই চরম অপমানজনক সহিংস আচরণের জন্য সরকার কাউকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করেনি। এটা ঠিক, বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর অনেক ক্রিয়াকর্ম অমার্জনীয়। কিন্তু সরকারকেও মনে রাখতে হবে, সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে ওই মধ্যযুগীয় আচরণও অমার্জনীয়। খোকা শুধু বিএনপি নেতা নন। খোকা ঢাকা শহরের সফল নগরপিতা, খোকা বাংলাদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিনা উসকানিতে গায়ে হাত তুলে সরকারি দলের সমর্থকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হয়েও মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করেছে। সাদেক হোসেন খোকা বিএনপির নেতা হতে পারেন, আমরা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বলে মনে করি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে একদলে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে_এমন কোনো কথা নেই। এখন আওয়ামী লীগের কাছে প্রশ্ন করার সময় ঘনিয়ে এসেছে: আগে সমর্থক-দলীয় কর্মী, নাকি আগে মুক্তযুদ্ধ? কোনটা আওয়ামী নেতাদের কাছে বেশি পছন্দের?
একসময় চরম আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পরিবারে নানা অশান্তি এবং পারিপার্শি্বক পরিস্থিতি দেখে আমার উচ্চমানের শিক্ষায় শিক্ষিত পিতা হতাশ হয়ে তাঁর সিথানের কাছে দেয়ালে একটি কাগজে লিখে রেখেছিলেন, 'দারা পুত্র পরিবার/তুমি কার, কে তোমার!' আজ অনেক দিন পর সাদেক হোসেন খোকাকে অপদস্থ করতে সে কথাই বারবার মনে পড়ছে। কেউ কারো নয়। ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি মানুষ এখন জনপ্রতিনিধিহীন। মেয়র নেই, কাউন্সিলর নেই। হাজার হাজার মানুষ পড়েছে চরম সংকটে। নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ চালানোর কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত নির্বাহী কর্মকর্তারা কাজ শুরু করেননি। এত বড় মহানগরীর বেশ কতগুলো কার্যদিবস সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু সরকার সাদেক হোসেন খোকাকে সরিয়ে দিতে পারার আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে। কোনটা সরকারের কাছে বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে_জনগণের সেবা, নাকি খোকাকে সরিয়ে দেওয়া? এ প্রশ্ন করতে মুক্তিযুদ্ধ দেখার প্রয়োজন নেই।
আরো আছে। দেখে মনে হয়, বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, আছে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহারের প্রতিযোগিতা। বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত নিয়ে যে নোংরামি দেখা গেছে, তাতে শুধু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই অপমানিত হয়েছেন। যেখানে ভুয়া মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট জমা দিয়ে সব ধরনের অভিজ্ঞতা, জ্যৈষ্ঠতা ডিঙিয়ে একশ্রেণীর সরকারি কর্মচারী সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করেছে সরকারের কাছ থেকে, সেই সরকারের অধীনেই আবার মুক্তিযোদ্ধাদের রিকশা চালিয়ে, দিনমজুর খেটে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এটি কি সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গৃহীত নীতির ত্রুটি নয়?
শুধু বাংলাদেশের কেন, যেকোনো দেশের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ একটি পবিত্র বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা_এসব শব্দ কোনো দল তাদের নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করলে দেশের মানুষ সেটা বুঝতে পারে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে কথায় কথায় এসব শব্দ ব্যবহার না করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করার পরামর্শ দিতে নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার প্রয়োজন নেই।
mohshinhabib@yahoo.com
No comments