ভোক্তার ঘাড়েই পড়বে ডলারের বাড়তি দাম by রাজীব আহমেদ

ত বছর ডিসেম্বরে বিশ্ববাজার থেকে এক ডলারে কেনা যে পণ্যটির দাম দেশে পড়েছিল ৭০ টাকা ৭৫ পয়সা, এ বছর সেই একই পণ্যের দাম পড়বে ৭৮ টাকা ৬০ পয়সা। এ হিসাব ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে লেনদেনের জন্য। আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য দেশের ব্যাংক থেকে এক ডলার জোগাড় করতে ব্যবসায়ীর লাগবে আরো বেশি। কারণ ডলারের চাহিদা বাড়ায় ব্যাংকগুলোও হয়ে পড়েছে অতিমাত্রায় হিসাবি। প্রথমেই বলবে ডলার নেই।


তারপর দরদাম করে হয়তো ৮০ টাকা ১০ পয়সায় একটি ডলার বিক্রি করতে রাজি হবে। গতকাল রবিবার পর্যন্ত চলছিল এ অবস্থা। আট মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে ডলারের দাম বাড়তে থাকলেও গত সপ্তাহে এ বাড়ার হার ছিল বেশি; যার রেশ চলছে চলতি সপ্তাহেও।
ব্যাংক কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ডলারের সংকট নেই, চাহিদা বাড়ায় সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। তবে এ 'সাময়িক'-এর মেয়াদকাল সম্পর্কে ধারণা নেই তাঁদের। তত দিন বেশি দামেই ডলার কিনে কাঁচামালের আমদানি ব্যয় মেটাতে হবে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্পমালিকদের। এতে তাঁদের উৎপাদন খরচ বাড়বে, যার ভার শেষ পর্যন্ত পড়বে ভোক্তাদের ওপর। বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও টাকার দাম কমার কারণে এর সুফল দেশের মানুষ পাবে না। কারণ এক ডলার মূল্যের কোনো পণ্যের দাম এমনিতেই গত বছরের চেয়ে অন্তত আট টাকা বেশি পড়বে।
ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকদের মতে, ডলারের দাম বাড়লে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা খুশি হলেও আমদানিনির্ভর অর্থনীতির একটি দেশে এর নেতিবাচক প্রভাবই বেশি। এতে আমদানি করা সব পণ্যের দামই বেশি পড়ে, যার ফলে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ে। আমদানিনির্ভর রপ্তানি পণ্যেরও উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে চাইলেই দাম বাড়ানো যায় না বলে ব্যবসায়ীরাও কম ক্ষতির সম্মুখীন হন না। টাকার মানের অধঃপতনের মূল্য নানাভাবেই পরিশোধ করতে হচ্ছে অর্থনীতিকে। একদিকে ডলারে আমদানি করা পণ্যের দাম টাকায় বেশি পড়ছে, অন্যদিকে বেশি টাকা দিয়ে ডলার কিনে আমদানির দায় মেটাতে হচ্ছে। দুইভাবেই বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।
বাংলাদেশের দেশীয় বাজারমুখী বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। টাকার দাম পড়ে গেলে এসব শিল্পপণ্যের দামও স্থানীয় বাজারে বেড়ে যায়। কাঁচামালের জন্য সিমেন্ট শিল্পকেও আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার, জিপসাম ও ফ্লাই অ্যাশ পুরোটাই আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। ডলারের দামের কারণে সিমেন্ট কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু চাহিদা কম থাকা ও তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে দাম বাড়াতে পারছেন না কারখানার মালিকরা।
এমআই সিমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক মো. আলমগীর কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, এক মাস আগে ডলারপ্রতি দাম ছিল ৭৫ টাকা। এখন সেটা ৭৮ টাকা। মাত্র এক মাসেই দাম বেড়েছে তিন টাকা। আর সাত-আট মাস আগের তুলনায় ডলারের দাম বেড়েছে আট টাকা। ডলারের দামের কারণে কাঁচামালের আমদানিমূল্য বাড়ছে। এতে আমদানি শুল্কসহ অন্যান্য শুল্কও বেড়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ওই ব্যবসায়ী জানান, তাঁরা প্রতি টন ক্লিংকার ৬০ ডলার দরে আমদানি করেন। প্রতি ডলারে আট টাকা বেশি দিতে হলে তাঁদের আমদানি ব্যয় বাড়ে টনপ্রতি ৪৮০ টাকা। এর সঙ্গে ৩০ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর যোগ করলে খরচ বেশি হয় ৬২৪ টাকা। এ হিসাবে প্রতি বস্তায় প্রায় ৩০ টাকা ব্যয় বেড়ে গেছে। এ বছর সিমেন্টের দাম বাড়েনি বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি না থাকা এবং আবাসন খাতে মন্দার কারণে সিমেন্টের ব্যবহার বাড়ছে না। গত বছর এ খাতে ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু এ বছর প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশের বেশি হবে না। বিক্রি তেমনভাবে না বাড়ায় কম্পানিগুলোর মুনাফা কমে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এখন লোকসান দিচ্ছে। বিদেশ থেকে আরো বেশি রেমিট্যান্স আনতে প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ইউরোপসহ অনেক দেশের বাংলাদেশিরা তাঁদের টাকা দেশে পাঠান না। প্রণোদনা দেওয়া হলে তাঁদের টাকা হয়তো দেশে আনা যেত। আর তাঁদের টাকা এলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ত। ডলারের দামও স্থিতিশীল থাকত।
এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি ও বেঙ্গল প্লাস্টিকের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্লাস্টিকের কাঁচামালের দাম টনপ্রতি ১৪০০-১৫০০ ডলার। ডলারের দাম আট টাকা বাড়লে তাঁদের খরচ বাড়ে টনপ্রতি প্রায় ১২ হাজার টাকা। এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের করও বেড়ে যায়। এর ফলে ডলারের দাম আট টাকা বাড়লে খরচ বাড়ে মূলত ১২ টাকা। তিনি বলেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর প্লাস্টিক পণ্যের দামও কিছুটা বেড়েছে। ২০ শতাংশ খরচ বাড়লে হয়তো দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এটা ডলারের দামের কারণে কতটুকু বেড়েছে, তা আলাদা করা কঠিন। ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে তিনি রিজার্ভ বাড়ানোর পরামর্শ দেন। আর এ জন্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানো প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন ওই ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, 'আমাদের রপ্তানির জন্য নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। আর রেমিট্যান্স বাড়াতে নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজে সেখানে লোক পাঠাতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে ডলারের রিজার্ভও বাড়বে।
বাংলাদেশ স্টিল মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মো. শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা স্টিল মিলের জন্য লোহার টুকরাসহ যেসব কাঁচামাল আমদানি করেন সেগুলোর টনপ্রতি দাম বিশ্ববাজারে ৪৫০ ডলারের কাছাকাছি। ডলারের দাম আট টাকা বেশি ধরলে টনপ্রতি খরচ বাড়ছে প্রায় তিন হাজার ৬০০ টাকা। ডলারের দামের পাশাপাশি তেলের দামের কারণেও খরচ বাড়ছে। কিন্তু তাঁদের পণ্যের দাম বাড়ছে না বলে দাবি করেন তিনি।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মো. শাহজাহান বলেন, 'আমাদের চাহিদার তুলনায় রডসহ অন্যান্য স্টিল পণ্যের সরবরাহ অনেক বেশি। ফলে বাজারে দাম কম। বর্তমানে যে দামে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে সেটা প্রকৃত দাম নয়। চাহিদা একটু বাড়লে দাম বেড়ে যাবে। কারণ খরচ অনেক বেড়েছে। এভাবে খরচ বাড়তে থাকলে চাহিদা না বাড়লে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেন তিনি।
ডলারের দামের খৰ পড়ছে খাদ্যপণ্যের ওপরেও। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেল, চিনি, ডালসহ প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কম থাকায় ডলারের দামের প্রভাব তেমনভাবে নজরে আসছে না। খাদ্যপণ্য আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান দামের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রি করা যেত, যদি ডলারের দাম কম থাকত।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি এক হাজার ১০০ ডলার। ডলারের দাম আট টাকা বাড়তি হিসেবে প্রতি টনে খরচ বেড়েছে আট হাজার ৮০০ টাকা। এতে লিটারপ্রতি প্রায় ৯ টাকা ব্যয় বাড়ছে মিলমালিকদের। গম, চিনি, চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিকারক গোলাম মাওলা কালের কণ্ঠকে বলেন, ডলারের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। দুই মাস আগে ৭৬ টাকা ৫০ পয়সা হিসেবে পণ্যের অর্ডার দেওয়ার পর দেখা গেল ডলারের দাম ৭৯ টাকা হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এখন কম দামের পণ্য বাজারে আছে। তাই প্রভাবটা বোঝা যাচ্ছে না। ১৫ দিন পরে প্রভাব বোঝা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.