কেমন আছ মা-আমার কলজের টুকরো কনে ঘুমোয় রয়েছে-সখিনা খাতুন
আমার বড় ছেলে জিন্দার আলী ইপিআরে (পরে বিডিআর) চাকরি করত। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। আমার ১১ ছেলেমেয়ে। স্বামী কৃষি কাজ করত। তাঁর সামান্য আয়, আমি ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে পারিনি। কিন্তু ওর মাথা খুব ভালো ছিল। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহও ছিল। যখন ওর গোঁফের রেখা ওঠে, তখন সে ইপিআরে চাকরি নেয়। সংসারে সে-ই আনন্দের জোয়ার এনে দেয়।
প্রথম বেতন পেয়ে আমাকে ২৫ টাকা দিয়ে মোমিননগরের শাড়ি উপহার দেয়। ভাইবোনদেরও এটা-ওটা কিনে দিয়েছে। ছেলে আয় করে_সংসারের অভাব দূর হয়। আমি ছেলেকে বিয়ে দিই।
এরই মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। একাত্তরের মে মাসে জিন্দার বাড়ি আসে। আমি তাকে কুকড়ো (মুরগি) জবাই করে ছিটে রুটি (যশোর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠা) খাওয়াই। কিন্তু ছেলের মন খারাপ_সারাক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। আমি তাকে বলি, 'বাবা তোওর কী হইয়েছে। মন খারাপ কইরে বইসে থাকিস ক্যান?' জিন্দার বলে, 'মা আমি যুদ্ধে যাব। দেশ স্বাধীন করব। তোমার মুখে হাসি ফোটাব।' আমি ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকি; একসময় বলি_যা, যুদ্ধে যা। আমার অনেক ছেলেমেয়ে। যদি মরতে হয়, তুই পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করে মর। ছেলে গরম ভাত খেয়ে আমাকে আর ওর বাবাকে সালাম করে চোখ মুছতে মুছতে যুদ্ধে যায়।
দুই মাস পরে একদিন গভীর রাতে জিন্দার বাড়ি ফেরে। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। জিন্দার বলে, মা তোমাদের খবর নিতে এসেছি। আমার মনে আনন্দের শেষ নেই। এর মধ্যে রাজাকাররা জিন্দারের বাড়ি ফেরার কথা জানতে পেরে আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। জিন্দার ছোট ভাই পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র সিদ্দিকের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে পাশের একটি বাগানে আশ্রয় নেয়। বাড়িঘর সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। রাত নেমে আসে। জিন্দার আর ছোট ছেলে সিদ্দিক আগুনে পোড়া ভিটেয় আসে। জিন্দার বলে, মা আমি ভারতে যাচ্ছি। সিদ্দিককেও নিয়ে যাচ্ছি। না হলে রাজাকাররা আমাদের মেরে ফেলবে।
জিন্দার ছোট ভাইয়ের হাত ধরে আমাকে কাঁদিয়ে বুক শূন্য করে বাড়ি ছেড়ে যায়। জিন্দার বনগাঁওয়ের চাপাবাড়িয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয়। সিদ্দিকও তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখায়। দুই ভাই বিহারে যুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেয়। তারা ৮ নম্বর সেক্টরের শেষ ব্যাচের সদস্য হিসেবে হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। নভেম্বর মাসে চৌগাছার ধুলিয়ানি মাঠে জিন্দার খান-সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। শুনেছি, ওই যুদ্ধে শতাধিক খান-সেনা নিহত হয়। শহীদ হয় আমার সোনার টুকরো ছেলে জিন্দার আলী এবং আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি তার লাশ দেখতে পাইনি। তার কবর কোথায়, তা-ও জানি না?
জিন্দারের সঙ্গীরা আমাকে বলেছে, ওই যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে। তাদের কবর দেওয়া সম্ভব হয়নি। শিয়াল-কুকুরে নাকি লাশ খেয়েছে!
জিন্দার আলীর অবিবাহিত প্রতিবন্ধী মেয়ে নূর নাহার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য হিসেবে ভাতা পায়। আমার খবর কেউ রাখে না। আমি ৪০ বছর ধরে জিন্দারের জন্য অপেক্ষা করছি। তার কবর খুঁজছি। 'আমার কলজের টুকরো কনে ঘুমোয় রয়েছে? জানতি পারলি জিন্দারের কবরে যাইয়ে চুমু খাতাম।'
সখিনা খাতুন : যশোর জেলার সদর উপজেলার গাওঘরা গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জিন্দার আলীর মা। বয়স ৮৫ বছর।
অনুলিখন : ফখরে আলম (সিনিয়র রিপোর্টার, কালের কণ্ঠ, যশোর অফিস)।
« পূর্ববর্তী সংবাদ
পরবর্তী সংবাদ »
এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনার মতামত দিতে এখানে ক্লিক করুন
আপনার মতামত দিন
মতামত দিতে চাইলে অনুগ্রহ করে সাইনইন করুন
* আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন
মূল পাতা প্রথম পাতা
No comments