কল্পকথার গল্প-যন্ত্র যদি হয় এমন যন্ত্রণার! by আলী হাবিব

তা বেশ চলছিল। কারো কারো দিন বেশ হেসে-খেলে যাচ্ছিল। চলছিল কিংবা যাচ্ছিল না বলে, বলা উচিত চলছে এবং যাচ্ছে। বেশ তো যাচ্ছে। পার পেতে এভাবে দিন পার না করে কোনো উপায় নেই। বেশ আলাভোলা একটা ভাব নিয়ে অনেকেই দিন পার করে দিচ্ছিলেন। তাঁদের গুড়ে বালি। আলাভোলা ভাব নিয়ে বা 'ভোলে বাবা' হয়ে ঘুরে বেড়ানোর একটা আলাদা অ্যাডভান্টেজ আছে। সেই অ্যাডভান্টেজ অনেকেই নিয়ে থাকেন। সমাজে, সংসারে, দেশে,


বিদেশে, ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগত_নানাভাবেই এই অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার সুযোগ আছে। সুযোগ অনেকেই নিয়ে থাকেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ ব্যাপারে নানা কথা বলা আছে। সে কথায় পরে আসা যাবে। আপাতত এই 'ভোলে বাবা' জাতীয় চরিত্র নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
ধরা যাক সেই ভদ্রলোকের কথা, যিনি বাইরে ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত। অফিসে মোটামুটি মাঝারি গোছের কর্তা। তাঁর অধীনে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা ভদ্রলোককে বাঘের মতো ভয় করেন। অনেকেই এড়িয়ে চলেন তাঁকে। বাইরে তিনি বাঘ। কিন্তু ঘরে ঢুকলেই তিনি বিড়ালটি হয়ে যান। বাইরে যাঁর কণ্ঠস্বর শুনলে বাঘের গর্জন বলে মনে হয়, ঘরে তিনিই আবার বিড়ালের মতো মিউ-মিউ করেন। একটা সময় ছিল, যখন তিনিও ঘরে-বাইরে দুই জায়গাতেই বাঘ ছিলেন। বাঘের মতো বিচরণ করতেন। তাঁকে দেখলে অফিসের লোকজন তো বটেই; ঘরের লোকদেরও ত্রস্ত থাকতে দেখা যেত। কিন্তু দিনে দিনে অবস্থাটা বদলে গেছে। দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও বদলে ফেলেছেন তিনি। বদলে না ফেলে কোনো উপায়ও নেই তাঁর। এই যে নিজেকে বদলে ফেলেছেন বা বদলে ফেলতে পেরেছেন, এতে একটা বাড়তি সুবিধা পেয়ে গেছেন তিনি। সেই সুবিধা যাতে বজায় থাকে, সেটাই এখন চেষ্টা তাঁর। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলা যাক।
ভদ্রলোক শেষ কবে নিজের ঘরে বাঘের মতো হেঁটেছেন, মনে করতে পারেন না। মনে করার কোনো প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন না এখন।
কারণ তিনি বেশ আছেন। সংসারে এমন অনেক মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে, যাঁরা বেশ 'ভোলে বাবা' সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এভাবে ঘুরে বেড়ানোর সংগত কারণও আছে। আজকাল খবরের কাগজ খুললে হরহামেশাই মুদ্রাস্ফীতি আর মূল্যস্ফীতির খবর দেখা যায়। এই মূল্যস্ফীতিই অনেককে 'ভোলে বাবা' করে দিয়েছে। এই 'ভোলে বাবা' জাতীয় মানুষগুলো স্রেফ ভুলে গিয়ে দিব্যি করে খাচ্ছেন সংসারে। অফিস থেকে ফেরার পথে দোকান থেকে কয়েকটি জিনিস কেনার জন্য স্ত্রী পইপই করে অনেক ভদ্রলোককেই বলে দেন। অনেক ভদ্রলোকই সেটা অবলীলায় ভুলে যান। কেউ কেউ বেশির ভাগ জিনিস নিয়ে যান। একটা বা দুটো জিনিস নিতে ভুল হয়ে যায় এমন লোকের সংখ্যা যে কত, তা বোধ হয় হিসাব করে বের করা কঠিন। এই ভুলটা অনেকের ক্ষেত্রে 'ভুল' করেই হতে পারে। কিন্তু অনেকে আবার ইচ্ছে করেই এ-জাতীয় ভুল করে থাকেন। ইচ্ছে করে এ-জাতীয় ভুল করে 'ভোলে বাবা' হয়ে যাওয়ার সুবিধা আছে। একদিকে পকেটের রেস্ত বুঝে তো দোকানে ঢুকতে হয়। সব দিন সবার সমান যায় না। স্ত্রীর ধরিয়ে দেওয়া লিস্ট মিলিয়ে বাজার করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। সব সময় সম্ভব হয় না। অন্যদিকে অনেকে সত্যি সত্যি ভুলে যান। ভুলে যাওয়ার ভান করাটা ক্ষতিকর নয়। এতেও অনেক সময় লাভ হয়। পকেটে টাকা নেই কিন্তু স্ত্রীর বায়না, ছেলেমেয়েদের আবদার আছে। মেটানো সম্ভব নয়। উপরন্তু এটা যদি হয় মাসের শেষ, তাহলে তো আর কথাই নেই। মাসের শেষে এমনিতেই পকেটে ছুঁচোয় ডন দেয়। তখন কোনো আবদার করা হলে, সেটা মেটানো সম্ভব নয়। এখানেই তো শেষ নয়। আরো আছে। মাসের শেষে কোথাও বিয়ে কিংবা জন্মদিনের নেমন্তন্ন এল। কী হবে? ভুলে যান। এর চেয়ে ভালো কোনো ওষুধ নেই। সময়মতো ভুলে যেতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ঘরে ঢুকে বলে দিন, 'ভুলে গেছি'। বাড়ির লোকজনও জানে আপনি ভুলে যান। ভুলে যাওয়াটাই আপনার জন্য স্বাভাবিক। মনে করে সঠিক কাজটি সঠিক সময়ে করতে পারলে বাড়ির লোকজন ধন্য হয়ে যায়। কাজেই ভুলে গিয়ে সমস্যার সমাধান করে ফেলুন। একইভাবে ভুলে যান নেমন্তন্নের ব্যাপারটিও। দেখা হলে বলে দিন বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। কী আর করা! শুধু কি ঘরে? বাইরেও 'ভোলে বাবা' সেজে অনেক ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারবেন। কিভাবে? ধরা যাক, কেউ একজন আরেকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছেন। নির্দিষ্ট সময় ধার শোধ করা হয়ে ওঠেনি। এখন কী করা যাবে? পথ খুঁজে বের করা সম্ভব হচ্ছে না? কয়েক দিন বাড়িতে ফেরার বিকল্প পথ খুঁজে নিতে হবে। এর পরও রক্ষা নেই? পাওনাদার পথে পাহারা বসিয়েছে? সামনে না পড়ে উপায় নেই? ভুলে যেতে হবে। পাওনাদার সামনে পড়লে ভুলে যাওয়ার ভান করতে হবে। দেখা হলে বলতে হবে, ভুলে গিয়েছিলাম। আবার সময় নিয়ে নিতে হবে। আর পাওনাদার যদি আগে থেকেই জানেন যে এই লোকটি 'ভোলাভালা', তাহলে তো কথাই নেই। সহজেই পার পাওয়া যাবে।
ভুলে যাওয়া কিংবা ভুলে যাওয়ার ভান করা_ দুটোই কিন্তু রোগ। চিকিৎসাশাস্ত্রে ভুলে যাওয়ার রোগটির নাম ডাইমেনশিয়া। যেমন কথায় বলে, 'চলি্লশ পেরোলেই চালশে', সে রকমই পঞ্চাশ পেরোলেই যেকোনো মানুষের ডাইমেনশিয়া হতে পারে। অন্যদিকে ভুলে যাওয়ার ভান করাটাও একধরনের রোগ। শাস্ত্র অর্থাৎ চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, এই রোগটির নাম ম্যালিংগারিন এবং সুকুমার রায়ের ভাষায়, 'এ রোগেরও ওষুধ আছে।'
এই ভুলে যাওয়া এবং ভুলে থাকা রোগটির বিস্তার আমাদের রাজনীতিতে একটু বোধ হয় বেশি। কেমন করে? উদাহরণ দেওয়া যাক। সব দেশে, সব সময় রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র 'ফুলের মতো পবিত্র।' তো এই ফুলের মতো পবিত্র নেতারা যখন যেমন ইচ্ছে, তখন তেমন কথা দিচ্ছেন। হরহামেশাই এটা ঘটছে। বিশেষ করে ভোটের আগে তো কথাই নেই। ভোট এসে গেলে নেতারা একের পর এক কথা দিয়েই চলেন। ভোট চলে গেলে সবাই সে কথা ভুলে যান। তখন অনেক কথাই 'কথার কথা' হয়ে যায়। পরেরবার যখন ভোট আসে, তখন সবাই আবার কথার ফুলঝুরি ঝরায়। অনেকের অনেক কথা কেবল কথাই থেকে যায়। কথা দিয়ে কথা না রাখার সংস্কৃতি আমাদের রাজনীতিতেও প্রবল। বছরের পর বছর এভাবেই তো চলে আসছে।
কিন্তু 'সেদিন হয়েছে বাসি!' এবার কেস কেঁচে যাওয়ার জোগাড়! বিজ্ঞানের হাত থেকে এবার আর রক্ষা নেই। রক্ষা নেই সর্বনাশা বিজ্ঞানীদের হাত থেকে। বিজ্ঞানীদের কেউ কথা দিয়ে কথা রক্ষা করেননি_এমন তথ্য জানা নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই 'ভোলে বাবা'দের জন্য একটি বড় দুঃসংবাদ দিচ্ছেন। 'খেয়েদেয়ে' বিজ্ঞানীদের তো আর কোনো কাজ নেই। তাঁরা নতুন নতুন আবিষ্কারে ব্যস্ত। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন যন্ত্র। কিন্তু সেই যন্ত্র কতটা যন্ত্রণার কিংবা কতটা যন্ত্রণামুক্তির, সেটা ভেবে দেখার সময় কোথায় তাঁদের। তো ওই নতুন যন্ত্রের সন্ধানে ব্যস্ত বিজ্ঞানীরা এবার নতুন যে যন্ত্রটি বানিয়েছেন, সেটার নাম 'মাইন্ড রিডিং ডিভাইস'। আগে মিথ্যে ধরার যন্ত্র ছিল। এবার চলে এল মনে করিয়ে দেওয়ার যন্ত্র। একেবারে দিন-তারিখ ধরে ধরে মনে করিয়ে দেবে, কে, কবে, কোথায়, কখন কী কথা দিয়েছিলেন। কাজেই 'ভোলে বাবা' সেজে যাঁরা বেশ করে খাচ্ছিলেন, মানে দিন গুজরান করছিলেন, তাঁরা বোধ হয় এবার একটু সমস্যায়ই পড়ে যাবেন। অনেকেই হয়তো গোপন কথা চেপে রেখে অনেককে অনেক ধরনের কথা দিয়েছেন। কিন্তু এবার আর তাঁদের 'গোপন কথাটি রবে না গোপন।' গোমর ফাঁস হয়ে যাবে।
যন্ত্রযুগের মানুষকে কিছু যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। তার পরও যন্ত্র থেকে ভালো কিছু পাওয়া গেছে বলেই যন্ত্রের যন্ত্রণা মানুষ মেনে নিয়েছে। কিছু যন্ত্র যেমন মানুষকে এনে দিয়েছে সুখ, তেমনি কিছু যন্ত্র বাড়িয়ে দিয়েছে বিড়ম্বনা। এত দিন কথা দিয়ে যাঁরা কথা রাখেননি, তাঁদের এবার একটু সতর্ক হতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে কথা বলতে হবে। কারণ একবার কথা দিয়ে ভুলে যাওয়ার সুযোগ আর থাকছে না।
'ভোলে বাবা'দের জন্য এটা দুঃসংবাদ। কথা দিয়ে বেড়ানো কেতাঅলা নেতাদের এবার কথা দেওয়ার ব্যাপারেও সাবধানী হতে হবে। কে কোথায় 'মাইন্ড রিডিং' যন্ত্র নিয়ে বসে থাকবে, কে জানে! আমরা অনেকেই হিসাব করি, কে কতটুকু কথা রাখলেন। কিন্তু কথা দিয়ে যাঁরা কথা রাখেন না, তাঁদের এখন থেকে একটু সমঝে কথা বলতে হবে। সবার জন্য নয়, এই যন্ত্র বোধ হয় তাঁদের জন্য যন্ত্রণাময় হবে, যাঁরা কথা দিয়ে কথা রাখেন না।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.