এক লাখ বিশ হাজার কোটি টাকা পাইপলাইনে by জাফর আহমেদ
দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ যেসব ঋণ ও অনুদান সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে সেখান থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার এখনও ছাড় করতে পারেনি। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ পাইপলাইনে পড়ে আছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে পাইপলাইনে আটকে থাকার প্রবণতা আগের তুলনায় বেড়েছে।
দাতাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণসহায়তা ছাড় না করতে না পারায় প্রকল্প ব্যয় মেটাতে সরকার দেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই এক বছরের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে রেকর্ড প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ নাজুক হচ্ছে।
অর্থনীতিবদদের মতে, দাতাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অর্থ না পাওয়ায় দেশের উন্নয়ন কাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পাইপলাইনে পড়ে থাকা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাড় করতে সরকারকে প্রয়োজনে টাস্কফোর্স গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। আর বৈদেশিক সহায়তা আহরণকারী প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) মনে করে এই বিপুল পরিমাণ পাইপলাইনের অর্থ কীভাবে ছাড় করবে সে পথ সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে।
ইআরডি সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত পাইপলাইনে পড়ে থাকা প্রতিশ্রুত ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪৯৭ কোটি ডলার।
খাত ভিত্তিক সহায়তার হিসাবে বিগত ১ জুলাই পর্যন্ত পাইপলাইনে ঋণ সহায়তা খাতের আটকে রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৩ কোটি ডলার। অনুদান সহায়তা রয়েছে ৩০৫ কোটি ডলার এবং খাদ্য সহায়তা রয়েছে আরও প্রায় ৪৭ কোটি ডলার।
সূত্র জানায়, ১৯৭২ থেকে ২০০৭ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত পাইপলাইনে ছিল মাত্র ৭৫৪ কোটি মার্কিন ডলার। এক বছরে ১৭২ কোটি ৭০ লাখ
ডলার বৈদেশিক সহায়তা নতুন করে যুক্ত হয়ে ২০০৮ সালে পাইপলাইনে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৯২৬ কোটি ডলার। ২০০৯ সালে নতুন করে আরও প্রায় ২০০ কোটি ডলার যুক্ত হয়ে এটি ১ হাজার ১২৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। গত ২০১০ সালে প্রায় ২২০ কোটি ডলার বৈদেশিক সহায়তা ছাড় করতে না পারায় গত ১ জুলাই পর্যন্ত পাইপলাইনের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ৩৪৬ কোটি ডলার। তার সঙ্গে চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র চার মাসে নতুন করে আরও ১৫১ কোটি ডলার যুক্ত হয়ে বর্তমানে মোট পাইপলাইনের পরিমাণ উন্নীত হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪৯৭ কোটি ডলারে।
বিপুল পরিমাণ এই বৈদেশিক অর্থ কেন পাইপলাইনে আছে জানতে চাইলে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব (বিশ্বব্যাংক দায়িত্বে) আরস্তু খান সমকালকে জানান, প্রধানত প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতার অভাবেই পাইপলাইন দীর্ঘ হচ্ছে। দাতাদের নানা রকম শর্ত এর অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন তিনি। এখন আটকে যাওয়া অর্থ দাতাদের কাছ থেকে কীভাবে ছাড় করবে সে পথ সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে। তিনি জানান, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার ছাড় করার কথা রয়েছে বিশ্বব্যাংকের। এ ছাড়াও অন্যান্য দাতাদের কাছ থেকেও অর্থবছরের শেষের দিকে অর্থ ছাড় বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।
ঋণ সহায়তার পাইপলাইন
ইআরডি সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দাতা দেশ ও দাতা সংস্থার কাছে চলতি অর্থবছরের জুলাই পর্যন্ত প্রাপ্ত ঋণ সহায়তার অর্থ পাইপলাইনে পড়ে আছে প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিশ্বব্যাংক। গত জুন মাস পর্যন্ত এ দাতা সংস্থাটি প্রায় ৩৩০ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণ পাইপলাইনে আটকে রেখেছে। এর পর রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এ দাতা সংস্থার প্রায় ১৫৬ কোটি ডলার পাইপলাইনে আটকে আছে। জাপানের প্রতিশ্রুত অর্থ পাইপলাইনে আছে প্রায় ২০৮ কোটি ডলার। গত অর্থবছর ভারতের সঙ্গে চুক্তি হওয়া ১০০ কোটি ডলার ছাড় না করায় সেই অর্থও পাইপলাইনে যুক্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়াও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) রয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ কোটি ডলার, চীনের প্রায় ২৪ কোটি ডলার এবং কুয়েতের প্রায় সাড়ে ১২ কোটি মার্কিন ডলার পাইলাইনে আটকে রয়েছে।
অনুদান সহায়তার পাইপলাইন
গত ১ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা যেসব অনুদানের চুক্তি করেছিল সেখান থেকে ৩০৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাইপলাইনে আটকে রয়েছে। অনুদান সহায়তার অর্থ ছাড় না করার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্য। এ দেশটি বিভিন্ন সময়ে অনুদান সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় ৫৮ কোটি ডলার ছাড় না করে পাইপলাইনে আটকে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ৪৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) আটকে আছে প্রায় ৩৩ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংক প্রায় ৩২ কোটি অনুদান সহায়তা আটকে রেখেছে। জার্মানির রয়েছে ২৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। ডেনমার্কের রয়েছে প্রায় ১৮ কোটি ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার অনুদান সহায়তার অর্থ পাইপলাইনে জমা হয়ে আছে।
চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ দাতাদের কাছ থেকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে প্রতিশ্রুত ৪৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পাওনা পাইপলাইনে পড়ে আছে।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, দাতাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অর্থ না পাওয়ায় তা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। প্রকল্প ঋণের অর্থ সরকার ঠিক সময়ে না পেয়ে বাধ্য হয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে। যা বেসরকারি খাতের ঋণ নেওয়ার সুযোগ সংকুচিত করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে ব্যাহত করছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমকালকে বলেন, এই বিপুল পরিমাণ প্রতিশ্রুত অর্থ পাইপলাইনে আটকে পড়ায় দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই অর্থ ছাড় করতে সরকারের জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করার পরামর্শ দেন তিনি।
পরিকল্পনা কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে সমকালকে জানিয়েছেন, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যেই একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। তিনি নিজেই এই টাস্কফোর্সের প্রধান। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে দাতাদের সঙ্গে দরকষাকষির পলিসি নির্ধারণ করা হবে।
No comments