যুবলীগ নেতা আফজালের স্ত্রীর দাবি, এটি 'প্রকাশ্য গুপ্তহত্যা' by সুমন বর্মণ
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের যুবলীগ নেতা আফজাল হোসেন। ২০০৯ সালে র্যাবের সদস্যরা সাদা পোশাকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক পরিবারের লোকজনের তৎপরতায় র্যাব তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করে একটি মামলায় আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। এরই কিছুদিন পর ২০১০ সালের অক্টোবরে রূপগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সামনে থেকে
সাদা পোশাকের একদল লোক গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। সেবার কয়েকজন জনপ্রতিনিধির তৎপরতায় একদিনের মধ্যেই তাঁকে মুক্ত করা সম্ভব হয়। এরপর থেকেই পরিবারের লোকজন আফজাল গুপ্ত হত্যার শিকার হতে পারে_এমন আতঙ্কে ভুগতে থাকে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার উপজেলার বাঘবেড় বাজার থেকে আফজালকে সাদা পোশাকের একদল লোক অস্ত্রের মুখে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা পরিবারকে জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আফজালকে গ্রেপ্তার করেছে। খবর পেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আফজালের আত্মীয়রা মন্ত্রী, র্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলার দপ্তরে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় শনিবার সকালে আফজালের মৃতদেহ নরসিংদীর মাধবদীতে পাওয়ার সংবাদে। আফজালের মাথায় চারটি ছিদ্র রয়েছে। পুলিশের ধারণা সেগুলো গুলির ছিদ্র।
নিহত আফজাল আসন্ন যুবলীগের সম্মেলনে রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। পুলিশ জানায়, আফজালের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।
এদিকে আফজালের অপহরণ, এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ, আফজালের মৃত্যু ও তড়িঘড়ি করে লাশ দাফনের ঘটনায় হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত পুলিশ হত্যার কারণ ও জড়িতদের ব্যাপারে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি। পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ওঠা অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে মামলার তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পরিবারের লোকজন জানান, আফজাল হোসেনের বাড়ি রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের দক্ষিণবাঘ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আনোয়ার মাস্টার। আফজাল আসন্ন যুবলীগের সম্মেলনে রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। তিনি এলাকায় হাউজিং কম্পানিগুলোতে জমির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। এ নিয়ে এলাকায় কিছু লোকের সঙ্গে তাঁর বিরোধ সৃষ্টি হয়। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্থানীয় বিএনপি নেতা আক্তার হোসেন।
এরই জের ধরে বিরোধী পক্ষ তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব এলাকায় প্রকাশ্য রূপ নেওয়ায় আফজাল হত্যা হলে এর দায়ভার পড়বে আক্তারের লোকজনের ওপর। এমন আশঙ্কায় আক্তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন দিয়ে আফজালকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আফজালকে সাদা পোশাকের র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ দিয়ে দুইবার তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব ঘটনায় পরিবারের লোকজন আফজাল গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার আতঙ্কে ছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্থানীয় বাঘবেড় বাজার থেকে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক অস্ত্রের মুখে তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা পরিবারকে জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আফজালকে গ্রেপ্তার করেছে। এমনই সংবাদে আফজালের স্ত্রী রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী পারভীন সুলতানা, স্থানীয় সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাংসদ পারভীনকে তাঁর রূপসীর বাসভবনে আসতে বলেন। সেখানে গিয়ে পারভীন সাংসদের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং স্বামী আফজালকে উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজী আফজালকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাঁরা আফজালকে গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করেন।
পাশাপাশি পরিবারের লোকজন র্যাবের হেডকোয়ার্টার ও র্যাব-১১-এর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ অফিসে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো দায়িত্বশীল সূত্রই আফজালকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। এতে করে পরিবারের সদস্যরা গুপ্ত হত্যার শঙ্কায় থাকেন।
শুক্রবার রাতে একই এলাকার তাজুল ও ফজল পারভীনকে মোবাইলে জানায়, তাঁরা সংবাদ পেয়েছে র্যাবের সাদা পোশাকের লোকজন আফজালকে গ্রেপ্তার করে সিদ্ধিরগঞ্জ নিয়ে গেছে। এখন আফজাল সেখানে রয়েছে। কিছু টাকা খরচ করলে আফজালকে ছাড়িয়ে আনা যাবে। তিনি পারভীনকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও বলেন। পরে খবর পাওয়া যায় নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় আফজালের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশ জানায়, শুক্রবার সকালে নরসিংদী-মদনগঞ্জ সড়কের স্কাইলেন জুট মিলসংলগ্ন একটি পুকুরে এক ব্যক্তির মৃতদেহ দেখে লোকজন পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। কিন্তু নিহত ব্যক্তির পরিচয় না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে শুক্রবার রাতে মাধবদীর একটি কবরস্থানে লাশ দাফন করে পুলিশ। নরসিংদীতে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধারের সংবাদে শনিবার দুপুরে আফজালের পরিবারের লোকজন নিহত ব্যক্তিকে আফজালের হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং কবর থেকে লাশ উত্তোলনের জন্য নরসিংদীর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানায়। জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার বিকেল ৪টায় মাধবদী থেকে আফজাল হোসেনের লাশ উত্তোলন করা হয়। এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল করিম উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল বিকেলে সরেজমিন আফজালের দক্ষিণবাঘ গ্রামে দিয়ে দেখা যায়, নরসিংদী থেকে আফজালের লাশ বাড়িতে আনা হচ্ছে এমন সংবাদে দুপুর থেকেই গ্রামের লোকজন আফজালের বাড়িতে ভিড় করে। বিকেল ৩টায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি থেকে শুরু করে রাস্তায় বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের ভিড়। বাড়ির মধ্য থেকে ভেসে আসছে কান্নার রোল। বাড়িতে ঢুকতেই আফজালের মা সালেহা বেগমের আহাজারি সবার চোখে অশ্রু ঝরাচ্ছে। ঘরের ভেতর চলছে স্ত্রী পারভীন সুলতানার আহাজারি। সাড়ে তিন বছরের একমাত্র ছেলে পিয়াল বাড়িতে এত লোক দেখে অপলক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আফজালকে অপহরণের সময় সামনে থেকে দেখেছেন পেঁয়াজু বিক্রেতা আবদুল আজিজ ও সবজি বিক্রেতা মজিবুর। তাঁরা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আবদুল আজিজের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে নিমকি খাচ্ছিল। হঠাৎ করে একটি সাদা মাইক্রোবাস থেকে চার-পাঁচজন উঁচু লম্বা লোক নেমে তাকে এক পলকেই থাবা দিয়ে গাড়িতে তুলে ফেলে এবং মাইক্রোবাসটি খিলক্ষেতের দিকে চলে যায়।'
আফজালের স্ত্রী পারভীন সুলতানা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার স্বামীকে দীর্ঘদিন ধরে হত্যার পরিকল্পনা চলছিল। এরই অংশ হিসেবে তাঁকে র্যাব ও ডিবি দিয়ে অপহরণ করে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আগে রক্ষা পেলেও এবার আর শেষ রক্ষা হলো না, তাঁকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে।'
পারভীন আরো বলেন, 'আমরা শুনেছি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন তাঁকে তুলে নিয়েছে। কিন্তু কেউ আমার স্বামীকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেনি। যাদের সঙ্গে আমার স্বামীর বিরোধ তাদের পরিকল্পনায়ই আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। তা না হলে পুলিশ কেন লাশ উদ্ধার করেই পরিচয় না জানার চেষ্টা করে তড়িঘড়ি লাশ দাফন করেছে? এ সব ঘটনা কিসের আলামত বহন করে? এ ব্যাপারে তিনি থানায় মামলা দায়ের করবেন বলে জানান।
নিহতের মা সালেহা বেগম বলেন, 'আমার ছেলে কখনো কারো কোনো ক্ষতি করেনি। কোনো গরিব মানুষ আমার বাড়িতে এসে খালি হাতে ফিরে যায়নি। সে অকাতরে গরিবদের বিলিয়ে দিত। আর খারাপ লোকদের কাছে ছিল সে চোখের বিষ। তারাই আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।'
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নরসিংদী সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ শুরু করেছি। হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে, সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনো আমরা কিছু বলছি না।' তিনি বলেন, এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম উচ্চারিত হলেও এখন পর্যন্ত তাদের কেউ গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্বীকার করেনি।
তবে এ ঘটনায় নীরব ভূমিকা পালন করছেন রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ঘটনায় মামলা হয়েছে নরসিংদীতে। তাই এ ঘটনায় আমরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছি না। আমাদের কাছে এখনো কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয়নি। তাই ঘটনা নিয়ে আমরা এখনো মাঠপর্যায়ে কাজ করেনি।'
র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মোস্তফা গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রূপগঞ্জ এলাকাটি র্যাবের নরসিংদী ক্যাম্পের অধীন। বিষয়টি আমরা অবগতি হয়েছি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সম্পর্কে প্রতিবেদনের জন্য নরসিংদী ক্যাম্পকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
এক প্রশ্নের জবাবে ওই অফিসার বলেন, একটা ঘটনা ঘটেছে। সেটা কারা করেছে তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়। কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেই একাধিক বিভাগ রয়েছে। পাশাপাশি দুষ্কৃতকারীরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করতে পারে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার উপজেলার বাঘবেড় বাজার থেকে আফজালকে সাদা পোশাকের একদল লোক অস্ত্রের মুখে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা পরিবারকে জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আফজালকে গ্রেপ্তার করেছে। খবর পেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আফজালের আত্মীয়রা মন্ত্রী, র্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলার দপ্তরে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় শনিবার সকালে আফজালের মৃতদেহ নরসিংদীর মাধবদীতে পাওয়ার সংবাদে। আফজালের মাথায় চারটি ছিদ্র রয়েছে। পুলিশের ধারণা সেগুলো গুলির ছিদ্র।
নিহত আফজাল আসন্ন যুবলীগের সম্মেলনে রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। পুলিশ জানায়, আফজালের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।
এদিকে আফজালের অপহরণ, এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ, আফজালের মৃত্যু ও তড়িঘড়ি করে লাশ দাফনের ঘটনায় হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত পুলিশ হত্যার কারণ ও জড়িতদের ব্যাপারে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি। পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ওঠা অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে মামলার তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পরিবারের লোকজন জানান, আফজাল হোসেনের বাড়ি রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের দক্ষিণবাঘ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আনোয়ার মাস্টার। আফজাল আসন্ন যুবলীগের সম্মেলনে রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। তিনি এলাকায় হাউজিং কম্পানিগুলোতে জমির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। এ নিয়ে এলাকায় কিছু লোকের সঙ্গে তাঁর বিরোধ সৃষ্টি হয়। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্থানীয় বিএনপি নেতা আক্তার হোসেন।
এরই জের ধরে বিরোধী পক্ষ তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব এলাকায় প্রকাশ্য রূপ নেওয়ায় আফজাল হত্যা হলে এর দায়ভার পড়বে আক্তারের লোকজনের ওপর। এমন আশঙ্কায় আক্তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন দিয়ে আফজালকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আফজালকে সাদা পোশাকের র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ দিয়ে দুইবার তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব ঘটনায় পরিবারের লোকজন আফজাল গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার আতঙ্কে ছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্থানীয় বাঘবেড় বাজার থেকে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক অস্ত্রের মুখে তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা পরিবারকে জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আফজালকে গ্রেপ্তার করেছে। এমনই সংবাদে আফজালের স্ত্রী রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী পারভীন সুলতানা, স্থানীয় সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাংসদ পারভীনকে তাঁর রূপসীর বাসভবনে আসতে বলেন। সেখানে গিয়ে পারভীন সাংসদের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং স্বামী আফজালকে উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজী আফজালকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাঁরা আফজালকে গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করেন।
পাশাপাশি পরিবারের লোকজন র্যাবের হেডকোয়ার্টার ও র্যাব-১১-এর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ অফিসে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো দায়িত্বশীল সূত্রই আফজালকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। এতে করে পরিবারের সদস্যরা গুপ্ত হত্যার শঙ্কায় থাকেন।
শুক্রবার রাতে একই এলাকার তাজুল ও ফজল পারভীনকে মোবাইলে জানায়, তাঁরা সংবাদ পেয়েছে র্যাবের সাদা পোশাকের লোকজন আফজালকে গ্রেপ্তার করে সিদ্ধিরগঞ্জ নিয়ে গেছে। এখন আফজাল সেখানে রয়েছে। কিছু টাকা খরচ করলে আফজালকে ছাড়িয়ে আনা যাবে। তিনি পারভীনকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও বলেন। পরে খবর পাওয়া যায় নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় আফজালের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশ জানায়, শুক্রবার সকালে নরসিংদী-মদনগঞ্জ সড়কের স্কাইলেন জুট মিলসংলগ্ন একটি পুকুরে এক ব্যক্তির মৃতদেহ দেখে লোকজন পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। কিন্তু নিহত ব্যক্তির পরিচয় না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে শুক্রবার রাতে মাধবদীর একটি কবরস্থানে লাশ দাফন করে পুলিশ। নরসিংদীতে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধারের সংবাদে শনিবার দুপুরে আফজালের পরিবারের লোকজন নিহত ব্যক্তিকে আফজালের হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং কবর থেকে লাশ উত্তোলনের জন্য নরসিংদীর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানায়। জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার বিকেল ৪টায় মাধবদী থেকে আফজাল হোসেনের লাশ উত্তোলন করা হয়। এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল করিম উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল বিকেলে সরেজমিন আফজালের দক্ষিণবাঘ গ্রামে দিয়ে দেখা যায়, নরসিংদী থেকে আফজালের লাশ বাড়িতে আনা হচ্ছে এমন সংবাদে দুপুর থেকেই গ্রামের লোকজন আফজালের বাড়িতে ভিড় করে। বিকেল ৩টায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি থেকে শুরু করে রাস্তায় বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের ভিড়। বাড়ির মধ্য থেকে ভেসে আসছে কান্নার রোল। বাড়িতে ঢুকতেই আফজালের মা সালেহা বেগমের আহাজারি সবার চোখে অশ্রু ঝরাচ্ছে। ঘরের ভেতর চলছে স্ত্রী পারভীন সুলতানার আহাজারি। সাড়ে তিন বছরের একমাত্র ছেলে পিয়াল বাড়িতে এত লোক দেখে অপলক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আফজালকে অপহরণের সময় সামনে থেকে দেখেছেন পেঁয়াজু বিক্রেতা আবদুল আজিজ ও সবজি বিক্রেতা মজিবুর। তাঁরা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আবদুল আজিজের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে নিমকি খাচ্ছিল। হঠাৎ করে একটি সাদা মাইক্রোবাস থেকে চার-পাঁচজন উঁচু লম্বা লোক নেমে তাকে এক পলকেই থাবা দিয়ে গাড়িতে তুলে ফেলে এবং মাইক্রোবাসটি খিলক্ষেতের দিকে চলে যায়।'
আফজালের স্ত্রী পারভীন সুলতানা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার স্বামীকে দীর্ঘদিন ধরে হত্যার পরিকল্পনা চলছিল। এরই অংশ হিসেবে তাঁকে র্যাব ও ডিবি দিয়ে অপহরণ করে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আগে রক্ষা পেলেও এবার আর শেষ রক্ষা হলো না, তাঁকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে।'
পারভীন আরো বলেন, 'আমরা শুনেছি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন তাঁকে তুলে নিয়েছে। কিন্তু কেউ আমার স্বামীকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেনি। যাদের সঙ্গে আমার স্বামীর বিরোধ তাদের পরিকল্পনায়ই আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। তা না হলে পুলিশ কেন লাশ উদ্ধার করেই পরিচয় না জানার চেষ্টা করে তড়িঘড়ি লাশ দাফন করেছে? এ সব ঘটনা কিসের আলামত বহন করে? এ ব্যাপারে তিনি থানায় মামলা দায়ের করবেন বলে জানান।
নিহতের মা সালেহা বেগম বলেন, 'আমার ছেলে কখনো কারো কোনো ক্ষতি করেনি। কোনো গরিব মানুষ আমার বাড়িতে এসে খালি হাতে ফিরে যায়নি। সে অকাতরে গরিবদের বিলিয়ে দিত। আর খারাপ লোকদের কাছে ছিল সে চোখের বিষ। তারাই আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।'
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নরসিংদী সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ শুরু করেছি। হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে, সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনো আমরা কিছু বলছি না।' তিনি বলেন, এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম উচ্চারিত হলেও এখন পর্যন্ত তাদের কেউ গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্বীকার করেনি।
তবে এ ঘটনায় নীরব ভূমিকা পালন করছেন রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ঘটনায় মামলা হয়েছে নরসিংদীতে। তাই এ ঘটনায় আমরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছি না। আমাদের কাছে এখনো কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয়নি। তাই ঘটনা নিয়ে আমরা এখনো মাঠপর্যায়ে কাজ করেনি।'
র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মোস্তফা গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রূপগঞ্জ এলাকাটি র্যাবের নরসিংদী ক্যাম্পের অধীন। বিষয়টি আমরা অবগতি হয়েছি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সম্পর্কে প্রতিবেদনের জন্য নরসিংদী ক্যাম্পকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
এক প্রশ্নের জবাবে ওই অফিসার বলেন, একটা ঘটনা ঘটেছে। সেটা কারা করেছে তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়। কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেই একাধিক বিভাগ রয়েছে। পাশাপাশি দুষ্কৃতকারীরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করতে পারে।
No comments