কালান্তরের কড়চা-একটি ব্যর্থ ও বিকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার করে লাভ হবে কি? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশে এখনো ঋণাত্মক রাজনীতির প্রবাহ বইছে। এই যে সারা বিশ্বে এত পরিবর্তনের ঢেউ, তার কোনো কিছুই বঙ্গোপসাগরের তীর পর্যন্ত এসে পেঁৗছতে পারছে না। দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল, মনে হয় দুটিই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে অতীতের জেদাজেদি রাজনীতিতেই আবদ্ধ থাকতে চাইছে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল একটি পরীক্ষামূলক সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে; স্থায়ী ব্যবস্থা
হিসেবে নয়। এই পরীক্ষামূলক ব্যবস্থায় কয়েকটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাটি সফল বলে প্রমাণিত হয়নি।
অথচ এই অসফল ও অস্থায়ী ব্যবস্থাটিকেই স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে ধরে রাখা এবং আগামী নির্বাচনও এই ব্যবস্থার অধীনে করার জন্য জেদ ধরেছে বিএনপি। অন্যদিকে সাহাবুদ্দীন-লতিফুর রহমানের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুকীর্তি, ইয়াজউদ্দিনের অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এক-এগারোর সেনা তাঁবেদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড দেখার পর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এই ব্যবস্থাটি বাতিল করেছে। আদালতেরও সিদ্ধান্ত সেদিকেই। তবে আওয়ামী লীগ সরকার জেদ ধরেছে, তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবার থেকেই শুরু করবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা হবে কি হবে না, তা কোনো জেদাজেদির ব্যাপার নয়। দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যদি সহায়ক হয়, তাহলে ব্যবস্থাটি আরো কিছুকাল বহাল রাখা যেতে পারে। কিন্তু যদি সহায়ক না হয়, তাহলে তা বাতিল করা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু বিএনপি জেদ ধরেছে, এই ব্যর্থ ব্যবস্থাটি বহাল না রাখলে তারা নির্বাচনে যাবে না; নির্বাচন হতে দেবে না। সম্প্রতি বিএনপিনেত্রী এই সিদ্ধান্তটি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগনেত্রী জোরের সঙ্গে বলেছেন, কোনো কারণেই আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন হবে না। হবে দলীয় সরকারের অধীনে। এই জেদাজেদির ফলে অবস্থা কী দাঁড়াবে? দেশকে একটি সংঘর্ষমূলক অথবা অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হবে কি?
আমার ধারণা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, এটা একটা বিরাট ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। এটা একটা অজুহাত। আসলে ছলে-বলে-কৌশলে তাদের নির্বাচনে জয়ী হতে না দিলে, তারা নির্বাচনে যেতে চায় না এবং গেলেও সংসদে বসতে চায় না। কয়েকটি নির্বাচনই তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার যে কয়টিতে বিএনপি পরাজিত হয়েছে, সেই পরাজয়ও তারা মেনে নেয়নি। বলেছে, তাদের জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এই অজুহাতে তারা সংসদে যায়নি। কিন্তু নির্লজ্জভাবে বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ির সব সুবিধা ভোগ করেছে এবং এখনো করছে।
সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হলেও তাতে বিএনপি জয়ী না হলে তারা সেই নির্বাচনের রায় মেনে নেবে এবং সংসদে যাবে তার নিশ্চয়তা কি? নির্বাচনে পরাজিত হলে তারা অবশ্যই সংসদে যাবে না। এখন তারা শুধু দয়া করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, সে জন্য তাদের আবদার পূরণের জন্য কি একটি ব্যর্থ ও দূষিত ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা সঙ্গত হবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও পরাজিত হলে বিএনপি বলে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। তারা সংসদে যায় না। অথচ এখন তারা বায়না ধরেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখতেই হবে।
অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের যখন প্রথম দাবি ওঠে, তখন ক্ষমতায় বসে বিএনপি তার ঘোর বিরোধিতা করেছে। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হতেই তারা সেই পরাজয় মানেনি। নির্বাচনের সুষ্ঠুতা স্বীকার করেনি। নানা অজুহাতে সংসদ বর্জন করেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরও তারা তাই করেছে। এখন নানা দোষে দুষ্ট এবং ব্যর্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি বাতিল হতেই তারা এই ব্যবস্থায় মহাপ্রেমিক সেজেছে এবং চিৎকার শুরু করেছে, এই ব্যবস্থা রাখতেই হবে। এই ব্যাপারে তারা কি জনসাধারণের কাছে প্রকাশ্য অঙ্গীকার ঘোষণা করতে রাজি আছে যে এই ব্যবস্থার অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং তারা পরাজিত হলে সেই পরাজয় তারা মেনে নেবে? কোনো অজুহাতেই আর সংসদ বর্জন করবে না?
বিশ্বের সব সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশেই ক্ষমতাসীন সরকারের তত্ত্বাবধানেই সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও পাকিস্তানেও তাই হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে প্রথম সাধারণ নির্বাচন (১৯৭৩) হয় তাও দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তী সময় যে এই স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রইল না, সে জন্যও খালেদা জিয়া এবং তাঁর সরকারের চরম নির্বাচনী জালিয়াতি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দায়ী। আওয়ামী লীগ দায়ী নয়। মাগুরার একটি নির্বাচন কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিএনপি যে জালিয়াতি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়, তা ছিল সারা উপমহাদেশে অভূতপূর্ব। বিএনপির ক্যাডারদের সন্ত্রাসের মুখে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে পর্যন্ত ওই কেন্দ্র থেকে পালাতে হয়েছিল। '৯৬ সালে ফেব্রুয়ারি-নির্বাচন ছিল জালিয়াতি।
বিএনপি সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ অসম্ভব জেনেই শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সব রাজনৈতিক দল বিকল্প ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। যে জামায়াত এখন বিএনপির প্রাণের বন্ধু, সেই জামায়াতও সেদিন বিএনপি সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন একেবারেই অসম্ভব বলে ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিল। সারা দেশের মানুষের দাবির মুখে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু গোড়া থেকেই এই ব্যবস্থাটিকে সুষ্ঠুভাবে চলতে দেয়নি।
১৯৯৬ সালে সংসদের মধ্যরাতের অধিবেশনে (বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে) তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আইন পাস করতে গিয়ে সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে (এই পদে তখন ছিলেন বিএনপি দলের রাজাকার রাষ্ট্রপতি নামে পরিচিত আবদুর রহমান বিশ্বাস) রেখে দিয়ে ব্যবস্থাটিকে শুরুতেই বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয় এবং এই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন বানচাল করার জন্য রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনীর একাংশের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা হয় (অনেকটাই ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের মতো)। তবে সেটা সফল হয়নি। রাজাকার রাষ্ট্রপতি সব দোষ তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের ঘাড়ে চাপিয়ে তাঁকে পদচ্যুত করেন। পরে এই চক্রান্তের আসল নাটেরগুরুদের একজন জেনারেল মাহবুবুর রহমান সামরিক চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বিএনপিতে যোগ দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটিকে ভণ্ডুল করতে না পেরে বিএনপি এই ব্যবস্থাটিকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা চালায় এবং তাতেও অনেকাংশে সফল হয়। পাকিস্তানের আইএসআই, পশ্চিমা কূটনীতিকদের ঢাকাস্থ ট্যুইসডে ক্লাব, ঢাকার এক শ্রেণীর এলিটদের সুশীল সমাজ, নিরপেক্ষ নামে পরিচিত দুটি বর্ণচোরা মিডিয়া ইত্যাদির সাহায্যে তখনকার সাহাবুদ্দীন-লতিফুর জুটি তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিএনপি জব্দ করে ফেলে এবং সামরিক বাহিনীর প্রভাবশালী একাংশের সহায়তায় তারা নির্বাচনে 'মহাবিজয়ের' অধিকারী হয়।
বস্তুত এরপর থেকেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মহাপ্রেমিক হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারে, এই ব্যবস্থাটিকে হাইজ্যাক করে তারা যা করতে পারে, তা নিজেরা ক্ষমতায় বসে করতে পারে না। সুতরাং ক্ষমতায় বসেই শুরু হলো এই হাইজ্যাক প্রসেস। এই প্রসেস সফল করার জন্য দেশের অশুভ রাজনীতির সবচেয়ে কুশলী রূপকার ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তো তাদের সঙ্গেই ছিলেন। পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেব যে বিচারপতি নিয়োগ পাবেন, তিনি যাতে অঙ্গুলি হেলনের বাইরের লোক না হন, সে জন্য নির্লজ্জভাবে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স বাড়ানো-কমানো হলো। তাঁবেদার নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো। তাদের সাহায্যে যে ভোটার তালিকা তৈরি করা হলো, পরবর্তী সময়ে ধরা পড়েছে, তাতে কোটিখানেকের বেশি ছিল ভুয়া ভোটার।
এই ধরনের অপরাধ করার সাহস এবং ক্ষমতা দুই-ই সম্ভবত আওয়ামী লীগের ছিল না এবং এখনো নেই। কিন্তু শুধু অপরাধ করার ব্যাপারে নয়, গলাবাজিতেও বিএনপি দক্ষ। ক্ষমতায় বসে যেসব গুরুতর অন্যায় ও অপরাধ তারা করেছে, যেসব অন্যায় ও অপরাধ এখন তারা আওয়ামী লীগের কাঁধে চাপিয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়েছে। খালেদা জিয়ার বক্তৃতা-বিবৃতি পাঠ করলে মনে হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এমনই এক ব্যবস্থা, যা না থাকলে রোজকিয়ামত এসে যাবে এবং তাদের চেয়ে গণতন্ত্রের বড় পূজারি আর কেউ নেই।
এই মায়াকান্নার কারণ, গত নির্বাচনের সময় তারা ব্যবস্থাটি হাইজ্যাক করেছিল, আগামী নির্বাচনেও করতে পারবে_এই আশা করছে। সংবিধানের সব বিধিবিধান ও মর্যাদাকে লাথি মেরে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে অগ্রাহ্য করে দলীয় রাষ্ট্রপতিকে (ইয়াজউদ্দিন) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বনিযুক্ত প্রধান বানিয়ে এবং তাঁর দ্বারা নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করে, তাঁবেদার নির্বাচন কমিশন ও ভুয়া ভোটার তালিকা দ্বারা যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়েছিল, তার চেয়ে বড় জালিয়াতির নির্বাচনের দ্বিতীয় উদাহরণ সম্ভবত আফ্রিকার জঙ্গলেও খুঁজে পাওয়া যেত না। এক-এগারোর আগে দৃশ্যত মনে হচ্ছিল দেশ চলছে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারা। কিন্তু দেশের একটি শিশুও তখন জানত ইয়াজউদ্দিন চলছেন এবং চালিত হচ্ছেন বেগম জিয়া এবং তাঁর ছেলে তারেকের টেলিফোনের মাধ্যমে দেওয়া নির্দেশের দ্বারা_ইয়াজউদ্দিনও নয়, মাতা-পুত্রই চালাচ্ছেন।
এই অবস্থায় দেশ একটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক-এগারোর সরকারের ক্ষমতায় বসে যত অন্যায়ই করে থাকুক, কিন্তু যে কাজটির জন্য দেশের মানুষ এখনো তাদের দিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে তাকায় তা হলো, দেশকে একটি ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের সময়োচিত পদক্ষেপ। কী কারণে তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা নিয়ে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয় এবং তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু তাদের এই এক দিনের পদক্ষেপ একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিল। বিএনপিনেত্রীর নির্দেশে বঙ্গভবনে বসে বশংবদ ইয়াজউদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি হত্যা করে তার লাশের ওপর বসে দেশ চালাচ্ছিলেন। জেনারেল মইন ও তাঁর সহকর্মীরা বঙ্গভবন থেকে সেই লাশ এবং লাশের ওপর উপবিষ্ট ব্যক্তিটিকে সরিয়ে একটি সিভিল-মিলিটারি সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেশকে বাঁচান।
ফখরুদ্দীন সরকারেরও পরিচয় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আসলে সরকারটি ছিল একটি অনির্বাচিত সিভিল-মিলিটারি সরকার। ইয়াজউদ্দিনের মাধ্যমে চালিত চক্রান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি আগেই নিহত হয়। দেশের যে কল্যাণ করার জন্য ব্যবস্থাটির উদ্ভব ঘটেছিল, বিএনপি হাইজ্যাক করায় প্রথমে তাতে বিকৃতি ঘটে এবং পরে সেটির মৃত্যু ঘটে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবস্থাটিকে মর্যাদার সঙ্গে যথাসময়ে দাফন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিকই করেছে। বিএনপি এখন বিপাকে পড়ে এই ব্যবস্থার মৃতদেহের বা প্রেতাত্মার পুনরুজ্জীবন চায়।
দেশ শাসনে আওয়ামী লীগের অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে, ব্যর্থতা থাকতে পারে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদের নির্বাচন-উপনির্বাচন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনেই কারচুপি ও জালিয়াতি করার দুর্নাম আওয়ামী লীগের নেই। এবারও সিটি করপোরেশন থেকে পৌরসভা নির্বাচনে নিরপেক্ষতা লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ তোলার সুযোগ বিএনপি পায়নি। পৌরসভা নির্বাচনই প্রমাণ করে, এখন দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে স্বাভাবিক নির্বাচনব্যবস্থায় ফিরে যেতে দেরি করা উচিত নয়। বিএনপি যদি দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে দেশের আর সব নির্বাচনেই অংশ নিতে পারে, তাহলে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে অংশ নিতে আপত্তি কোথায়? ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতায় এলে তাদের সরকারের তত্ত্বাবধানেই তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এ ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে, যে দলের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, নির্বাচন কমিশন যেন স্বাধীন ও যথেষ্ট শক্তিশালী থাকে। ভোটার তালিকা যেন নির্ভুল ও সঠিক হয়। কোনো কারণেই ভুয়া ভোটারদের নাম যেন তালিকাভুক্ত না হয় সে জন্য কঠোর সতর্কতা ও স্ক্রুটিনির ব্যবস্থা থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কাজে সরকার যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, নির্বাচন পরিচালকদের ওপরও নির্বাচন কমিশনের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকে_সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপির উচিত এসব দাবি তোলা এবং সরকার যাতে তা পূরণ করে তার জন্য চাপ সৃষ্টি করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চারের হুজুগে দাবি তুলে তারা দেশে গোলমাল সৃষ্টি ছাড়া আর কোনোভাবে লাভবান হতে পারবে কি?
আমি এই লেখার শুরুতেই বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি এমন কোনো ইস্যু নয়, যা নিয়ে দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল জেদাজেদি শুরু করতে পারে। 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না', 'নির্বাচন করতে দেব না'_এটা বিএনপির অহেতুক ও অকল্যাণকর জেদ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে পদ্ধতিটি বিকৃত ও ব্যর্থ হয়ে গেছে সেটি বাতিল করে ভালোই করেছে। তবে সম্ভবত এই বাতিল করার ব্যবস্থাটিও আরো দু-একটি টার্মের পর করা হলে ভালো হতো। দেশের শীর্ষ আদালতও এ সম্পর্কে তাদের রায়ে সে কথাই বলেছেন।
আওয়ামী লীগ বলছে, আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে হবেই। এ কথায়ও জেদ প্রকাশ পায়। ভালো কাজ করতে গেলে দৃঢ়তা প্রয়োজন; জেদ নয়। আওয়ামী লীগ সরকার একটি ব্যর্থ-বিকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পরিত্যাগ করেছে_এটা সুসিদ্ধান্ত। কিন্তু এই সুসিদ্ধান্তটি কার্যকর করার ব্যাপারে তারা একটু সময় নিতে পারত। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে এবং শুধু আগামী নির্বাচন পরিচালনার সীমাবদ্ধ দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে একটি বিকল্প কাঠামোর কথা ভাবতে পারত।
এই বিকল্প ব্যবস্থাটি কী হবে_তা আমি এক কথায় বলে দিতে পারব না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে এনে একটি গোলটেবিল বৈঠকে বসে এই বিকল্প ব্যবস্থাটি উদ্ভাবন করতে পারেন। এই গোলটেবিল বৈঠকে নিজেদের সুপারিশ পেশ করার জন্য বিএনপি যদি না আসে, তাহলে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। নিজেদের ভূমিকা দ্বারা জনগণের কাছে তারা নিজেদের স্বরূপ উন্মোচন করবে এবং 'হারাধনের একটি ছেলেতে' পরিণত হবে।
লন্ডন, ৪ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০১১
অথচ এই অসফল ও অস্থায়ী ব্যবস্থাটিকেই স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে ধরে রাখা এবং আগামী নির্বাচনও এই ব্যবস্থার অধীনে করার জন্য জেদ ধরেছে বিএনপি। অন্যদিকে সাহাবুদ্দীন-লতিফুর রহমানের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুকীর্তি, ইয়াজউদ্দিনের অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এক-এগারোর সেনা তাঁবেদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড দেখার পর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এই ব্যবস্থাটি বাতিল করেছে। আদালতেরও সিদ্ধান্ত সেদিকেই। তবে আওয়ামী লীগ সরকার জেদ ধরেছে, তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবার থেকেই শুরু করবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা হবে কি হবে না, তা কোনো জেদাজেদির ব্যাপার নয়। দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যদি সহায়ক হয়, তাহলে ব্যবস্থাটি আরো কিছুকাল বহাল রাখা যেতে পারে। কিন্তু যদি সহায়ক না হয়, তাহলে তা বাতিল করা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু বিএনপি জেদ ধরেছে, এই ব্যর্থ ব্যবস্থাটি বহাল না রাখলে তারা নির্বাচনে যাবে না; নির্বাচন হতে দেবে না। সম্প্রতি বিএনপিনেত্রী এই সিদ্ধান্তটি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগনেত্রী জোরের সঙ্গে বলেছেন, কোনো কারণেই আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন হবে না। হবে দলীয় সরকারের অধীনে। এই জেদাজেদির ফলে অবস্থা কী দাঁড়াবে? দেশকে একটি সংঘর্ষমূলক অথবা অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হবে কি?
আমার ধারণা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, এটা একটা বিরাট ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। এটা একটা অজুহাত। আসলে ছলে-বলে-কৌশলে তাদের নির্বাচনে জয়ী হতে না দিলে, তারা নির্বাচনে যেতে চায় না এবং গেলেও সংসদে বসতে চায় না। কয়েকটি নির্বাচনই তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার যে কয়টিতে বিএনপি পরাজিত হয়েছে, সেই পরাজয়ও তারা মেনে নেয়নি। বলেছে, তাদের জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এই অজুহাতে তারা সংসদে যায়নি। কিন্তু নির্লজ্জভাবে বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ির সব সুবিধা ভোগ করেছে এবং এখনো করছে।
সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হলেও তাতে বিএনপি জয়ী না হলে তারা সেই নির্বাচনের রায় মেনে নেবে এবং সংসদে যাবে তার নিশ্চয়তা কি? নির্বাচনে পরাজিত হলে তারা অবশ্যই সংসদে যাবে না। এখন তারা শুধু দয়া করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, সে জন্য তাদের আবদার পূরণের জন্য কি একটি ব্যর্থ ও দূষিত ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা সঙ্গত হবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও পরাজিত হলে বিএনপি বলে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। তারা সংসদে যায় না। অথচ এখন তারা বায়না ধরেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখতেই হবে।
অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের যখন প্রথম দাবি ওঠে, তখন ক্ষমতায় বসে বিএনপি তার ঘোর বিরোধিতা করেছে। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হতেই তারা সেই পরাজয় মানেনি। নির্বাচনের সুষ্ঠুতা স্বীকার করেনি। নানা অজুহাতে সংসদ বর্জন করেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরও তারা তাই করেছে। এখন নানা দোষে দুষ্ট এবং ব্যর্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি বাতিল হতেই তারা এই ব্যবস্থায় মহাপ্রেমিক সেজেছে এবং চিৎকার শুরু করেছে, এই ব্যবস্থা রাখতেই হবে। এই ব্যাপারে তারা কি জনসাধারণের কাছে প্রকাশ্য অঙ্গীকার ঘোষণা করতে রাজি আছে যে এই ব্যবস্থার অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং তারা পরাজিত হলে সেই পরাজয় তারা মেনে নেবে? কোনো অজুহাতেই আর সংসদ বর্জন করবে না?
বিশ্বের সব সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশেই ক্ষমতাসীন সরকারের তত্ত্বাবধানেই সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও পাকিস্তানেও তাই হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে প্রথম সাধারণ নির্বাচন (১৯৭৩) হয় তাও দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তী সময় যে এই স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রইল না, সে জন্যও খালেদা জিয়া এবং তাঁর সরকারের চরম নির্বাচনী জালিয়াতি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দায়ী। আওয়ামী লীগ দায়ী নয়। মাগুরার একটি নির্বাচন কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিএনপি যে জালিয়াতি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়, তা ছিল সারা উপমহাদেশে অভূতপূর্ব। বিএনপির ক্যাডারদের সন্ত্রাসের মুখে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে পর্যন্ত ওই কেন্দ্র থেকে পালাতে হয়েছিল। '৯৬ সালে ফেব্রুয়ারি-নির্বাচন ছিল জালিয়াতি।
বিএনপি সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ অসম্ভব জেনেই শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সব রাজনৈতিক দল বিকল্প ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। যে জামায়াত এখন বিএনপির প্রাণের বন্ধু, সেই জামায়াতও সেদিন বিএনপি সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন একেবারেই অসম্ভব বলে ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিল। সারা দেশের মানুষের দাবির মুখে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু গোড়া থেকেই এই ব্যবস্থাটিকে সুষ্ঠুভাবে চলতে দেয়নি।
১৯৯৬ সালে সংসদের মধ্যরাতের অধিবেশনে (বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে) তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আইন পাস করতে গিয়ে সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে (এই পদে তখন ছিলেন বিএনপি দলের রাজাকার রাষ্ট্রপতি নামে পরিচিত আবদুর রহমান বিশ্বাস) রেখে দিয়ে ব্যবস্থাটিকে শুরুতেই বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয় এবং এই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন বানচাল করার জন্য রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনীর একাংশের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা হয় (অনেকটাই ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের মতো)। তবে সেটা সফল হয়নি। রাজাকার রাষ্ট্রপতি সব দোষ তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের ঘাড়ে চাপিয়ে তাঁকে পদচ্যুত করেন। পরে এই চক্রান্তের আসল নাটেরগুরুদের একজন জেনারেল মাহবুবুর রহমান সামরিক চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বিএনপিতে যোগ দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটিকে ভণ্ডুল করতে না পেরে বিএনপি এই ব্যবস্থাটিকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা চালায় এবং তাতেও অনেকাংশে সফল হয়। পাকিস্তানের আইএসআই, পশ্চিমা কূটনীতিকদের ঢাকাস্থ ট্যুইসডে ক্লাব, ঢাকার এক শ্রেণীর এলিটদের সুশীল সমাজ, নিরপেক্ষ নামে পরিচিত দুটি বর্ণচোরা মিডিয়া ইত্যাদির সাহায্যে তখনকার সাহাবুদ্দীন-লতিফুর জুটি তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিএনপি জব্দ করে ফেলে এবং সামরিক বাহিনীর প্রভাবশালী একাংশের সহায়তায় তারা নির্বাচনে 'মহাবিজয়ের' অধিকারী হয়।
বস্তুত এরপর থেকেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মহাপ্রেমিক হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারে, এই ব্যবস্থাটিকে হাইজ্যাক করে তারা যা করতে পারে, তা নিজেরা ক্ষমতায় বসে করতে পারে না। সুতরাং ক্ষমতায় বসেই শুরু হলো এই হাইজ্যাক প্রসেস। এই প্রসেস সফল করার জন্য দেশের অশুভ রাজনীতির সবচেয়ে কুশলী রূপকার ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তো তাদের সঙ্গেই ছিলেন। পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেব যে বিচারপতি নিয়োগ পাবেন, তিনি যাতে অঙ্গুলি হেলনের বাইরের লোক না হন, সে জন্য নির্লজ্জভাবে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স বাড়ানো-কমানো হলো। তাঁবেদার নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো। তাদের সাহায্যে যে ভোটার তালিকা তৈরি করা হলো, পরবর্তী সময়ে ধরা পড়েছে, তাতে কোটিখানেকের বেশি ছিল ভুয়া ভোটার।
এই ধরনের অপরাধ করার সাহস এবং ক্ষমতা দুই-ই সম্ভবত আওয়ামী লীগের ছিল না এবং এখনো নেই। কিন্তু শুধু অপরাধ করার ব্যাপারে নয়, গলাবাজিতেও বিএনপি দক্ষ। ক্ষমতায় বসে যেসব গুরুতর অন্যায় ও অপরাধ তারা করেছে, যেসব অন্যায় ও অপরাধ এখন তারা আওয়ামী লীগের কাঁধে চাপিয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়েছে। খালেদা জিয়ার বক্তৃতা-বিবৃতি পাঠ করলে মনে হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এমনই এক ব্যবস্থা, যা না থাকলে রোজকিয়ামত এসে যাবে এবং তাদের চেয়ে গণতন্ত্রের বড় পূজারি আর কেউ নেই।
এই মায়াকান্নার কারণ, গত নির্বাচনের সময় তারা ব্যবস্থাটি হাইজ্যাক করেছিল, আগামী নির্বাচনেও করতে পারবে_এই আশা করছে। সংবিধানের সব বিধিবিধান ও মর্যাদাকে লাথি মেরে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে অগ্রাহ্য করে দলীয় রাষ্ট্রপতিকে (ইয়াজউদ্দিন) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বনিযুক্ত প্রধান বানিয়ে এবং তাঁর দ্বারা নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করে, তাঁবেদার নির্বাচন কমিশন ও ভুয়া ভোটার তালিকা দ্বারা যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়েছিল, তার চেয়ে বড় জালিয়াতির নির্বাচনের দ্বিতীয় উদাহরণ সম্ভবত আফ্রিকার জঙ্গলেও খুঁজে পাওয়া যেত না। এক-এগারোর আগে দৃশ্যত মনে হচ্ছিল দেশ চলছে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারা। কিন্তু দেশের একটি শিশুও তখন জানত ইয়াজউদ্দিন চলছেন এবং চালিত হচ্ছেন বেগম জিয়া এবং তাঁর ছেলে তারেকের টেলিফোনের মাধ্যমে দেওয়া নির্দেশের দ্বারা_ইয়াজউদ্দিনও নয়, মাতা-পুত্রই চালাচ্ছেন।
এই অবস্থায় দেশ একটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক-এগারোর সরকারের ক্ষমতায় বসে যত অন্যায়ই করে থাকুক, কিন্তু যে কাজটির জন্য দেশের মানুষ এখনো তাদের দিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে তাকায় তা হলো, দেশকে একটি ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের সময়োচিত পদক্ষেপ। কী কারণে তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা নিয়ে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয় এবং তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু তাদের এই এক দিনের পদক্ষেপ একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিল। বিএনপিনেত্রীর নির্দেশে বঙ্গভবনে বসে বশংবদ ইয়াজউদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি হত্যা করে তার লাশের ওপর বসে দেশ চালাচ্ছিলেন। জেনারেল মইন ও তাঁর সহকর্মীরা বঙ্গভবন থেকে সেই লাশ এবং লাশের ওপর উপবিষ্ট ব্যক্তিটিকে সরিয়ে একটি সিভিল-মিলিটারি সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেশকে বাঁচান।
ফখরুদ্দীন সরকারেরও পরিচয় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আসলে সরকারটি ছিল একটি অনির্বাচিত সিভিল-মিলিটারি সরকার। ইয়াজউদ্দিনের মাধ্যমে চালিত চক্রান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি আগেই নিহত হয়। দেশের যে কল্যাণ করার জন্য ব্যবস্থাটির উদ্ভব ঘটেছিল, বিএনপি হাইজ্যাক করায় প্রথমে তাতে বিকৃতি ঘটে এবং পরে সেটির মৃত্যু ঘটে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবস্থাটিকে মর্যাদার সঙ্গে যথাসময়ে দাফন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিকই করেছে। বিএনপি এখন বিপাকে পড়ে এই ব্যবস্থার মৃতদেহের বা প্রেতাত্মার পুনরুজ্জীবন চায়।
দেশ শাসনে আওয়ামী লীগের অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে, ব্যর্থতা থাকতে পারে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদের নির্বাচন-উপনির্বাচন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনেই কারচুপি ও জালিয়াতি করার দুর্নাম আওয়ামী লীগের নেই। এবারও সিটি করপোরেশন থেকে পৌরসভা নির্বাচনে নিরপেক্ষতা লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ তোলার সুযোগ বিএনপি পায়নি। পৌরসভা নির্বাচনই প্রমাণ করে, এখন দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে স্বাভাবিক নির্বাচনব্যবস্থায় ফিরে যেতে দেরি করা উচিত নয়। বিএনপি যদি দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে দেশের আর সব নির্বাচনেই অংশ নিতে পারে, তাহলে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে অংশ নিতে আপত্তি কোথায়? ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতায় এলে তাদের সরকারের তত্ত্বাবধানেই তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এ ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে, যে দলের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, নির্বাচন কমিশন যেন স্বাধীন ও যথেষ্ট শক্তিশালী থাকে। ভোটার তালিকা যেন নির্ভুল ও সঠিক হয়। কোনো কারণেই ভুয়া ভোটারদের নাম যেন তালিকাভুক্ত না হয় সে জন্য কঠোর সতর্কতা ও স্ক্রুটিনির ব্যবস্থা থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কাজে সরকার যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, নির্বাচন পরিচালকদের ওপরও নির্বাচন কমিশনের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকে_সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপির উচিত এসব দাবি তোলা এবং সরকার যাতে তা পূরণ করে তার জন্য চাপ সৃষ্টি করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চারের হুজুগে দাবি তুলে তারা দেশে গোলমাল সৃষ্টি ছাড়া আর কোনোভাবে লাভবান হতে পারবে কি?
আমি এই লেখার শুরুতেই বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি এমন কোনো ইস্যু নয়, যা নিয়ে দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল জেদাজেদি শুরু করতে পারে। 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না', 'নির্বাচন করতে দেব না'_এটা বিএনপির অহেতুক ও অকল্যাণকর জেদ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে পদ্ধতিটি বিকৃত ও ব্যর্থ হয়ে গেছে সেটি বাতিল করে ভালোই করেছে। তবে সম্ভবত এই বাতিল করার ব্যবস্থাটিও আরো দু-একটি টার্মের পর করা হলে ভালো হতো। দেশের শীর্ষ আদালতও এ সম্পর্কে তাদের রায়ে সে কথাই বলেছেন।
আওয়ামী লীগ বলছে, আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে হবেই। এ কথায়ও জেদ প্রকাশ পায়। ভালো কাজ করতে গেলে দৃঢ়তা প্রয়োজন; জেদ নয়। আওয়ামী লীগ সরকার একটি ব্যর্থ-বিকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পরিত্যাগ করেছে_এটা সুসিদ্ধান্ত। কিন্তু এই সুসিদ্ধান্তটি কার্যকর করার ব্যাপারে তারা একটু সময় নিতে পারত। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে এবং শুধু আগামী নির্বাচন পরিচালনার সীমাবদ্ধ দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে একটি বিকল্প কাঠামোর কথা ভাবতে পারত।
এই বিকল্প ব্যবস্থাটি কী হবে_তা আমি এক কথায় বলে দিতে পারব না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে এনে একটি গোলটেবিল বৈঠকে বসে এই বিকল্প ব্যবস্থাটি উদ্ভাবন করতে পারেন। এই গোলটেবিল বৈঠকে নিজেদের সুপারিশ পেশ করার জন্য বিএনপি যদি না আসে, তাহলে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। নিজেদের ভূমিকা দ্বারা জনগণের কাছে তারা নিজেদের স্বরূপ উন্মোচন করবে এবং 'হারাধনের একটি ছেলেতে' পরিণত হবে।
লন্ডন, ৪ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০১১
No comments