আঁধার ঘরে মাটির পিদিম by ড. বেগম জাহান আরা
অন্ধকার কত নিকষ কালো হতে পারে, তা প্রথম বুঝেছিলাম মুক্তিযুদ্ধকালীন পলাতকজীবনে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াতাম তিন ছেলেমেয়ে আর নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য। প্রায় সাত মাসে নাম-না-জানা কত গ্রাম, কত বিচিত্র মানুষ দেখেছি! কিন্তু রাত হলেই কাবু হয়ে যেতাম আমরা সবাই। ভীষণ অসহায় লাগত। কখনো আশ্রয় নেওয়া বাড়িতে একটিমাত্র কুপি বাতি জ্বলত। কোথাও বা লণ্ঠনও জ্বলত। তাতেই যে আলো হতো, তা-ই ছিল মহার্ঘ।
হাতড়ে হাতড়ে কিছু কাজ করে নেওয়া হতো। খাওয়া বলতে ডালভর্তা বা আলুভর্তা আর ভাত। সে প্রায় অন্ধকারেই খেয়ে নিতাম। কষ্ট অনুভব করিনি। ভেবেছি, এই আলোর আভাসই জীবন। বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্বাস। মনে জোর এনেছি, বারবার মনে মনে বলেছি, এমন দিন থাকবে না। থাকেওনি। একদিন স্বাধীনতার সূর্য উঠল ঘরে। চোখ ধাঁধিয়ে গেল আলোর ছটায়। শুধু আলো আর আলো চারদিকে। শোক-দুঃখ, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, হাহাকার_সব ঢেকে গেল আলোর চাদরে। কিন্তু হায়! আবার আঁধার নেমেছে জীবনে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মানচিত্রজুড়ে নিকষ কালো আঁধার। পত্রপত্রিকা খুললেই অজস্র দুঃসংবাদ। খুন, ছিনতাই, ঘুষ, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট-বাণিজ্য, লুট, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, অস্থিতিশীল বাজার, ভর্তিবাণিজ্য, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, সীমান্ত সমস্যা, অবাধ বৃক্ষনিধন এবং মন বিষণ্ন করা আরো অসংখ্য খবর।
তবে মাঝেমধ্যে ভালো খবরও পাই। যেমন_পানির ওপর কচুরিপানার ধাপ বানিয়ে সবজির চাষ করছে কর্মী মানুষ, নতুন সুগন্ধি ধান আবিষ্কার এবং চাষ করছে কৃষক ভাইয়েরা, স্ট্রবেরির চাষ হচ্ছে দেশে, হাঁস-মুরগির খামার, সবজির চাষ, নার্সারি করছে মানুষ, ছোটখাটো আবিষ্কার করছে দেশের মেধাবী মানুষ ইত্যাদি সংবাদে মনটা খুশি হয়। প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ মানুষ কিন্তু বসে থাকে না। গায়ে হাওয়া লাগিয়েও বেড়ায় না। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। কঠোর পরিশ্রম করে। কোনো না কোনো অর্থকরী কাজে ব্যয় করে সময়। তারপর যা কিছু উৎপাদন হয়, তা বাজারজাতকরণের জন্য আকুল হয়ে ওঠে। হবেই তো! উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেই তো দুটো পয়সা আয় হবে। ক্ষুধা নিবৃত্ত হবে পরিবারের সবার। কিন্তু উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির পথে অন্তরায় হয় বেহাল রাস্তা। গাড়িঘোড়া তো দূরের কথা, মানুষজনও চলাচল করতে পারে না। সুতরাং মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পণ্য উৎপাদন করার পরও চোখের পানি পড়ে তাদের। দুরবস্থায় পড়লে কৃষকরা আর যাবে কোথায়? ইউনিয়ন পরিষদের কাছেই রাস্তা মেরামতের আবেদন নিয়ে যায়। একবার নয়, বারবার। লাভ হয় না কিছুই। অবশেষে গ্রামবাসী চাঁদা তুলে রাস্তা মেরামতের সরঞ্জাম কেনে। তারপর লেগে পড়ে কাজে। গাংনীর মানুষও তা-ই করছে। স্বেচ্ছাশ্রমে এগিয়ে আসে সৎ কর্মী মানুষ।
বাংলাদেশটা সত্যি সোনার দেশ। এখানকার মাটি মায়ের মতো অকৃপণ ভালোবাসায় হৃদয় উজাড় করে ফল-ফসল দেয়। গাংনী এলাকায় কচু আর পানের ব্যাপক চাষ হয়। ওই ফসলেই তাদের ভাত-কাপড়। এক চাষি জানিয়েছেন, রাস্তার কারণে ১০-১২ দিন পান বাজারজাত করতে পারেননি। এক নছিমন চালক বলেছেন, রাস্তার কারণে সাত-আট দিন ধরে নছিমন চলাচল বন্ধ থাকায় তাঁদের না খেয়ে মরার অবস্থা হয়েছে। সেই নছিমনচালকও নেমে পড়েছেন রাস্তা মেরামতের কাজে। গ্রামের দরিদ্র মানুষ কেউ দিয়েছে টাকা, কেউ দিচ্ছে শ্রম। আধুনিক জগতে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হলে বিপর্যয় নেমে আসে। আর তাতে বিপন্ন মানুষের কষ্ট বাড়ে। তাই গাংনীর মানুষ সড়ক মেরামতের মাধ্যমে বাঁচারই লড়াই করছে। ইউপি চেয়ারম্যান বলেছেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে রাস্তা ভেঙে গর্ত হয়ে গেছে। খুব স্বাভাবিক কথা। রাস্তা তো যানবাহন চলাচলের জন্যই; পিংপং খেলার জন্য তো নয়। আজকাল অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বাস-ট্রাক চলাচল করে। এটা সুখবর নিঃসন্দেহে। তবে কেউ যদি মনে করে যে একবার রাস্তা নির্মিত হয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা নেই, সেটা ভুল। মস্ত ভুল। প্রতিটি নির্মাণকাজের জন্য চাই কঠোর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা। রাস্তার জন্য তো আরো বেশি। সারা বছরই রাস্তা সংস্কারের কাজ চালাতে হবে। কোথাও ভাঙা বা গর্ত হওয়ামাত্রই মেরামত করতে হবে সেটা। কথাটা সচেতন মানুষদের বুঝতে হবে এবং কাজও করিয়ে নিতে হবে এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত হর্তাকর্তাদের দিয়ে।
শুধু গাংনী কেন, ঢাকায় রাস্তাঘাটের কী অবস্থা? ধানমণ্ডি এলাকায় ভেতরের রাস্তাগুলো জঘন্য। এবড়োখেবড়ো, ভাঙা, গর্ত এবং খোলা ডাস্টবিনে ভরা। একটু বৃষ্টি হলে তো সোনায় সোহাগা। কাদা-খোয়া-ময়লায় ডাস্টবিনের যে ককটেল তৈরি হয়, তা বর্ণনার ভাষা নেই আমার। একই অবস্থা গুলশান এলাকার। আলিশান বাড়ির সামনেই দেখা যায় ভাঙা রাস্তা। একটি-দুটি রাস্তা এ রকম নয়, অলিগলির সব রাস্তায়ই কুরুচিপূর্ণ অবস্থায় পেঁৗছেছে।
গাংনীর সহজ-সরল গ্রামবাসীকে তাই সৎ কর্মের আইকন হিসেবে তুলে ধরা উচিত। চারদিকে যখন আলস্য আর দুর্নীতির পাহাড়, নিশ্চেষ্ট উদাসীনতায় নির্লজ্জ মানুষ যখন আঁধারপুরী তৈরি করে, নিজের অর্থবিত্ত, সম্পদ, গাড়ি-বাড়ি নিয়ে স্থূল ভোগের তমসায় গা ডুবিয়ে বাঁচে, তখন গাংনীর কর্মী মানুষরা জ্বালিয়েছে মাটির প্রদীপ। যত কমই হোক, আলো দিচ্ছে প্রদীপটি। এ রকম সহস্র প্রদীপ জ্বলে উঠুক সারা দেশে। স্বাধীনতা যেমন কেউ হাতে তুলে দেয়নি, তেমনি আলোও দেবে না। আমাদেরই জ্বালাতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও বাধ্য করতে হবে আলো জ্বালাতে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
তবে মাঝেমধ্যে ভালো খবরও পাই। যেমন_পানির ওপর কচুরিপানার ধাপ বানিয়ে সবজির চাষ করছে কর্মী মানুষ, নতুন সুগন্ধি ধান আবিষ্কার এবং চাষ করছে কৃষক ভাইয়েরা, স্ট্রবেরির চাষ হচ্ছে দেশে, হাঁস-মুরগির খামার, সবজির চাষ, নার্সারি করছে মানুষ, ছোটখাটো আবিষ্কার করছে দেশের মেধাবী মানুষ ইত্যাদি সংবাদে মনটা খুশি হয়। প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ মানুষ কিন্তু বসে থাকে না। গায়ে হাওয়া লাগিয়েও বেড়ায় না। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। কঠোর পরিশ্রম করে। কোনো না কোনো অর্থকরী কাজে ব্যয় করে সময়। তারপর যা কিছু উৎপাদন হয়, তা বাজারজাতকরণের জন্য আকুল হয়ে ওঠে। হবেই তো! উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেই তো দুটো পয়সা আয় হবে। ক্ষুধা নিবৃত্ত হবে পরিবারের সবার। কিন্তু উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির পথে অন্তরায় হয় বেহাল রাস্তা। গাড়িঘোড়া তো দূরের কথা, মানুষজনও চলাচল করতে পারে না। সুতরাং মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পণ্য উৎপাদন করার পরও চোখের পানি পড়ে তাদের। দুরবস্থায় পড়লে কৃষকরা আর যাবে কোথায়? ইউনিয়ন পরিষদের কাছেই রাস্তা মেরামতের আবেদন নিয়ে যায়। একবার নয়, বারবার। লাভ হয় না কিছুই। অবশেষে গ্রামবাসী চাঁদা তুলে রাস্তা মেরামতের সরঞ্জাম কেনে। তারপর লেগে পড়ে কাজে। গাংনীর মানুষও তা-ই করছে। স্বেচ্ছাশ্রমে এগিয়ে আসে সৎ কর্মী মানুষ।
বাংলাদেশটা সত্যি সোনার দেশ। এখানকার মাটি মায়ের মতো অকৃপণ ভালোবাসায় হৃদয় উজাড় করে ফল-ফসল দেয়। গাংনী এলাকায় কচু আর পানের ব্যাপক চাষ হয়। ওই ফসলেই তাদের ভাত-কাপড়। এক চাষি জানিয়েছেন, রাস্তার কারণে ১০-১২ দিন পান বাজারজাত করতে পারেননি। এক নছিমন চালক বলেছেন, রাস্তার কারণে সাত-আট দিন ধরে নছিমন চলাচল বন্ধ থাকায় তাঁদের না খেয়ে মরার অবস্থা হয়েছে। সেই নছিমনচালকও নেমে পড়েছেন রাস্তা মেরামতের কাজে। গ্রামের দরিদ্র মানুষ কেউ দিয়েছে টাকা, কেউ দিচ্ছে শ্রম। আধুনিক জগতে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হলে বিপর্যয় নেমে আসে। আর তাতে বিপন্ন মানুষের কষ্ট বাড়ে। তাই গাংনীর মানুষ সড়ক মেরামতের মাধ্যমে বাঁচারই লড়াই করছে। ইউপি চেয়ারম্যান বলেছেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে রাস্তা ভেঙে গর্ত হয়ে গেছে। খুব স্বাভাবিক কথা। রাস্তা তো যানবাহন চলাচলের জন্যই; পিংপং খেলার জন্য তো নয়। আজকাল অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বাস-ট্রাক চলাচল করে। এটা সুখবর নিঃসন্দেহে। তবে কেউ যদি মনে করে যে একবার রাস্তা নির্মিত হয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা নেই, সেটা ভুল। মস্ত ভুল। প্রতিটি নির্মাণকাজের জন্য চাই কঠোর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা। রাস্তার জন্য তো আরো বেশি। সারা বছরই রাস্তা সংস্কারের কাজ চালাতে হবে। কোথাও ভাঙা বা গর্ত হওয়ামাত্রই মেরামত করতে হবে সেটা। কথাটা সচেতন মানুষদের বুঝতে হবে এবং কাজও করিয়ে নিতে হবে এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত হর্তাকর্তাদের দিয়ে।
শুধু গাংনী কেন, ঢাকায় রাস্তাঘাটের কী অবস্থা? ধানমণ্ডি এলাকায় ভেতরের রাস্তাগুলো জঘন্য। এবড়োখেবড়ো, ভাঙা, গর্ত এবং খোলা ডাস্টবিনে ভরা। একটু বৃষ্টি হলে তো সোনায় সোহাগা। কাদা-খোয়া-ময়লায় ডাস্টবিনের যে ককটেল তৈরি হয়, তা বর্ণনার ভাষা নেই আমার। একই অবস্থা গুলশান এলাকার। আলিশান বাড়ির সামনেই দেখা যায় ভাঙা রাস্তা। একটি-দুটি রাস্তা এ রকম নয়, অলিগলির সব রাস্তায়ই কুরুচিপূর্ণ অবস্থায় পেঁৗছেছে।
গাংনীর সহজ-সরল গ্রামবাসীকে তাই সৎ কর্মের আইকন হিসেবে তুলে ধরা উচিত। চারদিকে যখন আলস্য আর দুর্নীতির পাহাড়, নিশ্চেষ্ট উদাসীনতায় নির্লজ্জ মানুষ যখন আঁধারপুরী তৈরি করে, নিজের অর্থবিত্ত, সম্পদ, গাড়ি-বাড়ি নিয়ে স্থূল ভোগের তমসায় গা ডুবিয়ে বাঁচে, তখন গাংনীর কর্মী মানুষরা জ্বালিয়েছে মাটির প্রদীপ। যত কমই হোক, আলো দিচ্ছে প্রদীপটি। এ রকম সহস্র প্রদীপ জ্বলে উঠুক সারা দেশে। স্বাধীনতা যেমন কেউ হাতে তুলে দেয়নি, তেমনি আলোও দেবে না। আমাদেরই জ্বালাতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও বাধ্য করতে হবে আলো জ্বালাতে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
No comments