মানবাধিকার পরিস্থিতি-দায় সরকারকেই নিতে হয়

হু তর্ক-বিতর্কের পরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে আশাপ্রদ কোনো সংবাদ শোনাতে পারেনি বাংলাদেশের দায়িত্বশীল মহলগুলো। এ কথা সত্য, প্রথম যখন চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অভিযান শুরু হয়েছিল তখন অনেকেই একে সমর্থন করেছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল, এটি সাময়িক ব্যবস্থা এবং গুরুতর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলার পর এটি থেমে যাবে। সেটি বাঞ্ছনীয়ও বটে।


একটি রাষ্ট্র কখনোই তার আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে চলে এমন কোনো ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দিতে পারে না। বিচার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তা দীর্ঘসূত্রী হতে পারে, ব্যয়বহুল হতে পারে, আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা ছাড়া পেতে পারে। কিন্তু এসবই বিচার ব্যবস্থা অনিবার্য বৈশিষ্ট্য নয়। পৃথিবীর বহু দেশ বিচার ব্যবস্থাকে উন্নততর করেছে। বাংলাদেশেও উন্নত সে ব্যবস্থা চালু হতে পারে। কিন্তু বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার অজুহাতে বিচার বিভাগকে এড়িয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সন্ত্রাসীদের ধরতে এবং বিচারের তোয়াক্কা না করে হত্যা করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে প্রক্রিয়াটি কার্যকর আছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ক্রসফায়ারের আদলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হলে নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এর বিরোধিতা করেছিল। ক্রমে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছে। শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা ঘটেনি। ক্রসফায়ার চলেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ক্রসফায়ারের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করেছেন। সাম্প্রতিককালে গ্রেফতার ও ক্রসফায়ারের বিকল্প হিসেবে অপহরণ ও গুম-খুনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে গ্রেফতার করা হলেও পরে বাহিনীগুলো গ্রেফতারের খবর অস্বীকার করছে। এভাবে গ্রেফতার ও অপহৃত অনেকেই গুম-খুনের শিকার হচ্ছেন। বিষয়টি উদ্বেগজনক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি জবাবদিহিতা এড়াতে অপহরণ ও গুম-খুনের পথ বেছে নিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালায়, তাতে জনমনে প্রবল ভীতি ও অনিরাপত্তার বোধ সঞ্চারিত হয়। এতে হয়তো বাহিনীগুলো নিরাপদ থাকতে পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক কোনো সরকারের জন্য এটি সুখকর পরিস্থিতি হতে পারে না। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয়, কোনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব অপহরণ ও গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত নয় তবুও কারা রাষ্ট্রের এসব বাহিনীর নাম করে অপকর্ম চালাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য। রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীর নামে দিনের পর দিন হত্যা, অপহরণের মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়ে চলেছে এবং বাহিনীগুলো নির্বিকার বসে রয়েছে তা কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে সম্প্রতি এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বাংলাদেশ সম্পর্কে যে মূল্যায়ন হাজির করেছে তা অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। এ নিয়ে নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে কথা উঠছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও বক্তব্য এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক অর্জন আছে। কিন্তু ক্রসফায়ার, গুম-খুনের কালিমা সব অবদানকে ম্লান করে দিচ্ছে। এ কারণে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানকে দেউলিয়া বলে মত প্রকাশিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফোরামে। আমরা মনে করি, এসব বিষয়ে অতিদ্রুত সরকারকে সচেতন হতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রতি নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধ ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা ও তৎপরতাও এখনই নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.