রাজনীতি-ভাদ্র মাসে হালের গরু হারাইলে... by বদিউর রহমান

কী দরকার ছিল ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত করার? এমনিতেই যেখানে সরকার এবং দলটি ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের খেসারত কীভাবে সামাল দেবে এ সরকার? আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিসিসির নির্বাচন না দিয়ে যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি করেছে, এবার ডিসিসি দ্বিখণ্ডিত করে সে আস্থাহীনতাকে আরও দৃঢ় করল


আমি গ্রামের ছেলে। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে এবং ষাটের দশকের প্রথমদিকে গ্রামে গরু-ছাগল লালনপালন থেকে শুরু করে কৃষি জমিতে চাষাবাদের কাজ এবং ছোট্ট হাতের কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। সে জীবন এখনও বড় মধুর লাগে, বড় বেশি চোখে ভেসে ওঠে। তখন তো গরুতেই হালচাষ হতো। বড় গৃহস্থের বড় বড় ষাঁড় বা বলদ ছিল হালের জন্য, গরিবের ছিল গাই, অর্থাৎ গাভী। আমাদের পাশের বাড়ি মাঝি বাড়ির 'আজুর বাপ হুয়া (ফুপা)' আর 'হাবু ভাইছা'দের ছিল বড় বড় বলদ আর অন্যদের কারও মাঝারি বলদ থাকলেও বেশিরভাগের ছিল গাই গরু। এ গাই গরু শুধু দুধই দিত না, এদের দিয়ে হালচাষও করা হতো। আমি দেখতাম, বড় কষ্ট পেতাম। কৃষক চাচা-জেঠারা কেউ কেউ জোরে হাঁটার জন্য এ গাই গরুকেও পেটাত, লেজের ওপর মোচড় দিত, পশ্চাৎদেশে আলকাঠির খোঁচা দিত। দুর্বল গাই অনেক সময় লাঙল টানতে না পেরে মাটিতে পড়েও যেত_ সে কী নির্মম দৃশ্য দেখতাম; কিন্তু বেচারা গরিব চাষিরও তো উপায় নেই_ লাঙল দিতে হবে, ফসল ফলাতে হবে, তারও তো বেঁচে থাকতে হবে। যেসব গরিবের দুটি গাভী থাকত না তারা আরেকজনের একটা গাভী নিয়ে একদিন সে, আরেকদিন ও হাল দিত। ভাদ্র মাসে আমন রোপার ভরা মৌসুমে হালের গরু বড় বেশি দামি, এক একদিনের অর্ধবেলার হালচাষের সে কী মূল্য! আর ভাদ্রের রোদ তো আরও নির্দয়! সে সময় যদি হালের একটা গরু হারিয়ে যায় তখন কি আর কৃষকের দিগ্গি্বদিক জ্ঞান থাকে? এবং ঘটলও তাই। এক কৃষকের হালচাষ অবস্থায় একটা গরু হারিয়ে গেল, ভাদ্রের রোদে গ্রামকে গ্রাম খুঁজেও গরু পেল না কৃষক। ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত দেহে বাড়ি ফিরেই ঘরের সামনে তার ছেলে আবুলকে দেখে বলল_ ভাই, এক গ্গ্নাস পানি দে। নিজ ছেলেকে ভাই বলাতে তার স্ত্রী দৌড়ে এলো রান্নাঘর থেকে, বলল_ ও তো আমাদের আবুল, আপনে তারে ভাই কইলেন ক্যান? বেচারা কৃষকের চোখে অন্ধকার, রোদ থেকে ছায়ায় এসে চোখে আরও অন্ধকার দেখে, গরু হারানোর যন্ত্রণায় তার ভাই আর ছেলের তফাত বোঝার সময় কই? এমন সময় বউয়ের কথাও কি মধুর মনে হয়? সোজা নিরুত্তাপ উত্তর তার_ ভাদ্র মাসে হালের গরু হারালে এমনই হয়রে মা! বউ এবার বলতে থাকল, তার ছেলেকে ভাই বলেছে ঠিকই ছিল, আমাকে মা বলে যে তালাকে ফেলে দিল_ এর কী হবে গো! বউ হুজুর থেকে শুনেছিলেন, বউকে স্বামী মা বললে নাকি বউ তালাক হয়ে যায়। আওয়ামী সরকারের ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত করা দেখে আমার মতো বেকুবের তাই মনে হলো আওয়ামী সরকার কি রাজনীতির ভাদ্র মাসের হালের গরু হারাইয়াছে?
জগাখিচুড়ির দল বিএনপির হালের রাজনীতি নিয়ে আমি কথা বলতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। তারেক-কোকোকে নিয়ে পারিবারিক রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকলে আর জাতীয় রাজনীতিতে মনোনিবেশের সময় কোথায় পাবে দলটি? তারপর আবার সবাই কোরাস গেয়ে তাদের দুর্নীতি থেকে রক্ষা এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ঘ্যানর ঘ্যানর করলে মানুষ তা আর কত সহ্য করবে? অতএব, আওয়ামী লীগ সুযোগ পেয়ে যায়, হয়ে পড়ে আরও বেপরোয়া। রাজনীতিতে দেখায় আরও দুর্বিনীত আচরণ। হালে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী সরকার যেন দেশের মানুষকে আর মানুষ মনে করতে চাইছে না, শেখ হাসিনা যেন এক কথায় লৌহমানবী হতে চাচ্ছেন অথবা তুঘলকি কাণ্ড করতেও যেন আর ভাবতে চাইছেন না। কিন্তু এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ হবে তা যেন এ সরকার আর এ দলের বিবেচনায়ই আসে না। আমার মনে পড়ে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে অভাবিত বিজয়ের পর আরটিভির এক সাক্ষাৎকারে (তখনও শপথ গ্রহণ হয়নি) আমি বলেছিলাম, দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনপ্রাপ্তিতে অশুভ ইঙ্গিত থাকতে পারে, বঙ্গবন্ধুও একদল করে ফেলেছিলেন। অনেক বেদরকারি সিদ্ধান্তে অযথা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক ভালো কাজ হলেও ছোট ছোট দৃষ্টিকটু এবং মানুষের বিরক্তি সৃষ্টিকারী বক্তব্যও কিছু সিদ্ধান্ত সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়। অথচ তার চারপাশের চাটুকাররা তারপরও তাকে কেবল ফুলাচ্ছে আর ফুলাচ্ছে, বেশি ফুললে যে 'বেলুন' ফেটে যাবে সেদিকে কারও খেয়ালই নেই। এত কিছুর পরও জনগণ আওয়ামী সমর্থনে থাকতে চায়, কারণ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ টের পেয়েছে জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত থাকতে হলে আওয়ামী সরকার দরকার। কিন্তু জনমনে বারবার আঘাত দিলে বেদরকারি কাজে গুরুত্ব দিলে মানুষ কত মেনে নেবে?
কী দরকার ছিল ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত করার? এমনিতেই যেখানে সরকার এবং দলটি ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের খেসারত কীভাবে সামাল দেবে এ সরকার? আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিসিসির নির্বাচন না দিয়ে যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি করেছে, এবার ডিসিসি দ্বিখণ্ডিত করে সে আস্থাহীনতাকে আরও দৃঢ় করল। আমরা সেবা বৃদ্ধির যুক্তি গ্রহণ করতে নারাজ, তা চাইলে মেট্রোপলিটন সরকার করা প্রশংসিত হতো। দু'ভাগ করলেও যে ভোটে জেতা যাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? বরং মানুষ ক্ষেপে গিয়ে উত্তর-দক্ষিণ দুটিতেই আওয়ামী পরাজয় দেখতে চাইতে পারে। ঢাকা তথা রাজধানী ভাগের এ মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত গায়ের জোরে নিজেদের মেয়াদকালে বলবৎ করতে পারলেও এ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যে জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? অযথা গা চুলকিয়ে রক্ত বের করার মধ্যে কী আনন্দ যে এ সরকার পায় বোঝা যায় না। তাই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, আওয়ামী সরকার কি ক্ষমতায় থাকার তিন বছরেই রাজনীতির মাঠে ভাদ্র মাসে হালের গরু হারাইয়াছে?

বদিউর রহমান :সাবেক চেয়ারম্যান এনবিআর

No comments

Powered by Blogger.