জেনেভা কাণ্ড: লেবার কাউন্সেলর ফেরত, লোকাল স্টাফের চাকরি ডিসমিস by মিজানুর রহমান
মানবজমিন-এর হাতে আসা রিপোর্ট বলছে- জেনেভাকাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত নজরুল ইসলাম জমাদার। তিনি সুইজারল্যান্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি। ঘটনার দিনে মাফলার পরিহিত ছিলেন নজরুল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে মরোক্কোর এক নারীকে বিয়ে করে বর্তমানে জেনেভায় থিতু হয়েছেন তিনি। তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। রিপোর্ট বলছে, এ ঘটনার দ্বিতীয় মাস্টারমাইন্ড হচ্ছেন শ্যামল খান। তিনি সুইজারল্যান্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার বাড়ি টাঙ্গাইল শহরে। বাংলাদেশ মিশনের কাছেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তিনি মুনসুন নামে ৬টি গ্রোসারি শপের মালিক। স্বর্ণ এবং ডলারের ব্যবসাও রয়েছে তার। ফ্রান্সের বর্ডারে তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রিপোর্ট মতে, আসিফ নজরুলকে হেনস্তার তৃতীয় পরিকল্পনাকারী হলেন খলিলুর রহমান। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সুইজারল্যান্ড শাখার আহ্বায়ক। তার বাড়ি নোয়াখালীতে। মানবাধিকার বিষয়ক একটি সংস্থার সঙ্গে জড়িত। তাছাড়া রু-দ্য পাকি এলাকায় সাজনা নামে প্রতিষ্ঠিত রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি। মিশনের কাছাকাছি ওই রেস্টুরেন্টে দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সবাই খেতে যান বলে রিপোর্ট মিলেছে।
উপদেষ্টার প্রটোকলে নিযুক্ত লেবার কাউন্সেলর এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ: ২৯ ব্যাচের অফিসার কামরুল ইসলাম। ২০২০ সালে জেনেভা মিশনে পোস্টিং পান। তার আগে তিনি প্রবাসী কল্যাণ সচিবের পিএস ছিলেন। গ্রামের বাড়ি বরিশাল অঞ্চলে। ডিএস র্যাঙ্কের ওই কর্মকর্তা উপদেষ্টার সমাপনী দিনেই প্রথম প্রটোকল করেন। তবে এটা তার জীবনের প্রথম প্রটোকল ডিউটি নয়। মানবজমিন-এর হাতে আসা তথ্যমতে, গণঅভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন যখন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী তখন জোর করে জেনেভায় শ্রম উইং খোলা হয়। যদিও সুইজারল্যান্ডে শ্রমিক পাঠায় না বাংলাদেশ। দেশটিতে যেসব বাংলাদেশি রয়েছেন তারা প্রত্যেকেই হোয়াইট কালার জব করেন। সেখানে লেবার উইং-এর কোনো প্রয়োজন নেই মর্মে আপত্তি জানিয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী পাল্টা যুক্তি দেন যে, জেনেভায় শ্রমিক না থাকলেও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র সদর দপ্তর রয়েছে। লেবার কাউন্সেলর এবং সেই উইংয়ের অন্যরা নাকি আইএলও অফিসের সঙ্গে খাতির বাড়াবে যাতে বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে জেনেভায় কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে না পারে। রিপোর্ট বলছে, আইএলও’র বিষয়গুলো রাজনৈতিক। সেখানে লেবার কাউন্সিলরের কোনো কাজই নেই। ফলে কোনো শ্রম কাউন্সেলর ওই বিল্ডিংয়ে পা-ও ফেলেন না। গত বছর ঢাকা থেকে একটি অডিট টিম যায় জেনেভায়। তারা দেশে ফিরে রিপোর্ট করে। সেই রিপোর্টে মন্তব্য ছিল- জেনেভায় শ্রম উইং-এর কোনো দরকার নাই। সেখানে উইং খুলে কেবলই সরকারি অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। তারপরও প্রবাসী মন্ত্রণালয় ওই উইং বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। স্মরণ করা যায়, যে শ্রম কাউন্সেলরকে ফেরানো হয়েছে কিংবা যে শ্রম উইং নিয়ে এত কথা সেটার উপদেষ্টা হচ্ছেন আসিফ নজরুল। তিনি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
জেনেভা বিমানবন্দরে আসিফ নজরুলের সঙ্গে কী ঘটেছিল: প্রায় দুই মিনিটের একটি ভিডিও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাল ওই ভিডিওতে দেখা যায়, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে ঘিরে রেখেছেন একদল লোক। তারা উপদেষ্টার সঙ্গে উত্তেজিত ভাষায় কথা বলছেন। তর্ক করছেন। বারবার তার দিকে তেড়ে আসছেন। ঘিরে ধরছেন, সামনে এগুতে দিচ্ছেন না। বলছেন, আপনি মিথ্যা বলেছেন। জানা যায়, জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গভর্নিং বডি এবং সংস্থাটির গুরত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার দেশে ফিরছিলেন উপদেষ্টা। দূতাবাসের প্রটোকলে তিনি গাড়িতে করে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিমানবন্দরে পৌঁছান। গাড়ি থেকে নামার পর হঠাৎ একদল লোক এসে উপদেষ্টাকে ঘিরে ধরে। তাকে বিরক্ত করতে থাকেন। উচ্চশব্দে কথা বলতে থাকেন। ভিডিওতে দেখা যায় এ সময় আসিফ নজরুল বলছেন, ‘আপনি গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন? এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনি অনেক খারাপভাবে কথা বলছেন, খারাপ ব্যবহার করছেন। আপনাদের ল্যাঙ্গুয়েজ এমন কেন? আপনারা আসেন, কথা বলবো। তখন হেনস্তাকারীরা বারবার তর্ক করতে থাকেন। তাদের একজন বলেন, আমরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। স্বাধীনতার পক্ষের লোক, আপনারা বিপক্ষের লোক। এরপর আসিফ নজরুল বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে যান। হেনস্তাকারীরা তখনো তার পিছু নেন। ‘পাকিস্তানি রাজাকার, বাংলাদেশ সরকার’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। আইন উপদেষ্টা দপ্তর সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, সেদিনের ঘটনায় বিব্রত উপদেষ্টা। ধাক্কাধাক্কিকালে তিনি পেটে আঘাত পেয়েছেন। উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে হেনস্তার ঘটনায় সরকার জেনেভাস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল। রাষ্ট্রদূত তারেক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বিস্তারিত পাঠিয়েছেন। উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. শামছুদ্দীন মাসুম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আইন উপদেষ্টা মিশনের গাড়িতেই বিমানবন্দরে যান। সেখানে তার সঙ্গে একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ভিডিওতে তাকেও দেখা গেছে। প্রোটোকল নিয়েই তিনি সেখানে গেছেন। তবে আগে থেকে তার বিমানবন্দরে উপস্থিতির তথ্য দেয়া ছিল কি না সেটা আমরা জানি না।’
No comments