জনগণকে সংগঠিত করে রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সংস্কার সম্ভব

জনগণকে সংগঠিত করে রাজনৈতিক তৎপরতা ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের সংস্কার করতে হবে। ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ ও সংস্কার ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এমন মত পোষণ করেছেন আলোচকরা। বুধবার বিকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাসদ (মার্ক্সবাদী) এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। রাষ্ট্র সংস্কারে ছয়টি বিষয় নিয়ে এতে বিশদ আলোচনা করা হয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আমাদের দেশে যত নীতিমালা করা হয়েছে একটাও বাংলা ভাষায় লেখা না। সবগুলো ইংরেজি ভাষায় লেখা। এটা করে জনগণকে তার স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশের যতগুলো নীতিমালা মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত সবগুলো বাংলা ভাষায় লিখতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত যারা আছেন, তাদের সবাইকে পাবলিক এডুকেশন ও পাবলিক হেলথ কেয়ার ব্যবহার করতে হবে। তাদের ছেলেমেয়েরা যেন ব্যয়বহুল স্কুল ছেড়ে দেশের সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা নেন এবং সদর হাসপাতালগুলোতে সেবা গ্রহণ করেন, সেটা বাধ্যবাধকতা করা। তবেই এসব প্রতিষ্ঠানগুলো প্রসিদ্ধ হবে। এটাকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দিতে হবে।

আনু মুহাম্মদ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সব থেকে কম খরচ করা হয় শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে। পুরো অর্থনৈতিক নীতিমালার মধ্যে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি বলেন, ’৭১কে ’২৪-এর মুখোমুখি দাঁড় করানো বা বিপরীতে নিয়ে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রবণতা। কী কারণে ’৭১ থেকে ’২৪ বিচ্ছিন্ন হবে? ’৭১ এই জনপদের মানুষের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধের জায়গা, অভ্যুত্থানের জায়গা। জনগণের আত্মবিশ্বাসের জায়গা। এখনো ’৭১ থেকেই মানুষ অনুপ্রেরণা পায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও আমরা একাত্তরের আওয়াজ নানাভাবে শুনেছি।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কারণে, চাপে সংবিধানে অনেকগুলো মৌলিক অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানে আছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার রাষ্ট্র বহন করবে। মুক্তিযুদ্ধের কারণেই এই অধিকারগুলো সংবিধানে আছে। এসবের সঙ্গে ’২৪-এর অর্জন যোগ করতে হবে। কোনো কিছু বিয়োগ করা যাবে না।  

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দু’টি বড় সাফল্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে একটা অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতন হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজধানী সহ সারা দেশে বিভিন্ন প্রস্তাব হচ্ছে, আলোচনা, বিতর্ক হচ্ছে এটা দ্বিতীয় সাফল্য।

অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, আন্দোলনের মধ্যদিয়ে মানুষের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন সরকারের মধ্যে পড়েছে, এটা আমার মনে হয় না। সরকারের ভূমিকা এই প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে- এটা বলা যায় না। দেয়ালের গ্রাফিতিগুলোর মধ্যে যে আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছে সেটা সরকারের ভূমিকার চেয়ে অনেক বেশি পরিণত মনে হয়েছে। দেয়ালে যেমন অন্তর্ভুক্তিমূলক অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সরকারের ভূমিকার মধ্যে আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি না।

সরকার ও জনসাধারণের উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের লোক পরিচয় পাওয়া গেলে, তাদের উপরে হামলা করলে- তাদের পতন হবে না। এতে আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা আরও বাড়বে। এতে গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে বিরোধিতা করা হবে। আপনারা যদি এমন কাউকে চেনেন যারা হামলা,  বিদ্বেষী তৎপরতা চালাচ্ছে তাহলে মনে করবেন তারাই পতিত স্বৈরাচারের দোসর, সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। তাদের থামানোটা আপনাদের অন্যতম বড় দায়িত্ব।

লেখক, গবেষক ও অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, প্রধান সমস্যা সংবিধান নয়, নির্বাচন কমিশনও নয়। জনগণের সংগঠিত চাপ না থাকলে আজকে আমরা এই সভা করতে পারতাম না।

তিনি বলেন, আমাদের যদি প্রশাসনকে জনগণের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই তাহলে তাদেরও নির্বাচনের মধ্যদিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলের ভেতরে যদি গণতন্ত্র না থাকে তবে আপনি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক চর্চা করতে পারবেন না।

এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, শিক্ষা যদি একটি জাতীয় সম্পদ হয় তাহলে এটা বাজারে প্রতিযোগিতার বিষয় হতে পারে না। অন্য দেশে ৬ বছর প্রাথমিক ও ৬ বছর মাধ্যমিক শিক্ষা যদি অপরিহার্য হয়, তাহলে সেটা কেন আমরা বিনা পয়সায় দেবো না। শিক্ষায় গণতন্ত্র মানে হলো- জাতীয় খরচে মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পাবে। একজন শিশু সাবালক হওয়া পর্যন্ত তার সব ধরনের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। আমরা এটি শুধু তার পরিবারের উপর বণ্টন করে দিয়েছি।

নিউএজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, এই সরকারের মধ্যে অধিকাংশই একেবারে বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া এরা কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি না। তাদের জীবনে তারা স্বল্পমাত্রায়ও কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। কিন্তু তাদের আমরা যে দায়িত্ব দিয়েছি বা তারা যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সেটা পুরোটাই একটা রাজনৈতিক ব্যাপার। আর যাদেরকে চিনি না তাদের সম্পর্কে আমার ন্যূনতম ধারণা নাই। এই অচেনা লোকেরা কী করবেন আর কী করবেন না তা নিয়ে একটা উদ্বেগের মধ্যে আছেন। যাদের চিনি তারা তো উদ্বেগের মধ্যে আছেনই।

তিনি আরও বলেন, সংবিধানে পরিবর্তন আসবে কি আসবে নাÑ এটা নির্ভর করে এখন যারা ক্ষমতায় আছেন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা প্রয়োগের উপরে। আমরা মনে করি, আমাদের সবাইকে রাজনৈতিকভাবে তৎপর হতে হবে। জনগণকে সংগঠিত করে চাপ প্রয়োগ করেই সংস্কার সম্ভব।

লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, সব রাজনৈতিক দলগুলোকে এক জায়গায় না এনে সংস্কার বাস্তবায়ন করা যাবে না। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এটি নিশ্চিত।

বাসদ (মার্কসবাদী) সভাপতি মাসুদ রানার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.