বিদেশ যাওয়া হলো না স্বজনের by ফাহিমা আক্তার সুমি
আবুল হাসান স্বজনের ভাই আবুল বাশার অনিক মানবজমিনকে বলেন, স্বজনের বিদেশে যাওয়ার সব কাগজপত্র রেডি হয়েছিল শুধু ভিসার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। অভাবের কারণে বেশিদূরে পড়াশোনা করতে পারেনি। দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে বাবা স্ট্রক করে এরপর বন্ধ হয়ে যায় ওর পড়াশোনা। আমিও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে আর পড়তে পারিনি। বাবা ব্যবসা করতেন অসুস্থ থাকায় সংসারের হাল ধরতে দুই ভাই কোম্পানির মার্কেটিংয়ে কাজ করতাম। স্বজনই পরিবারের জন্য বেশি কিছু করতো যা আয় করতো সবই সংসারের পেছনে খরচ হতো। পুরো পরিবারটিকে সে ধরে রেখেছিল।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমি আমার ভাই ৫ই আগস্ট একসঙ্গে আন্দোলনে গিয়েছিলাম। প্রতিদিনই একসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমরা অংশ নিতাম। ঘটনার দিন আমরা বন্দর থেকে এগারো জন অন্দোলনে অংশ নিতে নারায়ণগঞ্জ যাই। পরে সকাল দশটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখি পুলিশ, বিজিবি, র্যাবের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছে। পরে বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া থেকে চলে যায়। এরপর আমরা চাষাড়া চত্বর দখলে নেই। দুপুরের দিকে চাষাড়া চত্বর থেকে খানপুর রোডের দিকে আমরা একটি মিছিল নিয়ে যাই। সেখান থেকে আমার ভাই ছাড়া বাকি দশজন অর্ধেক গিয়ে পেছনের দিকে চলে আসি। স্বজন সামনে থাকায় আমরা চলে এসেছি এটি খেয়াল করেনি, আমাদেরও খেয়াল ছিল না যে সে সেখানে ছিল। চাষাড়া চত্বরে আসার দশ মিনিট পর শুনতে পাই স্বজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে গুলি করে। গুলিটি লেগেছিল বুকের বাম পাশের কিছুটা নিচের দিকে লেগে কোমরের দিকে বিদ্ধ হয়। পরে ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ই আগস্ট বিকাল পাঁচটার দিকে মারা যায়। এর আগে দীর্ঘ সাড়ে ৭ ঘণ্টা স্বজনের একটি মেজর অপারেশন হয়েছিল।
আবুল বাশার অনিক বলেন, যখন আমরা একটি মিছিল থেকে চাষাড়ার দিকে চলে আসি তখন এলাকার এক বড় ভাই এসে বলে, স্বজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে তাকে নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সেদিন যাতায়াতের জন্য কোনো যানবাহন ছিল না অনেক কষ্ট করে কোনোমতে একটি রিকশা নিয়ে যাই। আমি যখন ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে গেটের সামনে গিয়ে পৌঁছাই তখনই আমার ভাইকে বহন করা অ্যাম্বুলেন্সটি ছেড়ে দেয়। দৌড়ে গিয়ে রানিং অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ি। আমরা যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে যাই তখন দেখি আশপাশে থাকা প্রতিটি ভবনের ছাদ থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ছে। রাস্তার অবস্থা তো আরও ভয়াবহ খারাপ ছিল। পুলিশ আর আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা একের পর এক গুলি করছে। ফ্লাইওভারে আমাদের অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কোনো যানবাহন ছিল না। আমাদের বহন করা অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শোনে তখন পুলিশ অ্যাম্বুলেন্সটি লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুঁড়তে থাকে। কতোটা নিষ্ঠুর হলে মানুষ এমন করতে পারে। অ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ন্ত্রণ হারাতে গিয়েছিল সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়েছে সেদিন। চালক কৌশলী এবং সাহসী থাকায় দ্রুতগতিতে টেনে চলে যায় মেডিকেলের দিকে।
সেদিনের ঢামেকের ভয়াবহ দৃশ্যর বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, বিকাল সাড়ে তিনটায় অ্যাম্বুলেন্স থেকে ঢাকা মেডিকেলে নামি তখনের পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। এ পরিস্থিতি দেখার মতো ছিল না। মিনিটে তিন-চারটি করে গুলিবিদ্ধ আহতদের নিয়ে এসেছিল। ঢাকা মেডিকেলে রক্তের বন্যা ছিল সেদিন, মেঝেতে পা রাখার কোনো জায়গা ছিল না। আমরা সজলকে যখন নিয়ে যাই তখন লাশের উপর থেকে ভিতরে যেতে হয়েছে এমন অবস্থা। এদিকে ঢামেকের মর্গে কোনো জায়গা না থাকায় পুরো বারান্দায় ভরা ছিল লাশের স্তূপ। লাশগুলো মেঝেতে পড়ে ছিল তাদের কোনো স্বজনকেও দেখিনি তখন। সন্ধ্যার সময় স্বজনকে অপারেশন থিয়েটারে দেয়া হয় এবং রাত তিনটার দিকে তাকে বের করা হয় থিয়েটার থেকে। আমি পাঁচ মিনিটের জন্য ভাইয়ের কাছে যাই। যখন তার জ্ঞান আসে তখন স্বজন প্রথমেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শেখ হাসিনার পতন হয়েছে কিনা?’ আমি তাকে একটু বিরক্তির সুরে বলেছিলাম এই অবস্থায় এগুলো চিন্তা করার দরকার নেই, তোমাকে নিয়ে আমরা সারাদিন দৌড়ের মধ্যে ছিলাম এগুলো খবর রাখতে পারিনি। পরে স্বজন আমাকে খবর নিয়ে সরকার পতনের খবরটি জানাতে বলে। আমি বাইরে এসে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে জেনে একঘণ্টা পরে স্বজনের কাছে গিয়ে বলি, হ্যাঁ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়েছে। এই কথাটি শোনামাত্র স্বজন একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠে- ‘আলহামদুলিল্লাহ’। এটি ছিল আমার ভাইয়ের শেষ হাসি এমন হাসি আমি তাকে আর কোনোদিন হাসতে দেখিনি। এই মুহূর্তটা আমি এখনো ভুলতে পারছি না। ওইদিন বিকালের দিকে ভাই মারা যায়। ময়নাতদন্ত ছাড়া অনেক জোড়াজুড়ি করে আমার ভাইয়ের লাশটি নিয়ে আসি হাসপাতাল থেকে বাড়িতে। ৭ই আগস্ট তাকে দাফন করা হয়। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ২৩শে আক্টোবর ময়নাতদন্তের জন্য স্বজনের মরদেহটি কবর থেকে তোলা হয়।
No comments