স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ
গতকাল দুপুরে বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুককে সঙ্গে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। হাসপাতালে চতুর্থ তলায় ভর্তিদের দেখে নিচে নেমে যাওয়ায় তৃতীয় তলায় থাকা আহতরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তারা নিচে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন।
এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গাড়িতে কিল-ঘুষি মেরে গাড়ির উপরে ওঠে দাঁড়ায় একজন। কেউ আবার গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে সারা কুক অন্য একটি গাড়িতে চেপে স্থান ত্যাগ করলেও আন্দোলনকারীদের রোষানলে পড়েন উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। পরে হাসপাতালটির চিকিৎসক, নার্স ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় উপদেষ্টা বিকল্প পথে হাসপাতাল ত্যাগ করলেও সামনের মূল সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন আহতরা।
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের জন্য হাসপাতালটির তিনতলা ও চারতলায় দুইটা আলাদা আলাদা ডেডিকেটেড ওয়ার্ড খোলা হলেও তারা শুধুমাত্র চতুর্থ তলার পুরুষ ওয়ার্ডের রোগীদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতাল ত্যাগ করতে চান। কিন্তু অপেক্ষারত তিনতলায় চিকিৎসাধীন জুলাই বিপ্লবের রোগীরা উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানাতে চান। এক পর্যায়ে রোগী ও তাদের স্বজনেরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে চলে আসেন। তখন গণমাধ্যমকর্মীরা উপদেষ্টা ও সারাহ কুককে কিছু বলার অনুরোধ করে। কিন্তু তারা কথা না বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আহতরা এগিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের কথাও শোনেনি। এক পর্যায়ে উপদেষ্টার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকারা আহতদেরসহ সকলকে পেছনের দিকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে নূরজাহান বেগমকে তার গাড়ির কাছে নিয়ে যান। এতেই বিক্ষোভ শুরু করে হাসপাতালটিতে ভর্তি জুলাই-আগস্টে আন্দোলনে আহত ও তাদের স্বজনরা। এসময় হাসপাতালের চিকিৎসকরা আন্দোলনকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো কথা না শুনে বিক্ষুব্ধ জনতার কেউ কেউ গাড়ির জানালার কাঁচে কিল-ঘুষি মারা শুরু করেন। কেউ গাড়ির ওপরে উঠে দাঁড়ান। গাড়ির চালককেও বাইরে বেরিয়ে আসতে বলেন কেউ কেউ। উপদেষ্টার গাড়িকে ঘিরে যখন এতসব কাণ্ড তখন গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে অন্য গাড়িতে চেপে চলে যান নূরজাহান বেগম।
আর বিক্ষুব্ধদের পাশ কাটিয়ে পুলিশ প্রটোকল নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেন সারা কুক। বেলা দেড়টার দিকে চিকিৎসক-নার্স ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় উপদেষ্টার গাড়ি হাসপাতাল ত্যাগ করলেও একটি পুলিশের গাড়ি আটকে দেন আহতরা। প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পঙ্গু হাসপাতালের ভেতর চলা বিক্ষোভ শেষে তারা হাসপাতালের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে সকল যান চলাচল বন্ধ করে দেন। খবর পেয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনিস্টিটিউটসহ জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হয়ে আশপাশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেয়া অন্য রোগীরাও পঙ্গু হাসপাতালের সামনে এসে আন্দোলনে যোগ দেন। মুহূর্তেই পুরো এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় এলাকাটির আইনশৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা তাদের বুঝিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করলেও তারা বিক্ষোভ বন্ধ করেনি। এরপর ঘটনাস্থলে সেনা সদস্যরা গিয়ে বিক্ষোভকারীদের রাস্তা ছেড়ে হাসপাতালে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। তখন আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে হুইলচেয়ারে বসে আহত মো. মাসুম বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এসে তাদের সঙ্গে দেখা না করা পর্যন্ত তারা রাস্তা ছাড়বেন না। তিনি বলেন, এখানে আমরা অন্তত ৮৪জন ভর্তি হয়ে হাসপাতালের তিনতলা ও চারতলায় চিকিৎসা নিচ্ছি। কিন্তু স্বাস্থ্য উপদেষ্টা শুধুমাত্র চার তলার রোগী দেখে চলে গেছেন। আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে উপদেষ্টা হয়েও তিনি আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। আমরা তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেও আমাদের কথা শোনা হয়নি। উল্টো আমাদেরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা তিনমাস ধরে হাসপাতালে পড়ে থাকলেও আজ পর্যন্ত আমাদের কেউ খোঁজ নেয়নি। এক লাখ টাকা করে দেয়ার কথা থাকলেও আমরা তার কিছুই পাইনি। আমরা এসবের প্রতিকার চাই। তাই আমাদের এখানে এসে কথা না বলা পর্যন্ত আমরা রাস্তা ছাড়বো না।
জুলাই বিপ্লবে আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালের তিনতলার বি-ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেয়া মো. হাসান নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের এক একটা ওয়ার্ডে ৪৮ জন করে চিকিৎসা নিচ্ছে। কিন্তু ওনারা ওনাদের পছন্দের বিদেশি পাঁচজন সাংবাদিক নিয়ে এসেছেন এবং আমাদের দেশীয় কোনো সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়নি। আমরা এতজন আন্দোলনে আহত হয়ে চিকিৎসা নিলেও তারা দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে চলে গেছেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। আমাদের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে আমরা কথা বলতে গেলেও বাধা দেয়া হয়েছে। অশ্রুশিক্ত হয়ে তিনি বলেন, আমাদেরকে সামান্য ট্রিটমেন্ট দিয়ে তিন মাস হাসপাতালে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার পায়ে নয়টি অপারেশন করার পরেও এখনো সুস্থ হতে পারিনি। কবে হবো তার ঠিক নেই। অপরদিকে আহতদেরকে এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে বললেও এখনো আমরা কিছুই পাইনি। শুধু চিকিৎসাই ফ্রি করা হচ্ছে। আমাদের কী অন্য কোনো খরচ লাগে না? আমাদের পরিবার আমাদের পেছনে খরচ করতে করতে সব শেষ করে ফেলেছে। দেশের জন্য এত ত্যাগ করে আমরা কী পেলাম। আজ আমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যারা সরকার গঠন করেছে তারা এখন আমাদেরকেই চিনে না। আমরা চাই তারা সবাই আমাদের সঙ্গে কথা বলুক। আমাদের জন্য ঘোষণা করা সেই এক লাখ টাকা দিক এবং যাদের যাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন তাদেরকে সেভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া হোক। ১৯শে জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ মো. শাহীন নামে আরেক জন বলেন, আজ পর্যন্ত আমরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। সেই কথাই বলতে গিয়েছিলাম উপদেষ্টাকে। নিজেদের মানুষ মনে করে তার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের কথা তো শুনলেনই না উল্টো অপমান করলেন। আমরা দেশের জন্য নিজেকে বলি দিয়ে আজ চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব। আমরা এর প্রতিকার চাই। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে এসে বিক্ষোভে যোগ দেয়া গত ৪ই আগস্ট চোখে গুলিবিদ্ধ কিশোরগঞ্জ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী শেখ সাদী বলেন, আমার বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। আমি গত ৬ই আগস্ট থেকে চক্ষু বিজ্ঞানে ভর্তি। আমার ডান চোখে এখনো গুলি ঢুকে আছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, আমরা সর্বোচ্চ ট্রিটমেন্ট দিয়েছি।
এদেশ থেকে আমার চোখের গুলি বের করা সম্ভব নয়। বিদেশে যেতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ কোনো আলাপ করলো না। আমাদের শুধু ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এই ওষুধ ছাড়াও যে একটা রোগীর কতো খরচ লাগে সে হিসাব কেউ নেয় না। রোগীর সঙ্গে যেই স্বজনরা থাকে, তাদের খরচ কেউ দেয় না। এমনকি এক লাখ টাকা করে দেয়ার কথা তাও আমরা পাইনি। আমাদের অনুদানের টাকা পর্যন্ত মেরে খাওয়া হচ্ছে। আমরা এসবের প্রতিকার চাই। আমাদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সকল দাবি পূরণ করতে হবে। রাত সাড়ে ৭টার দিকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। আন্দোলনকারীরা স্নিগ্ধকে তাদের পাশে অবস্থান করার অনুরোধ করেন।
ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জিয়াউল হক বলেন, আমরা দুপুর থেকে অনেকবার আহত আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তাদেরকে বারবার রাস্তা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেছি। কিন্তু কোনোভাবেই তারা রাস্তা ছাড়তে রাজি হননি।
No comments