সন্ত্রাস ‘পরিকল্পিত’, ঠেকানোর পরিকল্পনা কই?

১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর ছয়জন তরুণ ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কে ভারতীয় দূতাবাসে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করে কিছু দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। এটা ছিল একটা সুইসাইড স্কোয়াড। স্কোয়াডের চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। দুজন আহত অবস্থায় ধরা পড়েন এবং পরে জেল খাটেন। অভিযানটি ব্যর্থ হয়। তবে এই অভিযানের পরিকল্পনাকারী পরবর্তী সময়ে সন্ত হয়ে যান। এ ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটল ১ জুলাই রাতে গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয়। জঙ্গি হামলার ধরন একই রকম। তবে লক্ষ্য ভিন্ন। এখানে ছিল ছয় (সরকারি ভাষ্য) অথবা আইএসের দাবি অনুযায়ী পাঁচ তরুণের একটা সুইসাইড স্কোয়াড। তাঁরা সবাই মারা গেছেন। তবে ঘটনাক্রম থেকে মনে হয়, তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তাঁরা শুধু হত্যার উদ্দেশ্যে গিয়ে থাকলে হয়তো এলোপাতাড়ি গুলি করে সবাইকে মেরে ত্বরিতগতিতে ভেগে যেতে পারতেন। কিন্তু শুধু হত্যাকাণ্ড ঘটানো তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁরা চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম হতে। সেটা হয়েছে। শুধু দেশি লোক মারলে এতটা প্রতিক্রিয়া হতো না, যতটা হয়েছে বিদেশি মারার মধ্য দিয়ে। হত্যার পদ্ধতিটিও লক্ষণীয়। জবাই করে খুন করার মধ্যযুগীয় পদ্ধতিটি বিশেষ একটা ডকট্রিনের সমার্থক। এই হত্যাপদ্ধতি থেকেই তাঁদের পরিচয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। তাঁরা বুঝেশুনেই এই কাজে হাত দিয়েছিলেন। জানতেন ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু, ক্রসফায়ার। তাঁরা কীভাবে মারা পড়েছেন, তা এখনো জানা যায়নি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জঙ্গিবাদ নতুন কোনো উৎপাত নয়। আগে সমাজতন্ত্রের নামে, বিপ্লবের নামে মানুষ মারা হতো। এটা যে একটা অতি পুণ্যের কাজ, সেটা প্রচার করার লোকের অভাব ছিল না। এখনো নেই। সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের ধরনটাও প্রায় একই রকম। এখানেও আছে আদর্শের চাদর। ‘ইসলাম’ প্রতিষ্ঠাই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। পৃথিবীতে এযাবৎ যা কিছু মানুষকে প্রণোদনা দিয়েছে, তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী হলো ‘মতাদর্শ’ বা ডকট্রিন। অদৃশ্য সুতোর নাটাইটা আছে হ্যামিলিনের কোনো বাঁশিওয়ালার হাতে। সেই সুতোর টানে একদল তরুণ ছুটছে এবং হারিয়ে যাচ্ছে চিরদিনের মতো। একসময় মনে করা হতো, বেশি জমির মালিক একজনকে ধরে জবাই করে দিলে বিপ্লব সমাধা হবে। অনেক মানুষ এটা বিশ্বাস করত। সে রাজনীতি এখন আর নেই। মানুষ এটা গ্রহণ করেনি। গলা কাটার রাজনীতিকেরা এখন সংসদ ভবনে ঢোকার জন্য আঁকুপাঁকু করেন। মানুষ মেরে ‘আদর্শ’ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি এখন এমন একটা গোষ্ঠীর হাতে, যাকে শুধু ‘মৌলবাদী’ বলে গালি দিয়ে তাড়ানো যাবে না। কেন এবং কীভাবে এই মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়েছে, তার অনুসন্ধান দরকার। তবে এটা একটা ভিন্ন আলোচনা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ১২ ঘণ্টার জিম্মি নাটক শেষ হয়েছে। পুলিশ, বিজিবি, র্যা ব-সোয়াট—অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আসর গুলজার করে দিলেন। শেষমেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলকেই তলব করতে হলো। তারা কয়েক মিনিটের মধ্যে ‘নিয়ন্ত্রণ’ প্রতিষ্ঠা করল।
এতে বোঝা যায়, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সক্ষমতা একমাত্র সেনাবাহিনীরই আছে। অন্যদের নেই। যাদের নেই, তাদের তাহলে কী জন্য রাখা, এ প্রশ্ন স্বভাবতই উঠবে। তাদের পেছনে খরচ তো কম হচ্ছে না? হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মেরে ফেলা আর সত্যিকার যুদ্ধ জয় করা এক জিনিস না। ‘হলি আর্টিজানে’র ঘটনায় বেশ বোঝা গেল, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কত অসহায়। যে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হলেন, তাঁদের জন্য আমার শোক ও সমবেদনা রইল। কিন্তু তাঁরা যেভাবে এর মোকাবিলা করতে গেলেন, তাতে পেশাদারত্বের কোনো ছাপ ছিল না। হামলাকারীরা তো কোনো ছিঁচকে সন্ত্রাসী নয় যে ক্যাশ কিংবা মোবাইল ফোন ছিনতাই করার জন্য রেস্তোরাঁয় ঢুকেছে। জন-আলোচনায় যেসব প্রশ্ন উঠেছে, তার একটা হলো ছয়জন তরতাজা তরুণ শহরের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকায় এতসব আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা ও তলোয়ার নিয়ে ঢুকলেন কী করে? তাঁরা কি একসঙ্গে ঢুকেছেন? অস্ত্রশস্ত্র কি আগেই পাঠানো হয়েছিল? যদি তা-ই হয়, তাহলে কীভাবে? গুলশানের সব রাস্তার প্রবেশমুখে পুলিশের ব্যারিকেড থাকে। এসব জায়গায় অনেক নিরীহ মানুষ ভোগান্তির শিকার হন। এঁরা তাহলে এতসব জিনিসপাতি নিয়ে কী করে ঢুকলেন? এটা কি পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা, নাকি ওই তরুণদের উন্নত প্রশিক্ষণ? বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বোঝাই যায়, সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য হাসিলের জন্য যতটা মরিয়া ছিল, পুলিশ তার কর্তব্য পালনে ততটা নজর দেয়নি।
এখন পুলিশ বাহিনী আর আগের মতো নেই। তাদের উন্নতমানের অস্ত্র, পোশাক, যানবাহন এবং প্রযুক্তি দেওয়া হচ্ছে। একই কথা র্যা বের জন্যও প্রযোজ্য। টিভি ক্যামেরার সামনে তারা বেশ সরব, কেউ কেউ প্রগলভ। কিন্তু নাগরিকেরা চান কাজ, নিরাপত্তা। হয়তো আরও অনেক সময় লাগবে। বর্তমানে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, যে গুটিকয়েক ব্যক্তি বিশেষ সুরক্ষা পান, তাঁরা ছাড়া দেশের কোনো মানুষ নিরাপদ নন। যে কেউ, যেকোনো দিন, যেকোনো জায়গায় আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি গত শনিবারও দুজন আক্রান্ত হয়েছেন। একজন পুরোহিত সাতক্ষীরায়, আরেকজন মন্দিরের সেবায়েত কিশোরগঞ্জে। গুলশানের ঘটনায় ওটা চাপা পড়ে গেছে। যেমন নাকি মিতু হত্যার ঘটনায় তনু চাপা পড়েছে। এখন গুলশানের ঘটনায় মিতুও চাপা পড়বে। অনেক বছর ধরে চলে আসা ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি এবং তার ফলে সৃষ্ট ধর্মান্ধতার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে গোটা সমাজকে। লে জে হু মু এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানিয়ে ভেবেছিলেন, এমন একটা বিধান দিয়েছি, যা কেউ আর বদলাতে পারবে না। যে-ই বদলাতে যাবে, তাকেই ইসলামবিরোধী হিসেবে দেখা হবে। আর ইসলামবিরোধী রাজনীতি এ দেশে চলবে না। এরশাদ বুঝেশুনেই এ কাজটি করেছিলেন। তার ফল হয়েছে মারাত্মক। এ দেশে একটার পর একটা সরকার এসেছে। তারা সুশাসন দেয়নি। মানুষের ক্ষোভের সুযোগ নিচ্ছে তৃতীয় শক্তি। শোনা যায়, এ দেশ থেকে ১০ হাজার লোক আফগানিস্তানে তালেবানদের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। তারা তো নিজেরাই এক-একটা জীবন্ত বোমা। মনে হয় এদের সংখ্যাই দিন দিন বাড়ছে।
আমরা এ দেশে বাংলা ভাইদের উৎপাত দেখেছি। তখন জেএমবির কথা শোনা যেত। তারপর শোনা গেছে হিযবুত তাহ্রীর, আল্লাহর দল, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, আল-কায়েদা এবং সবশেষে আইএস। এসব প্রবণতার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। তারা সবাই আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করতে চায়। মনের মধ্যে যদি একবার এ ধরনের বিশ্বাস ঢুকে যায়, বক্তৃতা দিয়ে তা গলানো যাবে না। মোনেম খান কিংবা এরশাদের আমলে এ দেশে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, তার পেছনে রাষ্ট্রশক্তির উসকানি ছিল। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আমরা জেএমবির উত্থান দেখেছি। সরকার এটাকে বলেছিল ‘মিডিয়ার তৈরি’। পরে দেখা গেল সরকারেরই কেউ কেউ একে প্রশ্রয় দিয়েছেন। দেশে ধর্মীয় চরমপন্থা দিন দিন বাড়ছে। চারদলীয় জোট সরকারের বড় বড় সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছিল। যেমন—উদীচী ও ছায়ানটের অনুষ্ঠানে, সিপিবির জনসভায়, সিনেমা হলে, গির্জায়। গুলশানের রেস্তোরাঁয় সাম্প্রতিক হামলায় মনে হয় ওই প্রবণতাটি আবার ফিরে এসেছে। সরকারের আকলমন্দ মন্ত্রীরা এত দিন বলে এসেছেন, এসবই হচ্ছে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। কিন্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেই চলেছে। কোথায় এর শেষ, কেউ জানে না। কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করে?
গোয়েন্দা ব্যর্থতা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে গোয়েন্দা সংস্থার অক্ষমতার বিষয়টি টের পাওয়া গেছে। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময়ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা খুন হওয়ার পর কয়েকটি দেশ থেকে আশঙ্কা জানানো হয়েছিল, বিদেশিরা বড়সড় কোনো হামলার শিকার হতে পারেন। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বরাবর একই কীর্তন গেয়েছেন, এখানে আইএস নেই। আইএস তো কোনো সংস্থা নয়। এটা একটা কনসেপ্ট, একটা প্রবণতা। আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতেই একটা বড় ঘটনা ঘটে গেল। তাহলে গরিব মানুষ খাজনার টাকা দিয়ে এই সব সাদা হাতি কেন পুষবে? গুলশানের ঘটনার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘এই ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত।’ এটাই লাখ কথার এক কথা। সন্ত্রাসীরা আটঘাট বেঁধেই কাজটা করেছে। তাদের পরিকল্পনায় কোনো ছিদ্র নেই। তাদের মোকাবিলা করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিকল্পনাটা কী, তা জানতে পারলে আমরা একটু আশ্বস্ত হতে পারতাম।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.