পুরনো নীতির সঙ্গে নতুন নীতির সংঘর্ষের বলি সুজাতা
ভারতের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে ভালো কাজের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল
পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে নীতির
প্রশ্নে নানা বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন সুজাতা সিং। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদীর নীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে প্রযোজনীয়
সংশোধনে অনীহা দেখিয়েছিলেন বলে সুজাতা সিংয়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। গত কয়েক মাসে সেই বিরোধ তীব্রতা পেয়েছে ইসরায়েল ও
ডেনমার্কের প্রশ্নে। শেষ পর্যন্ত প্রায় মধ্যরাতের এক বৈঠকে তাকে অপসারিত
করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইচ্ছেতেই। রাজনৈতিক
পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রচলিত বেশ
কয়েকটি নীতি ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের
অখুশির কারণ হয়েছিলেন তিনি। আর তাই পররাষ্ট্রসচিব বদলের পাশাপাশি
পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও প্রধানমন্ত্রী বার্তা দিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। একটি
সূত্রে বলা হয়েছে, বারাক ওবামার সফল ভারত সফরের ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই সুজাতা
সিংকে সরিয়ে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সৌহার্দ্যের নতুন বার্তা দেয়া
হয়েছে। আর তাই কংগ্রেস এই অপসারণের সঙ্গে ভারতীয় কুটনীতিক দেবযানী
খোবড়াগাড়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরে আক্রমন শানিয়েছে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে
নিযুক্ত ভারতীয় কুটনীতিক দেবযানী ভিসা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই সময়
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে সুজাতা সিং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর
অবস্থান নিয়েছিলেন। দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা তুলে নেয়ার
পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এতে অখুশি ছিল মার্কিন সরকার। আর তাই ওবামার ভারত
সফরের আগেই সুজাতা সিংকে সরে যাবার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে।
তাকে সম্মানসূচক সাংবিধানিক পদ দেবার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সুজাতা
তিন দিনের জন্য ভাবনার সময় নিয়েও পরে পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন বলে সাউথ
ব্লক সূত্রে জানানো হয়েছে। ওবামার ভারত সফর পর্বে জয়শঙ্করকেই
প্রধানমন্ত্রী প্রাধান্য দেন, উপেক্ষা করেন পররাষ্ট্র সচিবকে। তবে সর্বশেষ
যে ঘটনায় সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তথা প্রধানমন্ত্রীর
বিরোধ তীব্র হয়েছিল সেটি ছিল ভাইব্র্যান্ট গুজরাট সম্মেলনে ডেনমার্কের
প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রশ্নে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী
ব্যাক্তিগতভাবে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। গুজরাট সরকার ভাইব্র্যান্ট গুজরাট
সম্মেলনে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীকে অতিথি করতে চেয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীরও তাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রকের আপত্তিতেই তা
সম্ভব হয়নি। কিম ডেভি সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগে ডেনমার্কের
সঙ্গে কোনও উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ না রাখার নীতিতে পররাষ্ট্র সচিব অবিচল
ছিলেন। এর ফলে ডেনমার্কের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আলোড়ন তৈরি হয়।
ইসরায়েলের প্রশ্নেও পররাষ্ট্র মন্ত্রক পুরনো অবস্থানে অনঢ় থেকে ব্রিকস
সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে ইসরায়েল সম্পর্কে সমালোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু মোদী
সরকারের আসার পর ইসরায়েলকে ভারতের সহযোগীদের তালিকায় প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
একই ভাবে ভারতের পুরনো অবস্থান অনুযায়ী রাষ্ট্রসংঘের মানবিক অধিকার রক্ষা
সম্মেলনে ভারত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। ভোটদানে অনুপস্থিত থেকে
মুখরক্ষার চেষ্টাও করেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রক। অথচ নতুন সরকারের নীতিই হচ্ছে
ইজরায়েলের প্রতি খানিকটা নরম মনোভবাব নিযে চলা। এই সব ঘটনাকে সামাল দিতে
স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী নিউইয়র্কে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন
নেতানুয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আরও অভিযোগ ছিল,
মোদীর জাপান সফরের সাফল্যকে এগিয়ে নিযে যাওয়ার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র সচিবের
দ্বিধা ছিল । এই সব কারণেই গত মাস ছয়েক ধরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নতুন
সরকারের নীতির সঙ্গে পুরনো অবস্থানের ব্যাপক ফারাকই অচলাবস্থা তৈরি করেছিল।
তবে বিদায় নেবার মুহূর্তে অপসারিত পররাষ্ট্র সচিব তার সহকর্মীদের কাছে
পাঠানো বার্তায় স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠান তৈরিতে কোনও ব্যক্তি
গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিতে পারেন। কিন্তু ব্যক্তি কখনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড়
হতে পারেন না। তবে রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহল মনে করছেন, জয়শঙ্করকে নতুন
পররাষ্ট্র সচিব করে প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্র মন্ত্রকে নিজের কর্তত্ব
প্রতিষ্ঠা করলেন। জয়শঙ্করের কাজে নরেন্দ্র মোদী অনেক দিন ধরেই খুশি।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদী যখন চীন সফর করেছিলেন তখন জয়শঙ্কর চীনে
রাষ্ট্রদূত ছিলেন্। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয রাষ্ট্রদূত হিসেবে
জয়শঙ্কর যেভাবে ভুমিকা রেখেছেন তাতেও খুশি ছিলেন মোদী। আর ওবামার সফর
ফলপ্রসু করার পিছনেও জয়শঙ্করের ভুমিকা ছিল যথেষ্ট। মোদী তাই তার নতুন
পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে তাল মেলাতেই জয়শঙ্করকে নতুন পদে বসিয়েছেন। এই ভাবেই
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকেও তিনি বার্তা দিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।
No comments