রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনায় ছায়া ফেলেছে -মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর
রাজনৈতিক
সঙ্কট দ্রুত না কাটলে কাক্সিক্ষত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে না বলে আশঙ্কা
করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেছেন, শুধু তাই নয়,
আগামী ছয় মাসের জন্য ঘোষিত আগাম মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জও এ
রাজনৈতিক সঙ্কট। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের
সম্ভাবনায় ছায়া ফেলেছে। দেশের অর্থনীতির দিক চিন্তা করে সবাইকে দ্রুত সঙ্কট
উত্তরণের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল ছয় মাসের জন্য (জুন-জুলাই) আগাম এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর। বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম মিলনায়তনে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করার সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম, চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট এডভাইজার মো: আল্লাহ্ মালিক কাজেমীসহ অন্যান্য ডেপুটি গভর্নর ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মুদ্রানীতিতে আগামী জুন মাসের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ সাড়ে ১৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যা গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। কিন্তু গত নভেম্বর শেষে বাস্তবায়ন হয়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। আর্থাৎ কাক্সিক্ষত হারে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা আর্জিত হয়নি।
গত ছয় মাসে বিরোধী রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি ছিল না, ছিল না হরতাল, অবরোধের মতো বিনিয়োগবিরোধী কোনো কর্মসূচি, কিন্তু এর পরেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বেসরকারি বিনিয়োগ অর্জন না হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে গভর্নর বলেন, রাজনৈতিক সঙ্কট ছিল না এটা ঠিক। কিন্তু এর পরও বিনিয়োগ কম হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অর্থবছরের প্রথম চার মাস উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের ব্যাপারে দ্বিধায় ছিলেন, তারা একটি আশাবাদী পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তবে, শেষ দুই মাসে তা আবার বাড়তে শুরু করে। এতে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণসহ ১৪ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো রাজনীতিতে আবার সেই অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে।
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আবার আন্দোলন শুরু করেছে। এর ফলে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। যেখানে কোনো কর্মসূচি না থাকার পরও বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি, রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় বেসরকারি বিনিয়োগের বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা কিভাবে অর্জিত হবে এমন আরেক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, এটা অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, দ্রুত সঙ্কট না মিটলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। তবে, তিনি আশা করেন, অচিরেই সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। অর্থনীতির স্বার্থে দ্রুত চলমান সঙ্কট সমাধান হবে।
গভর্নর বলেন, অব্যাহত হরতাল-অবরোধে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ চলছে। এর সমাধান প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সহিংসতা বন্ধে দলমত নির্বিশেষে সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তিনি বলেন, অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে রক্তরক্ষণ আরো বাড়তে পারে। আমরা চাই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটুক।
গত ছয় মাসের মুদ্রানীতি অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন হয়নি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ডিসেম্বর শেষে অর্জন হয়েছে ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মাঝে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এতে সব ধরনের পণ্যের মূল্য বেড়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু এর পরেও মুদ্রানীতিতে আগামী জুন শেষে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে গভর্নর জানান, বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকাণ্ডে অর্থবছরের প্রথমার্ধে নতুন গতিসঞ্চার করেছিল। এর ফলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির পূর্ববর্তী প্রক্ষেপণ সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ অতিক্রমের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত বাধা আবার আসায় এই প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনায় অনিশ্চয়তায় ছায়া ফেলেছে। গভর্নর বলেন, প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের ধারা সুরক্ষার স্বার্থে বিরাজমান সঙ্কট অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ হওয়া জরুরি। তিনি আশা করেন, দেশে শান্তি ও সুস্থিতি ফিরে আসবে এবং আমরা মুদ্রানীতির প্রথমার্ধে প্রক্ষেপিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবো।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের সীমা ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার জন্য ক্রমান্বয়েই পুঁজিবাজার থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করছে বা নতুন করে কোনো বিনিয়োগ করতে পারছে না। বড় বড় ঋণখেলাপিকে ঋণ পুনর্গঠনের নামে ছাড় দেয়ার নীতিমালা অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর দিকে তাকিয়ে পুঁজিবাজারবান্ধব কোনো ছাড় দেয়া যায় কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময় পুঁজিবাজারবান্ধব। বর্তমানে বাজারের স্থিতিশীলতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেছন থেকে মদদ দিয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য ৯০০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন আগ বাড়িয়ে অনুমোদন করেছি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এক্সপোজার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মূলধন বাড়াতে বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। আরো অনেক কর্মসূচি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গভর্নর বলেন, আগামী দিনগুলোতেও বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মনীতির মধ্যে থেকে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনর্গঠন নীতিমালা অনুসারে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিলে ৫০০ কোটি টাকা থেকে এক হাজার কোটি টাকার নিচে ঋণ নবায়ন, আর ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিলে হাজার কোটি টাকার উপরে খেলাপিদের ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। একই সাথে সুদহারসহ আরো প্রায় ডজনখানেক ছাড় দেয়া হয়েছে। এর ফলে ভালো গ্রাহক যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন তারা নিরুৎসাহিত হবেন। আর ৫০০ কোটি টাকা নিচের খেলাপিরা বৈষম্যের শিকার হবেন। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, বিশেষ অবস্থায় ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশে দেয়া হয়। তিনি বলেন, দেশের শ্রমবাজার তথা অর্থনীতির স্বার্থে বড় ঋণগ্রহীতাদের জন্য নতুন নীতিমালা করা হয়েছে। তবে এতে সব ধরনের আটঘাট বেঁধে করা হয়েছে। কিন্তু যারা জাল-জালিয়াতির সাথে জড়িত এবং যারা দু’টি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হবে তারা এ সুযোগ পাবেন না। এতে ব্যাংকগুলো মুনাফা করতে পারবে। একই সাথে ভালো ঋণগ্রহীতার জন্য সম্মানজনক রিবেট নীতিমালা করার চিন্তাভাবনা চলছে। তবে, যারা ব্যাংকের নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, তাদের সুযোগসুবিধা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।
মুদ্রা সরবরাহে এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন করা হবে কি না এ বিষয়ে গভর্নর ড. আতিউর বলেন, যদি বিনিয়োগ পরিস্থিতির কোনো পরির্তন আসে, তাহলে মাঝামাঝি সময়েও ব্যাংক রেট, সিআরআর ইত্যাদি বদলে ফেলার সুযোগ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। ঋণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ সংস্থানের কোনো অভাব হবে না। গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক বেশি সংবেদনশীল।
ঘোষিত মুদ্রানীতি সম্পর্কে গভর্নর এক কথায় ‘সংযত ও সুসংহত’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
নতুন মুদ্রানীতির কর্মসূচিতে আগামী জুন নাগাদ বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক অর্থায়ন ব্যবহারের সুযোগও উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। আগের মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধির প্রোগ্রাম ছিল ১৪ শতাংশ। বিদেশী ঋণসহ যা সাড়ে ১৬ শতাংশ ধরা হয়েছিল। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, যা বিদেশী ঋণসহ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। জুন নাগাদ সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। যদিও নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ মুদ্রা জোগান নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাপক মুদ্রা জোগানের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ পরিমিত রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রিজার্ভ মানির প্রেক্ষাপণ ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। নিট বিদেশী সম্পদ অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
গতকাল ছয় মাসের জন্য (জুন-জুলাই) আগাম এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর। বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম মিলনায়তনে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করার সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম, চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট এডভাইজার মো: আল্লাহ্ মালিক কাজেমীসহ অন্যান্য ডেপুটি গভর্নর ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মুদ্রানীতিতে আগামী জুন মাসের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ সাড়ে ১৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যা গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। কিন্তু গত নভেম্বর শেষে বাস্তবায়ন হয়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। আর্থাৎ কাক্সিক্ষত হারে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা আর্জিত হয়নি।
গত ছয় মাসে বিরোধী রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি ছিল না, ছিল না হরতাল, অবরোধের মতো বিনিয়োগবিরোধী কোনো কর্মসূচি, কিন্তু এর পরেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বেসরকারি বিনিয়োগ অর্জন না হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে গভর্নর বলেন, রাজনৈতিক সঙ্কট ছিল না এটা ঠিক। কিন্তু এর পরও বিনিয়োগ কম হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অর্থবছরের প্রথম চার মাস উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের ব্যাপারে দ্বিধায় ছিলেন, তারা একটি আশাবাদী পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তবে, শেষ দুই মাসে তা আবার বাড়তে শুরু করে। এতে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণসহ ১৪ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো রাজনীতিতে আবার সেই অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে।
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আবার আন্দোলন শুরু করেছে। এর ফলে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। যেখানে কোনো কর্মসূচি না থাকার পরও বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি, রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় বেসরকারি বিনিয়োগের বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা কিভাবে অর্জিত হবে এমন আরেক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, এটা অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, দ্রুত সঙ্কট না মিটলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। তবে, তিনি আশা করেন, অচিরেই সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। অর্থনীতির স্বার্থে দ্রুত চলমান সঙ্কট সমাধান হবে।
গভর্নর বলেন, অব্যাহত হরতাল-অবরোধে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ চলছে। এর সমাধান প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সহিংসতা বন্ধে দলমত নির্বিশেষে সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তিনি বলেন, অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে রক্তরক্ষণ আরো বাড়তে পারে। আমরা চাই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটুক।
গত ছয় মাসের মুদ্রানীতি অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন হয়নি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ডিসেম্বর শেষে অর্জন হয়েছে ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মাঝে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এতে সব ধরনের পণ্যের মূল্য বেড়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু এর পরেও মুদ্রানীতিতে আগামী জুন শেষে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে গভর্নর জানান, বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকাণ্ডে অর্থবছরের প্রথমার্ধে নতুন গতিসঞ্চার করেছিল। এর ফলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির পূর্ববর্তী প্রক্ষেপণ সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ অতিক্রমের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত বাধা আবার আসায় এই প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনায় অনিশ্চয়তায় ছায়া ফেলেছে। গভর্নর বলেন, প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের ধারা সুরক্ষার স্বার্থে বিরাজমান সঙ্কট অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ হওয়া জরুরি। তিনি আশা করেন, দেশে শান্তি ও সুস্থিতি ফিরে আসবে এবং আমরা মুদ্রানীতির প্রথমার্ধে প্রক্ষেপিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবো।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের সীমা ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার জন্য ক্রমান্বয়েই পুঁজিবাজার থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করছে বা নতুন করে কোনো বিনিয়োগ করতে পারছে না। বড় বড় ঋণখেলাপিকে ঋণ পুনর্গঠনের নামে ছাড় দেয়ার নীতিমালা অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর দিকে তাকিয়ে পুঁজিবাজারবান্ধব কোনো ছাড় দেয়া যায় কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময় পুঁজিবাজারবান্ধব। বর্তমানে বাজারের স্থিতিশীলতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেছন থেকে মদদ দিয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য ৯০০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন আগ বাড়িয়ে অনুমোদন করেছি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এক্সপোজার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মূলধন বাড়াতে বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। আরো অনেক কর্মসূচি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গভর্নর বলেন, আগামী দিনগুলোতেও বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মনীতির মধ্যে থেকে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনর্গঠন নীতিমালা অনুসারে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিলে ৫০০ কোটি টাকা থেকে এক হাজার কোটি টাকার নিচে ঋণ নবায়ন, আর ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিলে হাজার কোটি টাকার উপরে খেলাপিদের ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। একই সাথে সুদহারসহ আরো প্রায় ডজনখানেক ছাড় দেয়া হয়েছে। এর ফলে ভালো গ্রাহক যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন তারা নিরুৎসাহিত হবেন। আর ৫০০ কোটি টাকা নিচের খেলাপিরা বৈষম্যের শিকার হবেন। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, বিশেষ অবস্থায় ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশে দেয়া হয়। তিনি বলেন, দেশের শ্রমবাজার তথা অর্থনীতির স্বার্থে বড় ঋণগ্রহীতাদের জন্য নতুন নীতিমালা করা হয়েছে। তবে এতে সব ধরনের আটঘাট বেঁধে করা হয়েছে। কিন্তু যারা জাল-জালিয়াতির সাথে জড়িত এবং যারা দু’টি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হবে তারা এ সুযোগ পাবেন না। এতে ব্যাংকগুলো মুনাফা করতে পারবে। একই সাথে ভালো ঋণগ্রহীতার জন্য সম্মানজনক রিবেট নীতিমালা করার চিন্তাভাবনা চলছে। তবে, যারা ব্যাংকের নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, তাদের সুযোগসুবিধা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।
মুদ্রা সরবরাহে এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন করা হবে কি না এ বিষয়ে গভর্নর ড. আতিউর বলেন, যদি বিনিয়োগ পরিস্থিতির কোনো পরির্তন আসে, তাহলে মাঝামাঝি সময়েও ব্যাংক রেট, সিআরআর ইত্যাদি বদলে ফেলার সুযোগ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। ঋণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ সংস্থানের কোনো অভাব হবে না। গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক বেশি সংবেদনশীল।
ঘোষিত মুদ্রানীতি সম্পর্কে গভর্নর এক কথায় ‘সংযত ও সুসংহত’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
নতুন মুদ্রানীতির কর্মসূচিতে আগামী জুন নাগাদ বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক অর্থায়ন ব্যবহারের সুযোগও উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। আগের মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধির প্রোগ্রাম ছিল ১৪ শতাংশ। বিদেশী ঋণসহ যা সাড়ে ১৬ শতাংশ ধরা হয়েছিল। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, যা বিদেশী ঋণসহ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। জুন নাগাদ সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। যদিও নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ মুদ্রা জোগান নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাপক মুদ্রা জোগানের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ পরিমিত রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রিজার্ভ মানির প্রেক্ষাপণ ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। নিট বিদেশী সম্পদ অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
No comments