মার্কিন বলয়ে ঝুঁকে গেল মোদির ভারত! by মাসুম খলিলী
পনেরো
বছর ধরে ধীরে ধীরে সম্পর্ক উষ্ণ করেও সব পক্ষের সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে
আসছিল দিল্লি। সেই ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি থেকে সরে এলো ভারত? ওবামার
সফরকালে আমেরিকার সাথে কঠিন সব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চুক্তি আর অঙ্গীকার করার
পর এমনটিই ভাবছেন পর্যবেক্ষকেরা। অভিন্ন প্রতিরক্ষা গবেষণা ও সরঞ্জাম
উৎপাদন থেকে শুরু করে নজরদারিবিহীন পরমাণু চুল্লি হস্তান্তর এবং সাগরে
আকাশে যৌথ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সব কিছুতে সাথে সাথে চলার কৌশলগত মৈত্রীÑ সবই
দৃশ্যত সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে হয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার
দ্বিতীয় দফা ভারত সফরে। দ্বিতীয়বার সফরের রেকর্ডের পাশাপাশি ভারতীয়
প্রজাতন্ত্র দিবসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম সামরিক কুচকাওয়াজে
অভিবাদন নিলেন বারাক ওবামা। আঞ্চলিক সুহৃদ থেকে আন্তর্জাতিক মিত্রের
মর্যাদাই শুধু ওবামা এবার মোদিকে দেননি, একই সাথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য
সহিষ্ণুতার বার্তাও তিনি দিয়েছেন। বলেছেন, ‘ভারত ততণই সফল, যতণ ধর্মের
ভিত্তিতে নিজেকে ভাগ বিভাজন না করবে। দুই দেশেই নানা জাতি নানা ধর্মের
মানুষ বাস করেন। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই সবচেয়ে বড় শক্তি।’ ওবামা স্মরণ
করিয়ে দেন, ‘আমরা এমন দেশের বাসিন্দা হতে পেরে গর্বিত, যেখানে রাঁধুনির
নাতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন, দলিতের ছেলে হন ভারতীয় সংবিধানের রূপকার, আর
চা বিক্রেতা হন প্রধানমন্ত্রী।’
উন্নয়ন আর সুশাসনের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বজরং দলের ‘ঘর ওয়াপসি’র নামে মুসলিম খ্রিষ্টানদের হিন্দু বানানোর কর্মকাণ্ডে এ প্রচেষ্টা চাপা পড়ে যায়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে উন্নয়ন যে ব্যাহত হয়, সে ব্যাপারে সম্প্রতি বিজেপির শুভানুধ্যায়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী যেভাবে সতর্ক করেন, ওবামার বক্তৃতায় সেই একই সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়।
কী পেল ভারত
ওবামার সফরের প্রথম দিনেই দুই নেতা পরমাণু চুক্তির জটিলতা কাটানোর কথা ঘোষণা করেন। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার আমলে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি। কিন্তু এ চুক্তিকে বাস্তবায়নপর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি মনমোহনের সরকার। এ েেত্র এমন কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়, যা অতিক্রম করা হয়ে পড়ছিল সত্যিকার অর্থেই কঠিন। এবার এই কঠিন কাজটিই সম্পন্ন করতে পেরেছে দেশ দু’টি। সমঝোতা অনুসারে যত দ্রুত সম্ভব ভারতের বিদ্যুৎ নিরাপত্তা বাড়াতে আমেরিকার তৈরি পরমাণু চুল্লি বসানো হবে। পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা সংস্থা একযোগে একটি বীমা তহবিল গঠন করবে। পরমাণু চুল্লির যেকোনো ক্ষতি বা বিপত্তিতে এই তহবিল ব্যবহার করা হবে। এর ফলে সরবরাহকারীর ওপর কোনো আর্থিক বোঝা আসবে না। আগে চুল্লিতে দুর্ঘটনা হলে বিপুল দায়বদ্ধতার মুখে পড়তে হতো সরবরাহকারী আমেরিকান সংস্থাকে। এ ছাড়া পরমাণু চুল্লি আমেরিকা তৈরি করবে বলে তারা চাইছিল, এখানে যেসব তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করা হবে, সেগুলোকে মার্কিন পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখতে। তাদের আশঙ্কা ছিল, এসব তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে রিসাইকিং মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ওবামা পর্যবেক্ষণের সেই শর্ত থেকে সরে আসেন। ভারতকে পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) ঢোকানোর প্রক্রিয়াতেও গতি আনার কথা বলা হয়। পরমাণু চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে মার্কিন বিনিয়োগে ভারতে বৃহৎ পরমাণু চুল্লি তৈরি করা সম্ভব হবে। এর ফলে তেল বা ফসিল-জ্বালানির ওপর ভারতের নির্ভরতা কমবে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। কর্মসংস্থানও বাড়বে অনুসারী শিল্পের মাধ্যমে। যে উন্নয়নের ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদি ক্ষমতায় এসেছেন, তার অনেকখানি পূরণ হবে।
১০ বছর আগে ভারতের সাথে রামসফেল্ড ও প্রণব মুখার্জি স্বার করেছিলেন প্রতিরা সহযোগিতা চুক্তি। এই চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়ে এলেও তা তেমন কার্যকর করা যায়নি। এবার চুক্তিটি আরো ১০ বছরের জন্য নবায়নের সাথে নতুন মাত্রা নিয়ে আসা হয়েছে। এখন দুই দেশের প্রতিরা সহযোগিতা বেচাকেনায় সীমিত থাকবে না। দুই দেশ একসাথে সমরাস্ত্র তৈরি করবে, নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে করবে গবেষণা। যুদ্ধাস্ত্রের প্রযুক্তিই ভারতের হাতে তুলে দেবে আমেরিকা, যার মধ্যে অন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির চালকহীন নজরদারি বিমান (ইউএভি)। এর আগে রাশিয়া উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করলেও ভারতে কেবল সমরাস্ত্র বেচে এসেছে আমেরিকা। এবার মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে তৈরী যুদ্ধাস্ত্র ভারত বিদেশেও রফতানি করতে পারবে। মার্কিন সংস্থাগুলো যাতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, সে জন্য মোদি সরকার ইতোমধ্যে ৪৯ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছে। আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শতভাগ বিদেশী বিনিয়োগেরও অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
বিদায় হওয়ার আগে ওবামা এ ছাড়াও দিয়েছেন সহযোগিতার নানা প্রতিশ্রুতি। বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের জন্য আমেরিকা সমর্থন করবে ভারতকে। পরিকাঠামো থেকে শুরু করে স্মার্ট সিটি, বুলেট ট্রেন থেকে নিরাপত্তা প্রযুক্তি সর্বস্তরে দেয়া হবে ঢালাও সহযোগিতা। অবকাঠামো নির্মাণে চার বিলিয়ন ডলার, অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের জন্য দুই বিলিয়ন ডলার এবং ুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে আরো দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে যুক্তরাষ্ট্র। সাময়িক ভিসা নিয়ে যারা যুক্তরাষ্ট্রে কাজের জন্য যাচ্ছেন, তাদের আরো সুবিধা দিতেও ওবামা প্রশাসন রাজি হয়েছে। আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার েেত্র একসাথে চলার অঙ্গীকারও করেছেন তিনি।
আসল লক্ষ্য চীন?
ওবামার নিজের ভাণ্ডার উজাড় করে সহযোগিতা দিতে চাইবার এত সব উদ্যোগ-আয়োজন কেন, সে প্রশ্নের গভীরে অনেকে সেভাবে ঢুকতে চাননি। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা আড়াল করেনি এ রহস্য। ‘আলিঙ্গনের পরে’ শিরোনামে সম্পাদকীয় মন্তব্যে পত্রিকাটি বলেছে, “নরেন্দ্র মোদির স্বহস্তে প্রস্তুত চা পান করিবার জন্য বারো হাজার কিলোমিটার উড়িয়া আসেন নাই, দিল্লির রাজপথে সামরিক কুচকাওয়াজ এবং সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী দেখিবার জন্যও নহে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই ‘ঐতিহাসিক’ ভারত সফরের পিছনে এক এবং অদ্বিতীয় কারণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ। স্বার্থ বহুমাত্রিক। প্রথম ও প্রধান মাত্রাটির নাম : চিন। তাহার প্রমাণ রহিয়াছে এই সফর উপলে প্রকাশিত ভারত-মার্কিন যৌথ বিবৃতিতে। পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রপথের এবং আকাশযাত্রার নিরাপত্তা রায় দুই দেশের সহযোগিতার অঙ্গীকারেই বিবৃতি থামে নাই, সরাসরি ‘বিশেষত সাউথ চায়না সি’ অঞ্চলে সহযোগিতায় জোর দিয়াছে। সাউথ চায়না সিতে গত কয়েক বছরে চিনের আগ্রাসী নীতির প্রেেিত এই বিবৃতির তাৎপর্য অতি স্পষ্ট। চিন সেই তাৎপর্য বুঝিতে কিছুমাত্র ভুল করে নাই। বেজিং সচরাচর কোনও বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাইতে অন্তত আঠারো মাস সময় লইয়া থাকে, অথচ ওবামা-মোদি কূটনৈতিক অভিযানকে ‘অগভীর’ বলিয়া বাতিল করিবার জন্য তাহার চব্বিশ ঘণ্টাও লাগে নাই।”
শুধু আনন্দবাজার নয়, ওবামার ভারত সফরের এই বার্তা পাওয়া যায় নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনেও। পত্রিকাটি বলেছে, ‘দুই নেতার যৌথ বিবৃতি চীনকে চঞ্চল করে তুলেছে। ওবামার সফর শেষ হওয়ার আগেই চীন তাই এই সফর নিয়ে যে মন্তব্য করেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, মোদি-ওবামার কাছাকাছি আসাটা তারা মোটেই পছন্দ করছে না। চীন বেশ বুঝতে পারছে, ভারত-আমেরিকা-জাপান অ এশিয়া ও দণি এশিয়ায় তাদের প্রভাব রুখতে সচেষ্ট।’ পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে, ‘ওবামার এই সফরে বাণিজ্য জ্বালানি আমেরিকান পারমাণবিক প্রযুক্তি দেয়া একসাথে প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও গবেষণাসহ অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু ওবামা যখন মোদির সাথে আলোচনা শুরু করেন, তার প্রথম ৪৫ মিনিটজুড়ে স্থান ছিল চীনের। এ সময় চীনের উত্থান ও পূর্ব এশিয়ায় দেশটির কৌশলগত অবস্থানের প্রভাব সম্পর্কে মোদির মূল্যায়ন দেখে ওবামা ও তার সফরসঙ্গীরা বিস্মিত হন। এ অঞ্চলে চীনের বর্ধনশীল প্রভাবে মোদিকে উদ্বিগ্ন মনে হয় এবং চীনকে মোকাবেলায় অভিন্ন পদপে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়া নিরাপত্তাব্যবস্থা আবার জোরদার করতে পরামর্শ দেন নরেন্দ্র মোদি। এর পাশাপাশি চীনের প্রভাব বিস্তারের েেত্র ভারসাম্য রায় এশিয়া প্রশান্ত মহাসগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগী ফোরাম বা এপেকের আরো বৃহত্তর ভূমিকা পালনের ব্যাপারেও আগ্রহ দেখান তিনি।’ পত্রিকাটিতে বলা হয়, চীনের সাথে ভারতের বৈরিতার লম্বা ইতিহাস রয়েছে কিন্তু ভারত কাজ করেছে সব সময় স্বাধীনভাবে। আমেরিকা অভিন্ন ফ্রন্ট খুলতে চাইলেও তাতে দিল্লি সাড়া দেয়নি। মোদি সম্ভবত সেই রসায়ন পাল্টে দিতে চাইছেন। তিনি ওবামার সাথে যে যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন, তাতে দক্ষিণ চীন সাগরে প্রতিবেশীদের সাথে সঙ্ঘাত উসকে দেয়ার জন্য চীনা সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এসব দেখেশুনে চীন তার ক্ষোভ গোপন করতে বিলম্ব করেনি। মন্তব্য করেছে, ওবামার সফর আসলেই একটি ‘কৃত্রিম পুনর্মিলন’। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য ফাঁদ তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছে চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকা। আমেরিকার কর্মকর্তারা অবশ্য বলেছেন, পাশের রাষ্ট্রগুলোর সাথে বিরোধে বেইজিং শক্তি প্রয়োগের নীতি অনুসরণ না করলে ওবামার ভারত সফর নিয়ে চীনের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
চীনের তাৎক্ষণিক আরেকটি পদক্ষেপে তার প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করা যায়। বেইজিংয়ের সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার মাত্র এক দিন পর এ ঘোষণা দিয়ে চীন জানায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের ৭০তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ বছর বড় ধরনের একটি সামরিক কুচকাওয়াজের পরিকল্পনা করছে বেইজিং।
দিল্লি যে বেইজিংয়ের মনোভাব বুঝতে পারেনি তা নয়। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে মন্তব্য, আঞ্চলিক বলয় গঠন ইত্যাদি নিয়ে বেইজিংয়ের ক্ষোভ আর আমেরিকার সাথে যৌথভাবে অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা গবেষণার ব্যাপারে রুশ অসন্তোষ নমনীয় করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে আগামী সপ্তাহের শুরুতে চীন পাঠাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। আগামী রোববার সুষমা সেখানে চীনা প্রতিপক্ষ ওয়াং ই’র সাথে উভয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বিপক্ষীয় আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন। তারা রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সাথে ত্রিপক্ষীয় আলোচনাও করবেন। মোদি আমেরিকার সাথে অংশীদারিত্বকে যতই এগিয়ে নিতে চান না কেন, এ মুহূর্তে চীন-রাশিয়াকে হয়তো বেশি বৈরী করতে চাইছেন না। কিন্তু বাস্তবে তা কতটা তিনি পারবেন সেটি নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়।
ওবামার সফর নিয়ে ব্রিটিশ সাময়িকী ইকনোমিস্টের মূল্যায়নটিও তাৎপর্যপূর্ণ। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘আগে যে চুলজ্জা, চীনকে না রাগানো ইত্যাদি ব্যাপার ছিল, এখন মোদির আমলে সেটা দৃশ্যত কেটে গেছে।... বর্তমানে ভারত ও আমেরিকা গোয়েন্দা সহযোগিতা করে যাচ্ছে। দুই দেশই পাকিস্তান নিয়ে কিছু অবিশ্বাসে ভুগছে এবং দেশটিতে ইসলামি চরমপন্থীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। অন্য দিকে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক ভারত একসময় তার প্রতিরা সরঞ্জামের সরবরাহের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকলেও এখন ক্রমবর্ধমান হারে আমেরিকা, ইসরাইল ও অন্যান্য দেশের উচ্চপ্রযুক্তির প্রস্তাব পাচ্ছে। গত নভেম্বর দুই দশকের মধ্যে প্রথমবার রাশিয়া তার প্রতিরামন্ত্রীকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ পাঠিয়েছিল দেশটিতে অস্ত্র বিক্রি শুরুর জন্য। আর এটা ভারতকে রাশিয়ার বিকল্প খোঁজাকে ত্বরান্বিতই করেছে।’
ক্ষুব্ধ পাকিস্তান
ভারতে ওবামার সফরকালে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানও। চার বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দানের ঘোষণার পর ওবামা যখন নরেন্দ্র মোদির সাথে করমর্দন করছিলেন, ঠিক সে সময় বেইজিং সফররত পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফকে জমকালো সংবর্ধনা দেয় চীন। বেইজিং ঘোষণা করে, পাকিস্তান হলো চীনের সব সময়ের অপরিবর্তনীয় বন্ধু।
পাকিস্তানের আপত্তি আমেরিকার সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে। দেশটির সাবেক ফেডারেল মন্ত্রী খুরশিদ শাহ বলেছেন, আমরা ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন নই। আমাদের উৎকণ্ঠা হলো দেশটির দ্বিমুখিতা নিয়ে। আমরা আফগানিস্তানের যুদ্ধে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কিভাবেই না তাদের সাহায্য করেছি। যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে গিয়ে পাকিস্তানকে শরণার্থীর বোঝা, হেরোইনের উপদ্রব, কালাশনিকভ এবং উগ্রপন্থার বিস্তৃতির ঝুঁকি বইতে হচ্ছে।
ডেইলি টাইমসের অপ-এড সম্পাদক মেহের তারার লিখেছেন, সন্ত্রাসের ব্যাপারে অভিযোগের আঙুল তোলা হচ্ছে পাকিস্তানের প্রতি। অথচ আফগানিস্তানকে ব্যবহার করে পাকিস্তানে ভারতের সন্ত্রাসী হামলায় ইন্ধন দেয়ার প্রমাণাদি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এরপর আশা করা হয়েছিল সেখানে আমেরিকান বাহিনী প্রত্যাহারে ভারতের ভূমিকা থাকবে না। কিন্তু এখন আফগানিস্তানেও ভারত-মার্কিন সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে। কাশ্মিরে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে অবজ্ঞা করছে ভারত। এই ইস্যুর গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি না করে ভারতকে কোনোভাবেই জাতিসঙ্ঘে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে সমর্থন দেয়া যেতে পারে না। আমেরিকা ভারতকে এশিয়ার সাথে কানেকটিভিটিতে সহায়তার কথা বলছে অথচ পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। আর পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে কিছু জানানোও হয়নি।
ওবামার সফরকালে ভারতের সাথে যে চুক্তি ও সমঝোতা করা হয়েছে তা কার্যকর হলে এ অঞ্চলে পারস্পরিক সম্পর্কে যে ভারসাম্য ছিল তা আর থাকবে না। ¯œায়ুযুদ্ধকাল থেকে পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র। এবার ওবামা ভারতকে তার দেশের ‘প্রাকৃতিকভাবে বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিকল্প হবে চীনের সাথে অধিক মৈত্রী ও নির্ভরতা গড়ে তোলা। রাশিয়ার সাথেও ইসলামাবাদ আরো সম্পর্ক গভীর করতে পারে। দেশটির সাথে সম্প্রতি অস্ত্রশস্ত্র কেনার সমঝোতার বিষয়টি তারই ইঙ্গিতবহ হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
ওবামার ভারত সফরের আগে লেখা কলামে উল্লেখ করেছিলাম, দুই নেতার বৈঠকে বাংলাদেশ ইস্যু সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপনের সম্ভাবনা নেই। এই ইস্যু সাইডলাইনের বৈঠকে আলোচিত হতে পারে। আর সেটি হলে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণায় এই প্রসঙ্গ আসবে না। প্রতিবেশীদের ব্যাপারে কয়েকটি দেশের কথা সফর দলিলে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশ তাতে নেই। তবে এই অঞ্চলের সব বিষয়ে দুই দেশে আলাপ-আলোচনা করে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা আছে। ইউপিএ আমলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতভিন্নতা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এখানে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও গণতন্ত্রের অবিচ্ছিন্ন চর্চা চেয়েছিল। কংগ্রেস সরকার চেয়েছিল যেভাবে হোক তাদের বিশ্বস্ত দলকে ক্ষমতায় রাখতে। বিজেপি সরকার ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও আগের সরকারের নীতিকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আকবর উদ্দিনের বিবৃতিতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এ ছাড়া ওবামা ভারত ছাড়ার পরপরই বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তার স্থলে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে। এতে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যেকোনো পরিবর্তনে দুই পক্ষের ঐকমত্য থাকবে, যেটি ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের সময় ছিল না।
রয়ে গেছে সংশয়
মোদি যেভাবে আমেরিকার সাথে চলার চুক্তি করেছেন, সেভাবে এগোনো দেশটির পক্ষে সহজ হবে না। স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময় ভারতের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল সোভিয়েতনির্ভর। এরপর আমেরিকা ও ইসরাইল থেকে উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করা হলেও সেই নির্ভরতা একেবারে দূর হয়ে গেছে বলা যাবে না। বিগত সরকারের আমলেও প্রতিরক্ষা বিষয়ে নতুন করে চুক্তি হয়েছে রাশিয়ার সাথে। আমেরিকান অংশীদারিত্ব নির্ভরতার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় আনতে পারে। তবে রাতারাতি সেটি করা সম্ভব হবে না। প্রজাতন্ত্র দিবসের যে কুচকাওয়াজে ওবামাকে অভিবাদন জানানো হয়, সেখানেও রাশিয়ার তৈরি বিমানই ব্যবহার করা হয়েছে। অন্য দিকে চীনের সাথে ভারতের বৈরিতার মধ্যেও যে নির্ভরশীলতার সম্পর্ক রয়েছে তাকে সর্বাত্মক শত্রুতায় পরিণত করা সম্ভব হবে না দিল্লির পক্ষে। চীন-ভারত-রাশিয়া এই তিন দেশ হলো ব্রিকসের মূল স্তম্ভ। ব্রিকস ব্যাংক থেকে শুরু করে বিকল্প বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির সাথে এই তিন দেশ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। চীনের সাথে মিলে ভারতের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কানেকটিভিটি গড়ে তোলার একটি প্রকল্পও রয়েছে। সব মিলিয়ে যতটা উচ্ছ্বাস ওবামার সফর নিয়ে, এখন দেখা যাচ্ছে ততটা সামনে নাও থাকতে পারে। ইউপিএ সরকারের সময়ও সেটিই দেখা গিয়েছিল।
উন্নয়ন আর সুশাসনের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বজরং দলের ‘ঘর ওয়াপসি’র নামে মুসলিম খ্রিষ্টানদের হিন্দু বানানোর কর্মকাণ্ডে এ প্রচেষ্টা চাপা পড়ে যায়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে উন্নয়ন যে ব্যাহত হয়, সে ব্যাপারে সম্প্রতি বিজেপির শুভানুধ্যায়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী যেভাবে সতর্ক করেন, ওবামার বক্তৃতায় সেই একই সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়।
কী পেল ভারত
ওবামার সফরের প্রথম দিনেই দুই নেতা পরমাণু চুক্তির জটিলতা কাটানোর কথা ঘোষণা করেন। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার আমলে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি। কিন্তু এ চুক্তিকে বাস্তবায়নপর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি মনমোহনের সরকার। এ েেত্র এমন কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়, যা অতিক্রম করা হয়ে পড়ছিল সত্যিকার অর্থেই কঠিন। এবার এই কঠিন কাজটিই সম্পন্ন করতে পেরেছে দেশ দু’টি। সমঝোতা অনুসারে যত দ্রুত সম্ভব ভারতের বিদ্যুৎ নিরাপত্তা বাড়াতে আমেরিকার তৈরি পরমাণু চুল্লি বসানো হবে। পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা সংস্থা একযোগে একটি বীমা তহবিল গঠন করবে। পরমাণু চুল্লির যেকোনো ক্ষতি বা বিপত্তিতে এই তহবিল ব্যবহার করা হবে। এর ফলে সরবরাহকারীর ওপর কোনো আর্থিক বোঝা আসবে না। আগে চুল্লিতে দুর্ঘটনা হলে বিপুল দায়বদ্ধতার মুখে পড়তে হতো সরবরাহকারী আমেরিকান সংস্থাকে। এ ছাড়া পরমাণু চুল্লি আমেরিকা তৈরি করবে বলে তারা চাইছিল, এখানে যেসব তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করা হবে, সেগুলোকে মার্কিন পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখতে। তাদের আশঙ্কা ছিল, এসব তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে রিসাইকিং মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ওবামা পর্যবেক্ষণের সেই শর্ত থেকে সরে আসেন। ভারতকে পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) ঢোকানোর প্রক্রিয়াতেও গতি আনার কথা বলা হয়। পরমাণু চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে মার্কিন বিনিয়োগে ভারতে বৃহৎ পরমাণু চুল্লি তৈরি করা সম্ভব হবে। এর ফলে তেল বা ফসিল-জ্বালানির ওপর ভারতের নির্ভরতা কমবে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। কর্মসংস্থানও বাড়বে অনুসারী শিল্পের মাধ্যমে। যে উন্নয়নের ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদি ক্ষমতায় এসেছেন, তার অনেকখানি পূরণ হবে।
১০ বছর আগে ভারতের সাথে রামসফেল্ড ও প্রণব মুখার্জি স্বার করেছিলেন প্রতিরা সহযোগিতা চুক্তি। এই চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়ে এলেও তা তেমন কার্যকর করা যায়নি। এবার চুক্তিটি আরো ১০ বছরের জন্য নবায়নের সাথে নতুন মাত্রা নিয়ে আসা হয়েছে। এখন দুই দেশের প্রতিরা সহযোগিতা বেচাকেনায় সীমিত থাকবে না। দুই দেশ একসাথে সমরাস্ত্র তৈরি করবে, নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে করবে গবেষণা। যুদ্ধাস্ত্রের প্রযুক্তিই ভারতের হাতে তুলে দেবে আমেরিকা, যার মধ্যে অন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির চালকহীন নজরদারি বিমান (ইউএভি)। এর আগে রাশিয়া উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করলেও ভারতে কেবল সমরাস্ত্র বেচে এসেছে আমেরিকা। এবার মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে তৈরী যুদ্ধাস্ত্র ভারত বিদেশেও রফতানি করতে পারবে। মার্কিন সংস্থাগুলো যাতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, সে জন্য মোদি সরকার ইতোমধ্যে ৪৯ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছে। আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শতভাগ বিদেশী বিনিয়োগেরও অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
বিদায় হওয়ার আগে ওবামা এ ছাড়াও দিয়েছেন সহযোগিতার নানা প্রতিশ্রুতি। বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের জন্য আমেরিকা সমর্থন করবে ভারতকে। পরিকাঠামো থেকে শুরু করে স্মার্ট সিটি, বুলেট ট্রেন থেকে নিরাপত্তা প্রযুক্তি সর্বস্তরে দেয়া হবে ঢালাও সহযোগিতা। অবকাঠামো নির্মাণে চার বিলিয়ন ডলার, অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের জন্য দুই বিলিয়ন ডলার এবং ুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে আরো দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে যুক্তরাষ্ট্র। সাময়িক ভিসা নিয়ে যারা যুক্তরাষ্ট্রে কাজের জন্য যাচ্ছেন, তাদের আরো সুবিধা দিতেও ওবামা প্রশাসন রাজি হয়েছে। আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার েেত্র একসাথে চলার অঙ্গীকারও করেছেন তিনি।
আসল লক্ষ্য চীন?
ওবামার নিজের ভাণ্ডার উজাড় করে সহযোগিতা দিতে চাইবার এত সব উদ্যোগ-আয়োজন কেন, সে প্রশ্নের গভীরে অনেকে সেভাবে ঢুকতে চাননি। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা আড়াল করেনি এ রহস্য। ‘আলিঙ্গনের পরে’ শিরোনামে সম্পাদকীয় মন্তব্যে পত্রিকাটি বলেছে, “নরেন্দ্র মোদির স্বহস্তে প্রস্তুত চা পান করিবার জন্য বারো হাজার কিলোমিটার উড়িয়া আসেন নাই, দিল্লির রাজপথে সামরিক কুচকাওয়াজ এবং সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী দেখিবার জন্যও নহে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই ‘ঐতিহাসিক’ ভারত সফরের পিছনে এক এবং অদ্বিতীয় কারণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ। স্বার্থ বহুমাত্রিক। প্রথম ও প্রধান মাত্রাটির নাম : চিন। তাহার প্রমাণ রহিয়াছে এই সফর উপলে প্রকাশিত ভারত-মার্কিন যৌথ বিবৃতিতে। পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রপথের এবং আকাশযাত্রার নিরাপত্তা রায় দুই দেশের সহযোগিতার অঙ্গীকারেই বিবৃতি থামে নাই, সরাসরি ‘বিশেষত সাউথ চায়না সি’ অঞ্চলে সহযোগিতায় জোর দিয়াছে। সাউথ চায়না সিতে গত কয়েক বছরে চিনের আগ্রাসী নীতির প্রেেিত এই বিবৃতির তাৎপর্য অতি স্পষ্ট। চিন সেই তাৎপর্য বুঝিতে কিছুমাত্র ভুল করে নাই। বেজিং সচরাচর কোনও বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাইতে অন্তত আঠারো মাস সময় লইয়া থাকে, অথচ ওবামা-মোদি কূটনৈতিক অভিযানকে ‘অগভীর’ বলিয়া বাতিল করিবার জন্য তাহার চব্বিশ ঘণ্টাও লাগে নাই।”
শুধু আনন্দবাজার নয়, ওবামার ভারত সফরের এই বার্তা পাওয়া যায় নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনেও। পত্রিকাটি বলেছে, ‘দুই নেতার যৌথ বিবৃতি চীনকে চঞ্চল করে তুলেছে। ওবামার সফর শেষ হওয়ার আগেই চীন তাই এই সফর নিয়ে যে মন্তব্য করেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, মোদি-ওবামার কাছাকাছি আসাটা তারা মোটেই পছন্দ করছে না। চীন বেশ বুঝতে পারছে, ভারত-আমেরিকা-জাপান অ এশিয়া ও দণি এশিয়ায় তাদের প্রভাব রুখতে সচেষ্ট।’ পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে, ‘ওবামার এই সফরে বাণিজ্য জ্বালানি আমেরিকান পারমাণবিক প্রযুক্তি দেয়া একসাথে প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও গবেষণাসহ অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু ওবামা যখন মোদির সাথে আলোচনা শুরু করেন, তার প্রথম ৪৫ মিনিটজুড়ে স্থান ছিল চীনের। এ সময় চীনের উত্থান ও পূর্ব এশিয়ায় দেশটির কৌশলগত অবস্থানের প্রভাব সম্পর্কে মোদির মূল্যায়ন দেখে ওবামা ও তার সফরসঙ্গীরা বিস্মিত হন। এ অঞ্চলে চীনের বর্ধনশীল প্রভাবে মোদিকে উদ্বিগ্ন মনে হয় এবং চীনকে মোকাবেলায় অভিন্ন পদপে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়া নিরাপত্তাব্যবস্থা আবার জোরদার করতে পরামর্শ দেন নরেন্দ্র মোদি। এর পাশাপাশি চীনের প্রভাব বিস্তারের েেত্র ভারসাম্য রায় এশিয়া প্রশান্ত মহাসগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগী ফোরাম বা এপেকের আরো বৃহত্তর ভূমিকা পালনের ব্যাপারেও আগ্রহ দেখান তিনি।’ পত্রিকাটিতে বলা হয়, চীনের সাথে ভারতের বৈরিতার লম্বা ইতিহাস রয়েছে কিন্তু ভারত কাজ করেছে সব সময় স্বাধীনভাবে। আমেরিকা অভিন্ন ফ্রন্ট খুলতে চাইলেও তাতে দিল্লি সাড়া দেয়নি। মোদি সম্ভবত সেই রসায়ন পাল্টে দিতে চাইছেন। তিনি ওবামার সাথে যে যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন, তাতে দক্ষিণ চীন সাগরে প্রতিবেশীদের সাথে সঙ্ঘাত উসকে দেয়ার জন্য চীনা সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এসব দেখেশুনে চীন তার ক্ষোভ গোপন করতে বিলম্ব করেনি। মন্তব্য করেছে, ওবামার সফর আসলেই একটি ‘কৃত্রিম পুনর্মিলন’। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য ফাঁদ তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছে চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকা। আমেরিকার কর্মকর্তারা অবশ্য বলেছেন, পাশের রাষ্ট্রগুলোর সাথে বিরোধে বেইজিং শক্তি প্রয়োগের নীতি অনুসরণ না করলে ওবামার ভারত সফর নিয়ে চীনের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
চীনের তাৎক্ষণিক আরেকটি পদক্ষেপে তার প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করা যায়। বেইজিংয়ের সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার মাত্র এক দিন পর এ ঘোষণা দিয়ে চীন জানায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের ৭০তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ বছর বড় ধরনের একটি সামরিক কুচকাওয়াজের পরিকল্পনা করছে বেইজিং।
দিল্লি যে বেইজিংয়ের মনোভাব বুঝতে পারেনি তা নয়। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে মন্তব্য, আঞ্চলিক বলয় গঠন ইত্যাদি নিয়ে বেইজিংয়ের ক্ষোভ আর আমেরিকার সাথে যৌথভাবে অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা গবেষণার ব্যাপারে রুশ অসন্তোষ নমনীয় করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে আগামী সপ্তাহের শুরুতে চীন পাঠাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। আগামী রোববার সুষমা সেখানে চীনা প্রতিপক্ষ ওয়াং ই’র সাথে উভয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বিপক্ষীয় আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন। তারা রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সাথে ত্রিপক্ষীয় আলোচনাও করবেন। মোদি আমেরিকার সাথে অংশীদারিত্বকে যতই এগিয়ে নিতে চান না কেন, এ মুহূর্তে চীন-রাশিয়াকে হয়তো বেশি বৈরী করতে চাইছেন না। কিন্তু বাস্তবে তা কতটা তিনি পারবেন সেটি নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়।
ওবামার সফর নিয়ে ব্রিটিশ সাময়িকী ইকনোমিস্টের মূল্যায়নটিও তাৎপর্যপূর্ণ। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘আগে যে চুলজ্জা, চীনকে না রাগানো ইত্যাদি ব্যাপার ছিল, এখন মোদির আমলে সেটা দৃশ্যত কেটে গেছে।... বর্তমানে ভারত ও আমেরিকা গোয়েন্দা সহযোগিতা করে যাচ্ছে। দুই দেশই পাকিস্তান নিয়ে কিছু অবিশ্বাসে ভুগছে এবং দেশটিতে ইসলামি চরমপন্থীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। অন্য দিকে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক ভারত একসময় তার প্রতিরা সরঞ্জামের সরবরাহের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকলেও এখন ক্রমবর্ধমান হারে আমেরিকা, ইসরাইল ও অন্যান্য দেশের উচ্চপ্রযুক্তির প্রস্তাব পাচ্ছে। গত নভেম্বর দুই দশকের মধ্যে প্রথমবার রাশিয়া তার প্রতিরামন্ত্রীকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ পাঠিয়েছিল দেশটিতে অস্ত্র বিক্রি শুরুর জন্য। আর এটা ভারতকে রাশিয়ার বিকল্প খোঁজাকে ত্বরান্বিতই করেছে।’
ক্ষুব্ধ পাকিস্তান
ভারতে ওবামার সফরকালে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানও। চার বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দানের ঘোষণার পর ওবামা যখন নরেন্দ্র মোদির সাথে করমর্দন করছিলেন, ঠিক সে সময় বেইজিং সফররত পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফকে জমকালো সংবর্ধনা দেয় চীন। বেইজিং ঘোষণা করে, পাকিস্তান হলো চীনের সব সময়ের অপরিবর্তনীয় বন্ধু।
পাকিস্তানের আপত্তি আমেরিকার সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে। দেশটির সাবেক ফেডারেল মন্ত্রী খুরশিদ শাহ বলেছেন, আমরা ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন নই। আমাদের উৎকণ্ঠা হলো দেশটির দ্বিমুখিতা নিয়ে। আমরা আফগানিস্তানের যুদ্ধে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কিভাবেই না তাদের সাহায্য করেছি। যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে গিয়ে পাকিস্তানকে শরণার্থীর বোঝা, হেরোইনের উপদ্রব, কালাশনিকভ এবং উগ্রপন্থার বিস্তৃতির ঝুঁকি বইতে হচ্ছে।
ডেইলি টাইমসের অপ-এড সম্পাদক মেহের তারার লিখেছেন, সন্ত্রাসের ব্যাপারে অভিযোগের আঙুল তোলা হচ্ছে পাকিস্তানের প্রতি। অথচ আফগানিস্তানকে ব্যবহার করে পাকিস্তানে ভারতের সন্ত্রাসী হামলায় ইন্ধন দেয়ার প্রমাণাদি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এরপর আশা করা হয়েছিল সেখানে আমেরিকান বাহিনী প্রত্যাহারে ভারতের ভূমিকা থাকবে না। কিন্তু এখন আফগানিস্তানেও ভারত-মার্কিন সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে। কাশ্মিরে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে অবজ্ঞা করছে ভারত। এই ইস্যুর গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি না করে ভারতকে কোনোভাবেই জাতিসঙ্ঘে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে সমর্থন দেয়া যেতে পারে না। আমেরিকা ভারতকে এশিয়ার সাথে কানেকটিভিটিতে সহায়তার কথা বলছে অথচ পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। আর পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে কিছু জানানোও হয়নি।
ওবামার সফরকালে ভারতের সাথে যে চুক্তি ও সমঝোতা করা হয়েছে তা কার্যকর হলে এ অঞ্চলে পারস্পরিক সম্পর্কে যে ভারসাম্য ছিল তা আর থাকবে না। ¯œায়ুযুদ্ধকাল থেকে পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র। এবার ওবামা ভারতকে তার দেশের ‘প্রাকৃতিকভাবে বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিকল্প হবে চীনের সাথে অধিক মৈত্রী ও নির্ভরতা গড়ে তোলা। রাশিয়ার সাথেও ইসলামাবাদ আরো সম্পর্ক গভীর করতে পারে। দেশটির সাথে সম্প্রতি অস্ত্রশস্ত্র কেনার সমঝোতার বিষয়টি তারই ইঙ্গিতবহ হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
ওবামার ভারত সফরের আগে লেখা কলামে উল্লেখ করেছিলাম, দুই নেতার বৈঠকে বাংলাদেশ ইস্যু সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপনের সম্ভাবনা নেই। এই ইস্যু সাইডলাইনের বৈঠকে আলোচিত হতে পারে। আর সেটি হলে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণায় এই প্রসঙ্গ আসবে না। প্রতিবেশীদের ব্যাপারে কয়েকটি দেশের কথা সফর দলিলে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশ তাতে নেই। তবে এই অঞ্চলের সব বিষয়ে দুই দেশে আলাপ-আলোচনা করে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা আছে। ইউপিএ আমলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতভিন্নতা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এখানে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও গণতন্ত্রের অবিচ্ছিন্ন চর্চা চেয়েছিল। কংগ্রেস সরকার চেয়েছিল যেভাবে হোক তাদের বিশ্বস্ত দলকে ক্ষমতায় রাখতে। বিজেপি সরকার ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও আগের সরকারের নীতিকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আকবর উদ্দিনের বিবৃতিতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এ ছাড়া ওবামা ভারত ছাড়ার পরপরই বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তার স্থলে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে। এতে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যেকোনো পরিবর্তনে দুই পক্ষের ঐকমত্য থাকবে, যেটি ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের সময় ছিল না।
রয়ে গেছে সংশয়
মোদি যেভাবে আমেরিকার সাথে চলার চুক্তি করেছেন, সেভাবে এগোনো দেশটির পক্ষে সহজ হবে না। স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময় ভারতের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল সোভিয়েতনির্ভর। এরপর আমেরিকা ও ইসরাইল থেকে উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করা হলেও সেই নির্ভরতা একেবারে দূর হয়ে গেছে বলা যাবে না। বিগত সরকারের আমলেও প্রতিরক্ষা বিষয়ে নতুন করে চুক্তি হয়েছে রাশিয়ার সাথে। আমেরিকান অংশীদারিত্ব নির্ভরতার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় আনতে পারে। তবে রাতারাতি সেটি করা সম্ভব হবে না। প্রজাতন্ত্র দিবসের যে কুচকাওয়াজে ওবামাকে অভিবাদন জানানো হয়, সেখানেও রাশিয়ার তৈরি বিমানই ব্যবহার করা হয়েছে। অন্য দিকে চীনের সাথে ভারতের বৈরিতার মধ্যেও যে নির্ভরশীলতার সম্পর্ক রয়েছে তাকে সর্বাত্মক শত্রুতায় পরিণত করা সম্ভব হবে না দিল্লির পক্ষে। চীন-ভারত-রাশিয়া এই তিন দেশ হলো ব্রিকসের মূল স্তম্ভ। ব্রিকস ব্যাংক থেকে শুরু করে বিকল্প বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির সাথে এই তিন দেশ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। চীনের সাথে মিলে ভারতের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কানেকটিভিটি গড়ে তোলার একটি প্রকল্পও রয়েছে। সব মিলিয়ে যতটা উচ্ছ্বাস ওবামার সফর নিয়ে, এখন দেখা যাচ্ছে ততটা সামনে নাও থাকতে পারে। ইউপিএ সরকারের সময়ও সেটিই দেখা গিয়েছিল।
No comments