নিরাপত্তাবাহিনীর মারাত্মক ঘটনায় চোখ বন্ধ রেখেছে সরকার -হিউম্যান রাইটস
হত্যা,
গুম ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারসহ নিরাপত্তা বাহিনীসমূহের মারাত্মক আইন
লঙ্ঘনের বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা অপহরণ,
হত্যা ও খেয়ালখুশিমতো আটক করছে। বিশেষ করে তা করা হচ্ছে বিরোধীদলীয়
নেতাকর্মীদের টার্গেট করে। সমালোচকদের দমন করার লক্ষ্যে সরকার বেশকিছু
পদক্ষেপ নিয়েছে। গণমাধ্যমবিষয়ক নতুন নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। এতে মুক্ত
মতপ্রকাশ ও বক্তব্যের ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য সীমারেখা আরোপ করা হয়েছে। ২০১৩
সালে সরকার বেশ কয়েকটি টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যম সমালোচনামূলক রিপোর্ট করায়
বন্ধ করে দেয়। তা গত বছরজুড়েও বন্ধ ছিল। শ্রম আইন সংশোধন করলেও শ্রমিকরা
হয়রান হচ্ছেন। তারা ইউনিয়ন করতে গেলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। তারা সহিংস
আচরণের শিকার হন। গতকাল আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস
ওয়াচ তার বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। ৬৫৬ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে
বাংলাদেশে ২০১৪ সালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ইভেন্ট তুলে ধরা হয়। এতে বাংলাদেশ
অধ্যায়টি ৫ পৃষ্ঠার। এতে বিশ্বের ৯০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি
পর্যালোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরকারি নিরাপত্তা
সংস্থাগুলো ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরে মানবাধিকার লঙ্ঘন
করেছে।
অপরদিকে বিরোধী দলগুলোর সদস্যরা অবরোধ ও জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে সহিংস কর্মকান্ড ও নির্বিচার আক্রমণে জড়িত ছিল। ভাল তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন সমপর্কিত সহিংসতা অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের দায়ে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ নেয় নি সরকার। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল, মে মাসে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কয়েকজন সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা, যারা স্থানীয় এক রাজনীতিককে হত্যা করতে উচ্চ পর্যায়ে (হাই প্রোফাইল) চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, র্যাবের কয়েকজন সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, বিচার যাতে বেছে বেছে বা পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমপর্কের উপর নির্ভর করে করা না হয়। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে সরকারের স্বার্থ রক্ষা হওয়ায়, সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাথমিকভাবে দায়মুক্তি দিয়ে রেখেছে এবং তাদের মারাত্মক ঘটনাগুলোর বেলায় চোখ বন্ধ রেখেছে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক বহুদিন ধরে এটি প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে। প্রতিবেদনের শুরুতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রোথ তার লেখায় সরকারগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন যেন, অশান্ত সময়ে কার্যকর নৈতিক পথ নির্দেশ করে মানবাধিকার, এ বিষয়টি যেন তারা স্বীকার করে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তা থেকে নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীনতার মূল বিষয়গুলো অবদমিত করে যে স্বল্পমেয়াদি সুবিধা পাওয়া যায়, তা দীর্ঘমেয়াদে খুব কমই লাভজনক হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশে বহুদিন ধরে বিদ্যমান মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো নিয়েও আলোকপাত করছে। এতে বলা হয়, বাল্যবিবাহ এখনও মারাত্মক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা এখনও সঙ্কটজনক। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রবেশে জটিলতা নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সুশীল সমাজের উপর বহু বছর ধরে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ বৃদ্ধির পর, সরকার একটি খসড়া বিলের সূচনা করেছে, যেখানে বিধি-নিষেধমূলক বিভিন্ন নিয়মনীতি আইনসিদ্ধ করা হবে। একই সঙ্গে সরকার নতুন গণমাধ্যম নীতির সূচনা করেছে, যা মুক্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর অগ্রহণযোগ্য সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করবে। যদিও সরকার ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর শ্রমিক আইন সংশোধন করেছে, তবুও শ্রমিকরা এখনও শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন ও সেখানে যোগ দিতে গেলে ভয়ভীতি ও সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগ আনেন। ২০১৪ সালে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের খুচরা তৈরী পোশাক ব্যবসায়ীদের দুইটি গ্রুপ ২০০০ এরও বেশি কারখানায় আলাদা আলাদা ভাবে নিরাপত্তা পরিদর্শন সমপন্ন করেছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর একটি চুক্তির অধীনে পরিদর্শন সমপন্ন করে প্রতিবেদনও দেয় ওই দুইটি গ্রুপ। তারা ওই প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে। কিছু কারখানায় সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকার যেসব পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সে সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় নি। তাই জানা সম্ভব হয়নি যে, ওইসব কারখানায় কোন সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে কিনা। ব্রাড এডামস বলেন, অবশেষে সরকার ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের ভয়াবহ পরিস্থিতির উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। কিন্তু এই অবস্থান ধরে রাখতে হবে। আত্মপ্রসাদ এবং অনেক কিছুই করা হয়েছে, এমন ভাবনা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। কেননা, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সকল ধরনের শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া সবেমাত্র শুরু হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে গত বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ও সহিংসতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে বিতর্কিত নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা দেখা দেয় তাতে কয়েক শ’ মানুষ নিহত ও আহত হয়।
এই সহিংসতার জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী। বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা ওই সময়ে হরতাল ও অবরোধকালে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। নির্বাচনের আগে ও পরে তারা হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে ভাঙচুর চালায়। জবাবে সরকার বিরোধীদলীয় সদস্যদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন শুরু করে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, খেয়াল-খুশি মতো গ্রেপ্তার, বেআইনিভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংস করে। গত বছর জুলাই মাসে সরকার ফরেন ডোনেশনস (ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিজ) রেগুলেশন অ্যাক্ট-এর খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করে। এর মধ্য দিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশী অনুদান পায় তার কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য ছিল। এর মধ্য দিয়ে এনজিওগুলোতে অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। আগস্টে সরকার সব অডিও, ভিডিও, অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের জন্য একটি নতুন নীতি প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে সমালোচনামূলক রিপোর্টিয়ের রেশ টেনে ধরাই ছিল উদ্দেশ্য। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ঢাকার আবাসিক এলাকা হাজারীবাগের ট্যানারি শ্রমিকরা উচ্চ মাত্রার বিষক্রিয়ায় অব্যাহতভাবে ভুগছে। তাদের কর্মপরিবেশ ভয়াবহ। কিছু ট্যানারি এরই মধ্যে সাভারে শিল্প এলাকায় নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ শুরু করেছে। তবে তাদের কারখানা স্থানান্তর বিলম্বিত হবে। পাশের বসতির মানুষজন বাতাস, পানি ও মাটি দূষণ থেকে ভুগছে।
হাজারীবাগ ট্যানারিতে শ্রম ও পরিবেশ আইন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। ওই রিপোর্টে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে বলা হয়েছে, আইনমন্ত্রীর কাছে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছে প্রসিকিউশন, যাতে পুরো জামায়াতে ইসলামী নামের দলটির বিচার করা যায়। বিচার পরিক্রমা নিয়ে মারাত্মক উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও নভেম্বরে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-ের বিধান নিশ্চিত করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে এখনও বাল্যবিবাহ বিদ্যমান আছে। মৃত্যুদ- কার্যকর অব্যাহত আছে বাংলাদেশে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। গত বছর একদলীয় নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দলের সমঝোতার চেষ্টা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বাংলাদেশে প্রভাব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সহ বেশকিছু দেশের। সমঝোতায় পৌঁছাতে তাদের চাপও কাজ দেয় নি। জাতিসংঘের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা র্যাবকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক মানদ- বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও গার্মেন্ট কারখানাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশকে দেয়া জিএসপি সুবিধা এখনও বন্ধ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কতা উচ্চারণ করেছে। তারা বলেছে, শ্রমিক অধিকার ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা উন্নত করা না হলে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা ও উন্মুক্ত কোটা সুবিধা হারাতে পারে।
অপরদিকে বিরোধী দলগুলোর সদস্যরা অবরোধ ও জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে সহিংস কর্মকান্ড ও নির্বিচার আক্রমণে জড়িত ছিল। ভাল তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন সমপর্কিত সহিংসতা অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের দায়ে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ নেয় নি সরকার। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল, মে মাসে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কয়েকজন সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা, যারা স্থানীয় এক রাজনীতিককে হত্যা করতে উচ্চ পর্যায়ে (হাই প্রোফাইল) চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, র্যাবের কয়েকজন সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, বিচার যাতে বেছে বেছে বা পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমপর্কের উপর নির্ভর করে করা না হয়। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে সরকারের স্বার্থ রক্ষা হওয়ায়, সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাথমিকভাবে দায়মুক্তি দিয়ে রেখেছে এবং তাদের মারাত্মক ঘটনাগুলোর বেলায় চোখ বন্ধ রেখেছে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক বহুদিন ধরে এটি প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে। প্রতিবেদনের শুরুতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রোথ তার লেখায় সরকারগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন যেন, অশান্ত সময়ে কার্যকর নৈতিক পথ নির্দেশ করে মানবাধিকার, এ বিষয়টি যেন তারা স্বীকার করে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তা থেকে নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীনতার মূল বিষয়গুলো অবদমিত করে যে স্বল্পমেয়াদি সুবিধা পাওয়া যায়, তা দীর্ঘমেয়াদে খুব কমই লাভজনক হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশে বহুদিন ধরে বিদ্যমান মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো নিয়েও আলোকপাত করছে। এতে বলা হয়, বাল্যবিবাহ এখনও মারাত্মক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা এখনও সঙ্কটজনক। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রবেশে জটিলতা নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সুশীল সমাজের উপর বহু বছর ধরে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ বৃদ্ধির পর, সরকার একটি খসড়া বিলের সূচনা করেছে, যেখানে বিধি-নিষেধমূলক বিভিন্ন নিয়মনীতি আইনসিদ্ধ করা হবে। একই সঙ্গে সরকার নতুন গণমাধ্যম নীতির সূচনা করেছে, যা মুক্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর অগ্রহণযোগ্য সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করবে। যদিও সরকার ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর শ্রমিক আইন সংশোধন করেছে, তবুও শ্রমিকরা এখনও শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন ও সেখানে যোগ দিতে গেলে ভয়ভীতি ও সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগ আনেন। ২০১৪ সালে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের খুচরা তৈরী পোশাক ব্যবসায়ীদের দুইটি গ্রুপ ২০০০ এরও বেশি কারখানায় আলাদা আলাদা ভাবে নিরাপত্তা পরিদর্শন সমপন্ন করেছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর একটি চুক্তির অধীনে পরিদর্শন সমপন্ন করে প্রতিবেদনও দেয় ওই দুইটি গ্রুপ। তারা ওই প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে। কিছু কারখানায় সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকার যেসব পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সে সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় নি। তাই জানা সম্ভব হয়নি যে, ওইসব কারখানায় কোন সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে কিনা। ব্রাড এডামস বলেন, অবশেষে সরকার ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের ভয়াবহ পরিস্থিতির উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। কিন্তু এই অবস্থান ধরে রাখতে হবে। আত্মপ্রসাদ এবং অনেক কিছুই করা হয়েছে, এমন ভাবনা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। কেননা, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সকল ধরনের শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া সবেমাত্র শুরু হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে গত বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ও সহিংসতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে বিতর্কিত নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা দেখা দেয় তাতে কয়েক শ’ মানুষ নিহত ও আহত হয়।
এই সহিংসতার জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী। বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা ওই সময়ে হরতাল ও অবরোধকালে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। নির্বাচনের আগে ও পরে তারা হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে ভাঙচুর চালায়। জবাবে সরকার বিরোধীদলীয় সদস্যদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন শুরু করে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, খেয়াল-খুশি মতো গ্রেপ্তার, বেআইনিভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংস করে। গত বছর জুলাই মাসে সরকার ফরেন ডোনেশনস (ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিজ) রেগুলেশন অ্যাক্ট-এর খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করে। এর মধ্য দিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশী অনুদান পায় তার কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য ছিল। এর মধ্য দিয়ে এনজিওগুলোতে অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। আগস্টে সরকার সব অডিও, ভিডিও, অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের জন্য একটি নতুন নীতি প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে সমালোচনামূলক রিপোর্টিয়ের রেশ টেনে ধরাই ছিল উদ্দেশ্য। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ঢাকার আবাসিক এলাকা হাজারীবাগের ট্যানারি শ্রমিকরা উচ্চ মাত্রার বিষক্রিয়ায় অব্যাহতভাবে ভুগছে। তাদের কর্মপরিবেশ ভয়াবহ। কিছু ট্যানারি এরই মধ্যে সাভারে শিল্প এলাকায় নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ শুরু করেছে। তবে তাদের কারখানা স্থানান্তর বিলম্বিত হবে। পাশের বসতির মানুষজন বাতাস, পানি ও মাটি দূষণ থেকে ভুগছে।
হাজারীবাগ ট্যানারিতে শ্রম ও পরিবেশ আইন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। ওই রিপোর্টে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে বলা হয়েছে, আইনমন্ত্রীর কাছে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছে প্রসিকিউশন, যাতে পুরো জামায়াতে ইসলামী নামের দলটির বিচার করা যায়। বিচার পরিক্রমা নিয়ে মারাত্মক উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও নভেম্বরে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-ের বিধান নিশ্চিত করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে এখনও বাল্যবিবাহ বিদ্যমান আছে। মৃত্যুদ- কার্যকর অব্যাহত আছে বাংলাদেশে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। গত বছর একদলীয় নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দলের সমঝোতার চেষ্টা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বাংলাদেশে প্রভাব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সহ বেশকিছু দেশের। সমঝোতায় পৌঁছাতে তাদের চাপও কাজ দেয় নি। জাতিসংঘের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা র্যাবকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক মানদ- বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও গার্মেন্ট কারখানাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশকে দেয়া জিএসপি সুবিধা এখনও বন্ধ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কতা উচ্চারণ করেছে। তারা বলেছে, শ্রমিক অধিকার ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা উন্নত করা না হলে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা ও উন্মুক্ত কোটা সুবিধা হারাতে পারে।
No comments