দেশে দেশে বইমেলা by ইমরান মাহফুজ
মানব জীবনের ইতিহাসের মতো বইয়ের ইতিহাস
অনেক প্রাচীন। মানুষ যখন থেকে সভ্য হতে শুরু করেছে, নিজেকে প্রকাশ করতে
চেয়েছে তখন থেকেই বইকে আঁকড়ে ধরেছে। বইয়ের এ হাট-বাজারে, যাকে আজকে আমরা
মেলা বলছি তা ঠিক কবে-কোথায় শুরু হয়েছিল; তার দিন তারিখ কোথাও লেখা নেই।
তবে হাট-বাজার যে মুদ্র্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের আগে বসেনি, তা নিয়ে মোটামুটি
দ্বিমত নেই। কারণ মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের আগে তো বই লেখা হতো হাতে। আর তা
ছিল ঝামেলার কাজ। তাই সে সময় বই নিয়ে মেলা বা হাট-বাজারের কথা চিন্তাও করা
যায় না। বই কেনা-বেচার হাট-বাজারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় মাত্র কয়েকশ বছর
আগের কথা। খ্রিস্টীয় পনেরো শতকে গুটেনবার্গ মুদ্রণ যন্ত্রের সুবিধা ভোগ
করতে শুরু করল মানুষ। আর এতেই ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকল বই। ফলে দেখা দিল
বই বেচাকেনার জন্য নির্ধারিত স্থানের। আর তা থেকেই শুরু হল বইমেলা। সেই
হিসেবে বিশ্বের প্রথম বইমেলা শুরু হয় জার্মানিতে। কারও কারও মতে জার্মানির
লিপজিগ শহরে হয়েছিল প্রথম বইমেলা। আবার কেউ ধারণা করেন লিপজিগ নয়,
গুটেনবার্গের শহর ফ্রাঙ্কফুর্টেই হয়েছিল বিশ্বের প্রথম বইমেলা। জার্মানি
থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বইমেলা। খ্রিস্টীয় ১৭ শতকের পর থেকে
ইউরোপের আরও বিভিন্ন দেশ জার্মানির বইমেলার আদলে আয়োজন করতে থাকে মেলার।
মানুষ নানারকম মেলার সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের মেলার সঙ্গেও পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে।
ক্রমে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠতে থাকে বইমেলা। এখানে তুলে ধরা হল দেশ-বিদেশের
কয়েকটি বইমেলার কথা।
একুশের বইমেলা
ফেব্রুয়ারি বাঙালির কাছে অন্যরকম এক মূল্যবোধের মাস। এ মাসে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল বাঙালি। বিশ্বে এ এক বিরল ইতিহাস। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামের সূচনা এ ফেব্র“য়ারি মাসে। চেতনার পরশ বুলিয়ে ফেব্র“য়ারিতে উৎসবের আমেজ এনে দেয় বাংলা একাডেমির অমর একুশের বইমেলা। এ মেলা এখন বাঙালির প্রাণের মেলা এ মেলা অনুষ্ঠিত হয় ফেব্র“য়ারিতে। চলে পুরো মাস। বইপ্রেমিকরা সারা বছর অপেক্ষা করেন এ মাসের জন্য। লেখক-প্রকাশক এবং প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট সবার নজর থাকে ফেব্র“য়ারিজুড়ে। মেলা চলে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে। আমাদের প্রকাশনা জগতে সারা বছরই বই প্রকাশ পায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বই প্রকাশ পায় মেলার মাসে। লেখকরাও এ মাসেই নিজেদের বই প্রকাশে আগ্রহ দেখান। কারণ, একসঙ্গে এত পাঠকের সামনে নিজের বইটি তুলে দেয়ার এমন সুযোগ আর দ্বিতীয়টি নেই। বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন অনেকে। তাদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আমাদের বইমেলার নাম দেয়া হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আজকের বইমেলা শুরুতে এমন অবস্থায় ছিল না। তেমনি ছিল না এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক পরের বছর থেকে শুরু হয় বইমেলার। ১৯৭২ সালে মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা ফেব্র“য়ারি মাসের ৮ তারিখে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় তার প্রকাশনীর বই বিছিয়ে বসেন। সে সময় মুক্তধারার ছিল ৩২টি বই। বইগুলো ছিল বাংলাদেশের শরণার্থী লেখকদের লেখা। এ বছর বাংলা একাডেমিও একুশে ফেব্র“য়ারি উপলক্ষে বিশেষ মূল্য ছাড়ের মাধ্যমে তাদের বই বিক্রি করে। সেই শুরু থেকে একটানা ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তার প্রকাশনীর বই বিক্রির জন্য নিয়ে বসেন। ধীরে ধীরে এখানে লোক সমাগম বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে বইয়ের বিক্রিও। ফলে অন্য প্রকাশকরাও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে অন্যরাও এগিয়ে আসতে থাকে তাদের বই নিয়ে। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি এ মেলাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি সরাসরি যুক্ত হয় মেলার সঙ্গে। ১৯৭৯ সালে বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। তারপর থেকে প্রতিবছর ফেব্র“য়ারিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বইমেলা। কিন্তু ধীরে ধীরে মেলা নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ায় মেলার সময় বাড়ানো হয়। এখন ফেব্রুয়ারিজুড়েই চলে একুশের গ্রন্থমেলা। দ্বিতীয় বছরের মতো বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণসহ বাইরে বসছে খুব সুন্দরভাবে। উল্লেখ্য, প্রতিবছর ডিসেম্বরে ১০ দিনব্যাপী জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের বইমেলাও অনুষ্ঠিত হয়।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গ থাকতেন ফ্রাঙ্কফুর্টের সামান্য দূরের মেঞ্জ শহরে। তার আবিষ্কৃত ছাপাখানার যন্ত্র বইয়ের জগতে নিয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তিনি নিজের ছাপাখানার যন্ত্রাংশ এবং ছাপানো বই বিক্রির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্টে আসেন। গুটেনবার্গের দেখাদেখি ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতাও তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে বসতে থাকে। আর এগুলো কিনতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষও আসতে শুরু করে। সেই আসা-যাওয়া থেকেই জমে উঠতে থাকে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালে এ মেলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় জার্মান প্রকাশক সমিতি। আর ১৯৬৪ সাল থেকে এ মেলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে। বছরের অক্টবরের মাঝামাঝি সময়ে মেলা শুরু হয়। মেলার সময়কাল পাঁচ দিন। মেলার আয়োজক জার্মান পাবলিশার অ্যান্ড বুক সেলার অ্যাসোসিয়েশন। প্রতি বছরই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার প্রকাশক, বিক্রেতা, লেখক, পাঠক, দর্শক ও সাংবাদিকের অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা।
লন্ডন বইমেলা
প্রকাশনার দিক থেকে লন্ডন বইমেলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলার অন্যতম। তবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার মতো বড় না হলেও এ মেলার গুরুত্ব অনেক। সাধারণত বছরের মার্চ মাসে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তবে কখনও কখনও অক্টোবরেও মেলার তারিখ পরিবর্তন হয়, সেই সঙ্গে পাল্টে যায় মেলার স্থানও । যেমন ২০০৬ সালে মেলাটি হয়েছিল লন্ডনের অলিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টারে আবার পরের বছর হয় ডকল্যান্ডের আর্ল কোট এক্সিবিশন সেন্টারে। আয়তনে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার সমান না হলেও নিজের গুরুত্ব ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছে লন্ডন বইমেলা। গত বছর এ মেলায় বিশ্বের প্রায় একশরও বেশি দেশ থেকে ২৩ হাজার প্রকাশক, বই বিক্রেতা, সাহিত্য প্রতিনিধি, লাইব্রেরিয়ান, সংবাদমাধ্যম কর্মী অংশ নিয়েছিল। প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচারের জন্য, অন্য প্রকাশক থেকে বইয়ের স্বত্ব অথবা বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব কেনা-বেচার জন্য প্রকাশকরা এ মেলায় অংশ নেয়। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার সঙ্গে এ মেলার বড় পার্থক্য হল- এটি প্রকৃত অর্থে প্রকাশকদের মেলা। এখানে সাধারণ পাঠকের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এখানে ভিড় করেন বিভিন্ন দেশের প্রকাশকরা।
কলকাতা বইমেলা
ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং লন্ডন বইমেলার পরের স্থানটি কলকাতা বইমেলার। সে হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা এটি। মেলা শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। মেলা অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারির শেষ বুধবার থেকে ফেব্র“য়ারির প্রথম রোববার পর্যন্ত। সব মিলিয়ে মেলার মেয়াদ ১২ দিন। তবে মেলা আয়োজনের প্রথম দিকে এর মেয়াদ ছিল সাতদিন। জনপ্রিয়তার কারণে পরে মেলার মেয়াদ বাড়ানো হয়। বইমেলা ছাড়া কলকাতাকে কল্পনা করতে পারে না কলকাতাবাসী। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মেলায় প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষের সমাগম হয়। সবদিক বিবেচনায় ২০০৫ সালে মেলার মেয়াদ সাতদিন থেকে বাড়িয়ে বারদিন করা হয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং লন্ডন এ দুটি বইমেলার সঙ্গে কলকাতার বইমেলার পার্থক্য হল- এখানে পাঠকদেও গুরুত্ব দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি। বই ব্যবসা এ মেলার মূল উদ্দেশ্য নয়। সেদিক থেকে কলকাতা বইমেলাকে বলা যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় অব্যবসায়িক বইমেলা। কলকাতা বইমেলার অফিসিয়াল নাম কলকাতা বইমেলা বা কলকাতা পুস্তকমেলা।
ভারতের দিল্লি ও হংকং বইমেলা ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে, সারা বিশ্বে ক্রমেই বইয়ের প্রতি মানুষের আলাদা একটা টান তৈরি হচ্ছে। সেটা বিভিন্ন বইমেলার কারণেই হয়ে থাকে বলে অনেকের অভিমত।
একুশের বইমেলা
ফেব্রুয়ারি বাঙালির কাছে অন্যরকম এক মূল্যবোধের মাস। এ মাসে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল বাঙালি। বিশ্বে এ এক বিরল ইতিহাস। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামের সূচনা এ ফেব্র“য়ারি মাসে। চেতনার পরশ বুলিয়ে ফেব্র“য়ারিতে উৎসবের আমেজ এনে দেয় বাংলা একাডেমির অমর একুশের বইমেলা। এ মেলা এখন বাঙালির প্রাণের মেলা এ মেলা অনুষ্ঠিত হয় ফেব্র“য়ারিতে। চলে পুরো মাস। বইপ্রেমিকরা সারা বছর অপেক্ষা করেন এ মাসের জন্য। লেখক-প্রকাশক এবং প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট সবার নজর থাকে ফেব্র“য়ারিজুড়ে। মেলা চলে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে। আমাদের প্রকাশনা জগতে সারা বছরই বই প্রকাশ পায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বই প্রকাশ পায় মেলার মাসে। লেখকরাও এ মাসেই নিজেদের বই প্রকাশে আগ্রহ দেখান। কারণ, একসঙ্গে এত পাঠকের সামনে নিজের বইটি তুলে দেয়ার এমন সুযোগ আর দ্বিতীয়টি নেই। বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন অনেকে। তাদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আমাদের বইমেলার নাম দেয়া হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আজকের বইমেলা শুরুতে এমন অবস্থায় ছিল না। তেমনি ছিল না এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক পরের বছর থেকে শুরু হয় বইমেলার। ১৯৭২ সালে মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা ফেব্র“য়ারি মাসের ৮ তারিখে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় তার প্রকাশনীর বই বিছিয়ে বসেন। সে সময় মুক্তধারার ছিল ৩২টি বই। বইগুলো ছিল বাংলাদেশের শরণার্থী লেখকদের লেখা। এ বছর বাংলা একাডেমিও একুশে ফেব্র“য়ারি উপলক্ষে বিশেষ মূল্য ছাড়ের মাধ্যমে তাদের বই বিক্রি করে। সেই শুরু থেকে একটানা ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তার প্রকাশনীর বই বিক্রির জন্য নিয়ে বসেন। ধীরে ধীরে এখানে লোক সমাগম বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে বইয়ের বিক্রিও। ফলে অন্য প্রকাশকরাও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে অন্যরাও এগিয়ে আসতে থাকে তাদের বই নিয়ে। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি এ মেলাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি সরাসরি যুক্ত হয় মেলার সঙ্গে। ১৯৭৯ সালে বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। তারপর থেকে প্রতিবছর ফেব্র“য়ারিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বইমেলা। কিন্তু ধীরে ধীরে মেলা নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ায় মেলার সময় বাড়ানো হয়। এখন ফেব্রুয়ারিজুড়েই চলে একুশের গ্রন্থমেলা। দ্বিতীয় বছরের মতো বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণসহ বাইরে বসছে খুব সুন্দরভাবে। উল্লেখ্য, প্রতিবছর ডিসেম্বরে ১০ দিনব্যাপী জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের বইমেলাও অনুষ্ঠিত হয়।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গ থাকতেন ফ্রাঙ্কফুর্টের সামান্য দূরের মেঞ্জ শহরে। তার আবিষ্কৃত ছাপাখানার যন্ত্র বইয়ের জগতে নিয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তিনি নিজের ছাপাখানার যন্ত্রাংশ এবং ছাপানো বই বিক্রির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্টে আসেন। গুটেনবার্গের দেখাদেখি ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতাও তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে বসতে থাকে। আর এগুলো কিনতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষও আসতে শুরু করে। সেই আসা-যাওয়া থেকেই জমে উঠতে থাকে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালে এ মেলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় জার্মান প্রকাশক সমিতি। আর ১৯৬৪ সাল থেকে এ মেলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে। বছরের অক্টবরের মাঝামাঝি সময়ে মেলা শুরু হয়। মেলার সময়কাল পাঁচ দিন। মেলার আয়োজক জার্মান পাবলিশার অ্যান্ড বুক সেলার অ্যাসোসিয়েশন। প্রতি বছরই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার প্রকাশক, বিক্রেতা, লেখক, পাঠক, দর্শক ও সাংবাদিকের অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা।
লন্ডন বইমেলা
প্রকাশনার দিক থেকে লন্ডন বইমেলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলার অন্যতম। তবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার মতো বড় না হলেও এ মেলার গুরুত্ব অনেক। সাধারণত বছরের মার্চ মাসে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তবে কখনও কখনও অক্টোবরেও মেলার তারিখ পরিবর্তন হয়, সেই সঙ্গে পাল্টে যায় মেলার স্থানও । যেমন ২০০৬ সালে মেলাটি হয়েছিল লন্ডনের অলিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টারে আবার পরের বছর হয় ডকল্যান্ডের আর্ল কোট এক্সিবিশন সেন্টারে। আয়তনে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার সমান না হলেও নিজের গুরুত্ব ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছে লন্ডন বইমেলা। গত বছর এ মেলায় বিশ্বের প্রায় একশরও বেশি দেশ থেকে ২৩ হাজার প্রকাশক, বই বিক্রেতা, সাহিত্য প্রতিনিধি, লাইব্রেরিয়ান, সংবাদমাধ্যম কর্মী অংশ নিয়েছিল। প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচারের জন্য, অন্য প্রকাশক থেকে বইয়ের স্বত্ব অথবা বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব কেনা-বেচার জন্য প্রকাশকরা এ মেলায় অংশ নেয়। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার সঙ্গে এ মেলার বড় পার্থক্য হল- এটি প্রকৃত অর্থে প্রকাশকদের মেলা। এখানে সাধারণ পাঠকের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এখানে ভিড় করেন বিভিন্ন দেশের প্রকাশকরা।
কলকাতা বইমেলা
ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং লন্ডন বইমেলার পরের স্থানটি কলকাতা বইমেলার। সে হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা এটি। মেলা শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। মেলা অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারির শেষ বুধবার থেকে ফেব্র“য়ারির প্রথম রোববার পর্যন্ত। সব মিলিয়ে মেলার মেয়াদ ১২ দিন। তবে মেলা আয়োজনের প্রথম দিকে এর মেয়াদ ছিল সাতদিন। জনপ্রিয়তার কারণে পরে মেলার মেয়াদ বাড়ানো হয়। বইমেলা ছাড়া কলকাতাকে কল্পনা করতে পারে না কলকাতাবাসী। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মেলায় প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষের সমাগম হয়। সবদিক বিবেচনায় ২০০৫ সালে মেলার মেয়াদ সাতদিন থেকে বাড়িয়ে বারদিন করা হয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং লন্ডন এ দুটি বইমেলার সঙ্গে কলকাতার বইমেলার পার্থক্য হল- এখানে পাঠকদেও গুরুত্ব দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি। বই ব্যবসা এ মেলার মূল উদ্দেশ্য নয়। সেদিক থেকে কলকাতা বইমেলাকে বলা যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় অব্যবসায়িক বইমেলা। কলকাতা বইমেলার অফিসিয়াল নাম কলকাতা বইমেলা বা কলকাতা পুস্তকমেলা।
ভারতের দিল্লি ও হংকং বইমেলা ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে, সারা বিশ্বে ক্রমেই বইয়ের প্রতি মানুষের আলাদা একটা টান তৈরি হচ্ছে। সেটা বিভিন্ন বইমেলার কারণেই হয়ে থাকে বলে অনেকের অভিমত।
No comments